জসীমের হাজার কোটির সম্পদ! নিজেকে বাঁচাতে খুঁজছেন রাজনৈতিক সুযোগ, এখন আত্মগোপনে?

জসীম উদ্দিন আহমেদের উত্থানের কাছে আলাদিনের চেরাগও হার মানাবে। অল্প দিনেই হাজার কোটি টাকা সম্পদের মালিক বনেছেন তিনি। টাকার খেল দেখিয়েই হয়েছেন উপজেলা চেয়ারম্যান। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নেতাদের আশ্রয় পাওয়া জসীমের বড় শক্তি ছিল সাবেক দুই পুলিশপ্রধান। আর সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ছিল তার মাখামাখা সম্পর্ক।
তবে ক্ষমতার পালাবদলে জসীম এখন বিএনপিতে ভেড়ার চেষ্টা করছেন। নানা কূটকৌশল করছেন নিজেকে বাঁচাতে। এলডিপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার দাবি করলেও সুবিধা নিয়েছেন আওয়ামী লীগ সরকার থেকে। আর এখন বিএনপির একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন।
জানা গেছে, জসীম এক সময় জীবিকার সন্ধানে মধ্যপ্রাচ্যে যান। জড়িয়ে পড়েন দুবাই-বাংলাদেশ স্বর্ণ চোরাচালান চক্রে। এরপর কিছুদিনের মধ্যে তড়তড় করে বাড়তে থাকে তার সম্পদ। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের সঙ্গেও জসীমের ‘কানেকশন’ ছিল। এছাড়া সাবেক দুজন বিতর্কিত পুলিশপ্রধানের সঙ্গেও তার ব্যাপক সম্পর্ক ছিল।
বিগত সরকারের এসব উচ্চপর্যায়ের লোকজনের খাতির পাওয়া জসীম ব্যাংক থেকে শতকোটি টাকা ঋণ নিলেও তা আর ফেরত দেননি। বরং আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় প্রভাব খাটিয়ে চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলা চেয়ারম্যানের পদ বাগিয়ে নেন। জেসিকা গ্রুপ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান জসীমের বাড়ি চন্দনাইশের বদুরপাড়া গ্রামে। সেখানে তিনি বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণ করেছেন।
সূত্র বলছে, জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সবপর্যায়ের নেতাকর্মীদের অর্থের অন্যতম জোগানদাতা ছিলেন জসীম। বিশেষ করে চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ) আসনের সাবেক এমপি নজরুল ইসলামকে নির্বাচন করতে অর্থ দিতেন জসীম।
তবে উপজেলা নির্বাচনে জসীম নিজে প্রার্থী হলে সাবেক এমপি নজরুলের সঙ্গে বিরোধের সৃষ্টি হয়। কারণ, নজরুলের পছন্দের প্রার্থী ছিলেন চন্দনাইশ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু আহমেদ জুনু।
অভিযোগ আছে, হোটেল ব্যবসার পাশাপাশি নিষিদ্ধ জগতের ব্যবসায়ী হিসাবেও পরিচিত জসীম। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে নাইটক্লাবে নাচগানের কথা বলে অনেক মেয়েকে নিয়ে যেতেন।
উপজেলার সাতবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আহমদুর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘জসীমসব দলের পেছনেই টাকা-পয়সা খরচ করতেন। এটা ছিল তার কৌশল। সাবেক এমপি নজরুল ইসলামকেও ভোটের সময় আর্থিকভাবে সহায়তা করতেন।’
তিনি জানান, জসীম উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান থাকার সময় একবার ইউপি চেয়ারম্যানদের নিয়ে বাজে কটুক্তি করেন। এর জেরে পৌর মেয়র ও সকল চেয়ারম্যানরা উপজেলা পরিষদে তার সভা বর্জন করেন। ক্ষমা চেয়ে জসীম সেবার রক্ষা পান।’
আরেক ইউপি চেয়ারম্যান এস এম সায়েম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘উপজেলা নির্বাচনের সময় আমি সরাসরি জসীম উদ্দিনের হয়ে ভোট করেছি। তার সঙ্গে সাবেক এমপি নজরুলের ভালো সম্পর্ক ছিল। তিনি কর্নেল অলি সাহেবের অনুসারী।’
জসীম কীভাবে তিনি এত সম্পদের মালিক হলেন জানতে সায়েম বলেন, ‘তার (জসীম) পরিবারের সবাই বিদেশে থাকেন আর সেখানে ব্যবসা করেন। এর বেশি জানি না।’
চন্দনাইশের সাবেক ও বর্তমান একাধিক ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, জনপ্রতিনিধি হয়ে টাকার গরমে জসীম সবার কাছে সম্মানের পাত্র হয়ে ঠেন। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নিজেকে বাঁচাতে তিনি এখন বিএনপি সাজার চেষ্টা করছেন।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহবায়ক আবু সুফিয়ান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘শেখ হাসিনা সরকারের অনেকের সাথে তার ছবি ফেসবুকে দেখতাম। এখন দেখছি এলডিপির নেতাদের সঙ্গে তার ওঠাবসা। তিনি কখনো বিএনপির ছিলেন না, এখনো আমাদের বিএনপির সঙ্গে তার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।’বিতর্কিত ব্যবসায়ী এলডিপির অনুসারী হয়ে থাকেন, তাহলে আওয়ামী লীগের আমলে উপজেলা নির্বাচন করে চেয়ারম্যান হলেন কীভাবে? এমন প্রশ্ন স্থানীয় রাজনৈতিক মহলে বহুদিন ধরে ঘুরছে। তাদের ধারণা, মূলত টাকার জোরে আওয়ামী লীগের নেতাদের বশ করে রাখতেন তিনি। ওই নির্বাচনে স্থানীয় প্রশাসনের সবাই তার পক্ষে কাজ করেছে।
উপজেলা নির্বাচনের আগে-পরে জসীমের বিরুদ্ধে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু আহমেদ নির্বাচন কমিশনে অভিযোগও দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি ‘ঋণখেলাপি ব্যবসায়ী’ জসীম উদ্দীন সাবেক একজন আইজিপির ঘনিষ্ট সহযোগী বলে উল্লেখ করেন।
এছাড়া ইসিতে দেওয়া অভিযোগে জসীমকে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি ঘোষণা দিয়ে আদালত থেকে বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞার কথাও উল্লেখ করা হয়। পরে ৫ মাসের আটকাদেশও দেন আদালত। সাজা পরোয়ানা মাথায় নিয়ে জসীম উদ্দিন ‘পুলিশ প্রটোকলে’ নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চালান বলে অভিযোগ ছিল।
জসীম ব্যাংক ঋণ শোধ করেন না:
জসীম উদ্দীন নিজেকে সমাজসেবী, দরিদ্রদের প্রতি সহানুভূতিশীল, মানবতাবাদী এবং মানবতার ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দিতেন। পদ্মা ব্যাংক থেকে নেওয়া ৬০ কোটি টাকার ঋণ আট বছরেও দেননি। ওই ঋণটি এখন সুদসহ শতকোটি ছাড়িয়ে গেছে।
হোটেল-মোটেলে বড় বিনিয়োগ:
কক্সবাজার কলাতলীতে তারকামানের হোটেল রামাদা। ওই হোটেলে জসীমের বিনিয়োগ রয়েছে আড়াইশ কোটি টাকার বেশি। রামাদার অংশীদার সাবেক একজন আইজিপির মালিকানাও এখন জসীমের দখলে।
তাছাড়া কক্সবাজারের কলাতলীতে ‘বিকাশ বিল্ডিং’-নামে পরিচিত একটি বহুতল আবাসিক হোটেলের ৭৯টি ফ্ল্যাট কিনেছেন জসীম। সম্প্রতি সাবেক দুই আইজিপির কাছ থেকে জসীম কমপক্ষে একশ কোটি টাকা মূল্যের ১৩টি ফ্ল্যাটও কিনে নিয়েছেন।
সূত্র বলছে, চট্টগ্রাম শহরের লালদীঘির পশ্চিম পাড়ে মহল শপিং কমপ্লেক্সও কিনে নিয়েছেন জসীম উদ্দিন। এটির বাজারমূল্য প্রায় শতকোটি টাকা। চট্টগ্রামের চান্দগাঁও আবাসিক ই-ব্লকের ১৪ নম্বর প্লটে ৮০ শতক জমি রয়েছে, যার বাজারমূল্য প্রায় ৭০ কোটি টাকা। ফিরিঙ্গি বাজারে তিনটি বহুতল আবাসিক ভবন, খুলশী এলাকায় তিন কানি জমি, বাকলিয়ায় ৫ কানি জমি রয়েছে জসীমের।
এছাড়া চট্টগ্রামের পতেঙ্গা, হালিশহরের বিভিন্ন এলাকায় নামে-বেনামে শতকোটি টাকার জায়গা কিনেছেন। গ্রামে নামে-বেনামে আরও অন্তত শতকোটি টাকার সম্পদ কিনেছেন। দুবাই ও সৌদি আরবে একাধিক হোটেলের মালিকানাসহ বিভিন্ন ব্যবসায় অন্তত ৫০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে তার। সব মিলিয়ে দেশ-বিদেশে জসীম উদ্দিন হাজার কোটি টাকার বেশি সম্পদ গড়ে তুলেছেন।
আ.লীগ নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়:
সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জসীম উদ্দিনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের অনেক বড় বড় নেতার সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল। ৫ আগস্টের পর অফিস ও বাড়ি থেকে আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে তার সমস্ত ছবি সরিয়ে নিয়েছেন। স্বার্থ হাসিল করতে ওইসব নেতা ও মন্ত্রীদের প্রভাব খাটিয়ে নানা হুমকি দিতেন।
এতসব অভিযোগের বিষয়ে জসীমের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠানো হলেও তার কোনো সাড়া মেলেনি। গ্রেপ্তার এড়াতে জসীম আত্মগোপনে রয়েছেন বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
(ঢাকাটাইমস/২৬অক্টোবর/এসএস/ডিএম)

মন্তব্য করুন