সবুজ মাল্টা ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়, দৃষ্টিশক্তি থেকে সুরক্ষা দেয়

ফিচার ডেস্ক, ঢাকাটাইমস
  প্রকাশিত : ০২ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৩২
অ- অ+

বাংলাদেশে সাইট্রাস ফলের মধ্যে সবুজ মাল্টা খুবই জনপ্রিয় ও সহজলভ্য রসালো ফল। পাকা ফল দেখতে সবুজ ও খেতেও সুস্বাদু । বাজারে দাম কিছুটা কম হওয়ায় চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলছে। পৃথিবীর সব জায়গায় সাইট্রাস জাতীয় ফলের গাছ জন্মায়। এখন পর্যন্ত ৩০টি জাতীয় সাইট্রাস ফলের সন্ধান পাওয়া গেছে। লেবু, কমলা লেবু, জাম্বুরা, বাতাবি লেবু, জামির, মাল্টাসহ অনেক ধরনের সাইট্রাস জাতীয় ফল আমাদের দেশে চাষ করতে দেখা যায়। মাল্টা ফলটি জাম্বুরা এবং কমলা এই দুই ফলের সংকরায়নের মাধ্যমে উদ্ভাবিত হয়েছে।

সবুজ মাল্টার ইংরেজি নাম সুইট অরেঞ্জ। হিন্দিতে সান্তারা। বৈজ্ঞানিক নাম সাইট্রাস সিনেনসিস। সবুজ মাল্টার আদি উৎপত্তিস্থল ভিয়েতনাম, দক্ষিণ চীন এবং উত্তর-পশ্চিম ভারত। রোগির পথ্য হিসেবে মাল্টা উপকারি। দেখতে অনেক সুন্দর এবং গোলাকার হয়ে থাকে। খেতে সুস্বাদু। দারুণ গন্ধ। মাল্টায় পুষ্টিতে ভরপুর।

বাংলাদেশের বাজারে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত সবুজ ও কমলা রঙের মাল্টা দেখা যায়। ২০০৩ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট বারী মাল্টা- ১ নামে সবুজ মাল্টার উন্নতজাত উদ্ভাবন করে বহুগুনে উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে। প্রতিটি মাল্টা গাছে ৩শ বেশি ফল ধরে। হেক্টরপ্রতি ফলন আসে প্রায় ২০ মেট্রিক টন। বাজারে বিদেশি হলুদ মাল্টার দাপট চললেও বেশি দাম এবং সংরক্ষণে রাসায়নিক ব্যবহারের আশঙ্কায় ক্রেতারা এখন সবুজ মাল্টার দিকে ঝুঁকছেন। দেশেই একদিকে যেমন ফলন বেশি হচ্ছে, সেসঙ্গে অন্য মাল্টার তুলনায় দাম কম হওয়ায় ক্রেতারাও এই মাল্টা কিনছেন।

কৃষি বিজ্ঞানীদের মতে, কমলা লেবুর তুলনায় এর অভিযোজন ক্ষমতা বেশি। তাই চাষের জন্য পাহাড়ি এলাকা উৎকৃষ্ট। তবে হালকা লবণ মাটিতে এর মিষ্টতা এবং ফলন ভালো। এমনি প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায় পিরোজপুর সদরের বেশ কয়টি গ্রামে। ওখানে ছোট-বড় দুই শতাধিক বাগান রয়েছে। দক্ষিণের অন্য জেলাগুলোতেও নতুন নতুন বাগান স্থাপন হচ্ছে। এভাবে ছড়িয়ে পড়েছে পুরো অঞ্চলে। তাই বলতেই হয়; মাটি, পানি ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় দক্ষিণাঞ্চল মাল্টা চাষের বিরাট সম্ভাবনাময়।

খাটো, ছড়ানো এবং বেশ ঝোঁপালো গাছগুলোতে বাতাবি লেবুর মতো থোকা থোকা ঝুলছে মাল্টা, গাড় সবুজ রঙের ফলগুলো পাকলেও রঙের কোনো পরিবর্তন ঘটছে না; টাঙ্গাইলের মধুপুর কিংবা খাগড়াছড়ির পাহাড়ি মাটিতে বারি-১ জাতের এই মাল্টার বাগান এখন চোখে পড়ছে। আকারভেদে এসব মাল্টা প্রতি কেজি ৮০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বড় দোকানের চাইতে এসব মাল্টার সরবরাহ ও বিক্রি ভ্যান ও ফুটপাতেই বেশি হচ্ছে।

তাজা, বিষমুক্ত, সুমিষ্ট লেবু জাতীয় এ ফলটির কদর বিদেশ থেকে আনা কমলা, মাল্টা, আপেল, নাশপতি, ডালিমের সঙ্গে বেশ পাল্লা দিয়েই বেড়ে চলছে। ক্রেতা-দোকানির কাছে আমদানি করা হলদে রঙের চেয়ে এ জেলার সবুজ মাল্টার কদর বেশি।

বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকা বারি মাল্টা-১ এর চাষাবাদের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী। সঠিক পদ্ধতিতে বারি মাল্টা-১ চাষ করলে অধিক লাভবান হওয়া যায়। শুষ্ক ও উষ্ণ জলবায়ু মাল্টা চাষের জন্য উত্তম। বায়ুর আর্দ্রতা এবং বৃষ্টিপাত ফলের গুণাগুণকে প্রভাবিত করে। অতি বৃষ্টিতে ফল বেশি রসালো হয়। মাল্টা প্রায় সব ধরনের মাটিতে জন্মে। তবে ছায়া পড়ে না এমন সুনিষ্কাশিত উর্বর, মধ্যম থেকে হালকা দো-আঁশ মাটি চাষের জন্য সবচেয়ে ভালো। মাটির অম্লত্ব ৫.৫ থেকে ৬.৫ হওয়া উত্তম। বীজ ও অঙ্গজ উভয় পদ্ধতিতে মাল্টার বংশবিস্তার হয়। তবে মাতৃগুণ বজায় রাখা, দ্রুত ফল ধরা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো এবং অধিক ফলন পেতে অঙ্গজ পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। জোড় কলম (গ্রাফটিং) ও চোখ কলমের (বাডিং) মাধ্যমে চারা উৎপাদন করা যায়।

মে থেকে আগস্ট মাল্টা গাছের চারা/কলম লাগানোর উত্তম সময়। তবে বছরের অন্যান্য সময়ে পানি সেচের ব্যবস্থা করা গেলে যে কোন সময় মাল্টার চারা/কলম লাগানো যাবে। চারা রোপণের জন্য ৭৫ সেমি দৈঘ্যে, ৭৫ সেমি’র প্রস্থ এবং ৭৫ সেমি গভীরতার ৩-৪ মিটার দূরত্বে গর্ত করে নিতে হবে।

মাল্টার বংশবিস্তার সাধারণত বীজ ও কলমের মাধ্যমে করা হয়। তবে আমাদের দেশের মাটি ও আবহাওয়া সাথে তাল মিলিয়ে বীজের চারা বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না বলে, কলমের মাধ্যমে চারা উৎপন্ন করা হয় নার্সারিগুলোতে। এছাড়াও কলমের মাধ্যমে উৎপন্ন চারা গাছে মাতৃ গাছের গুনাগুন বজায় থাকে ও দ্রুত ফল ধরে। এছাড়া রোগ প্রতিরোধী ও বলিষ্ঠ শিকড় সমৃদ্ধ আদি জোড়ের মাধ্যমে কলম করলে গাছের জীবনকাল ও ফলন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

বর্তমানে এই ফলটি বিশ্বের উষ্ণ ও অবউষ্ণমণ্ডলীয় এলাকায় বেশী চাষ হচ্ছে। কমলার তুলনায় এর অভিযোজন ক্ষমতা বেশী হওয়ায়, পাহাড়ি এলাকা ছাড়াও দেশের অন্যান্য এলাকায় সহজেই চাষ করা যাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকরা মাল্টা চাষের মাধ্যমে নিজেকে সাবলম্বী করার চেষ্টা করছে। উন্নত জাত নির্বাচন ও আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি ব্যবহার করে এর উৎপাদন বহুগুণে বাড়ানো সম্ভব।

পুষ্টিবিদদের মতে, এর প্রতি ১০০ গ্রাম ফলে (আহারোপযোগী) ২০০ মিলিগ্রাম ক্যারোটিন এবং ভিটামিন সি আছে প্রায় ৫০ মিলিগ্রাম। অন্য পুষ্টি উপাদানের মধ্যে শর্করা, আমিষ, চর্বি, ক্যালসিয়াম, লৌহ, ভিটামিন বি১, ভিটামিন বি২ এবং খাদ্যশক্তি রয়েছে যথাক্রমে ১২ মিলিগ্রাম, ১ মিলিগ্রাম, ০.২ মিলিগ্রাম, ৪০ মিলিগ্রাম, ০.৮ মিলিগ্রাম, ০.১১৩ মিলিগ্রাম, ০.০৪৬ মিলিগ্রাম এবং ২০০ কিলোক্যালরি।

সবুজ মাল্টার ঔষধিগুণ অনেক। সর্দিজ্বর কমাতে সবুজ মাল্টা বেশ উপকারী। এর খোসা দিয়ে প্রসাধনী তৈরি হয়। এছাড়া ওষুধ শিল্পেও ব্যবহার হয়। সবুজ মালটা তে অনেক চর্বি মুক্ত ক্যালারি বিদ্যমান এবং সবুজ মালটা তে ত্বকের বলীলতা রোধ করে লাবণ্য ধরে রাখে সাহায্য করে।

সবুজ মাল্টা ইনফেকশন পোজাও জনিত রোগ থেকে সারিয়ে তোলে। সবুজ মালটা তে রয়েছে ভিটামিন এ সি এবং পটাশিয়াম এবং এটি দাঁতের জন্য খুব উপকারী। তাই সবুজ মালটার উপকারিতা অনেক। জেনে নিন সবুজ মাল্টার স্বাস্থ্য উপকারিতা-

সবুজ মাল্টা ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল যা অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস মূহের সমৃদ্ধ উৎস। এটি ত্বকে সজীবতা বজায় রাখে এবং ত্বকের বলি রেখা প্রতিরোধ করে লাবণ্য ধরে রাখে। মাল্টা ইনফেকশন প্রতিরোধে সহায়তা করে। এটি প্রদাহ জনিত রোগ সারিয়ে তোলে।

সবুজ মাল্টার জুস কে ভিটামিন সি উৎস বলে মনে করা হয়। এটাকে ভিটামিন সি ট্যাবলেট হিসেবেও গ্রহণ করা যায়।

সবুজ মাল্টার ভিটামিন সি উপাদান আমাদের শরীরে ক্যানসার প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। এটি আমাদের শরীরের কোলন ক্যানসার ও ব্রেস্ট ক্যানসারের অন্যতম সেল প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে।

সবুজ মাল্টার মধ্যে থাকা পটাশিয়াম ইলেকট্রোলাইট ব্যালেন্স বজায় রাখে এবং কার্ডিওভাস্কুলার সিস্টেম ভালো রাখতে সহায়তা করে।

সবুজ মাল্টা পাকস্থলীকে সুস্থ রাখে। পাকস্থলীর আলসার ও কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে সুরক্ষা দেবে।

গবেষণায় জানা যায়,মাল্টাতে উপস্থিত লিমিণয়েড যা মুখ,ত্বক, ফুসফুস, পাকস্থলী কোমল ও স্তন ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়তা করে থাকে।

সবুজ মাল্টাতে উপস্থিত বিটা ক্যারোটিন সেল ড্যামেজ প্রতিরোধে সহায়তা করে। এতে উপস্থিত ক্যালসিয়াম, যা দাঁত ও হাড়ের গঠনে সাহায্য করে।

সবুজ মাল্টা খেলে দৃষ্টিশক্তি ভালো থাকে। কারণ, মাল্টায় রয়েছে ভিটামিন এ, সি ও পটাসিয়াম। এ ভিটামিনগুলো আমাদের দৃষ্টিশক্তির জন্য বেশ উপকারী।

ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, কারণ এতে থাকা ম্যাগনেসিয়াম এই কাজটি করে সবুজ মাল্টা । ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সহায়তা করে, ওজন কমাতেও সহায়তা করে।

জন্ডিস রোগ সারাতেও সবুজ মাল্টা খুবই কার্যকরী ভূমিকা পালন করে থাকে। জন্ডিস লিভারজনিত একটি রোগ। আর মাল্টা হলো খুবই সহজপাচ্য খাবার, খুব সহজেই এটা হজম করা যায়। এটি লিভারকে ঠান্ডা রাখতেও সাহায্য করে থাকে। লিভারের কার্যক্ষমতাকে স্বাভাবিক রাখতেও সাহায্য করে মাল্টা।

গর্ভবতী নারীদের জন্য সবুজ মালটা খুবই ভালো। এতে থাকা ভিটামিন সি গর্ভস্থ শিশুর মস্তিষ্ককে ত্বরান্বিত করতে সাহায্য করে থাকে। প্রবীণ মাতৃদুগ্ধদানকারী মহিলাদের নিয়মিত মাল্টা খাওয়া উচিত, কারণ এতে দেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যায়।

সর্দি, নাক বন্ধ থাকা, টনসিলের সমস্যা, গলাব্যথা, জ্বর জ্বর ভাব, হাঁচি-কাশি, মাথাব্যথা, ঠান্ডাজনিত দুর্বলতা-এজাতীয় সমস্যাগুলো দূর করে সবুজ মাল্টা।

(ঢাকাটাইমস/০২ নভেম্বর/আরজেড)

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
নওগাঁর রাণীনগরে ট্রেনে কাটা পড়ে বাবা-মেয়ের মৃত্যু
আলফাডাঙ্গায় ইসকন নিষিদ্ধের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল
পিলখানা হত্যাকাণ্ড: স্বাধীন কমিশন বিষয়ে অপূর্ণাঙ্গ তথ্য দেওয়ায় হাইকোর্টের উষ্মা
আয়ারল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করতে বাংলাদেশের লক্ষ্য ১৮৬ রান
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা