রাজধানীতে ছিনতাই আতঙ্ক 

সিরাজুম সালেকীন, ঢাকা টাইমস
  প্রকাশিত : ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৫৩
অ- অ+

২৪ ডিসেম্বর রাত পৌঁনে ১০টা। রাজধানীর মতিঝিলে নিজ কর্মস্থল থেকে বাসায় ফিরছিলেন দৈনিক ইনকিলাবের সাংবাদিক মাইনুল হাসান সোহেল। এ সময় ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) এই সাধারণ সম্পাদক। তার ওপর হামলা করে মুঠোফোন ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারীরা। তাদের হামলায় তার হাত ও পায়ে জখম হয়।

দিন ছয়েক আগে ১৮ ডিসেম্বর রাতে মতিঝিলের কাছাকাছি মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে নিহত হন একজন হাফেজ। রাত নয়টার দিকে হাফেজ কামরুল হাসান হেঁটে সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ডে যাচ্ছিলেন।

বেশ কিছুদিন ধরে রাজধানী ঢাকায় ছিনতাইকারীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তাতে আতঙ্ক ছড়িয়েছে রাজধানীবাসীর মধ্যে।

বিশেষ করে রাজধানীর প্রবেশপথগুলো এবং মোহাম্মদপুর, হাজারীবাগ, মিরপুর, হাতিরঝিল, শাহজাহানপুর, খিলগাঁওসহ বিভিন্ন এলাকা ছিনতাইয়ের হটস্পটে পরিণত হয়েছে। সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত সাধারণ মানুষকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে অপরাধ কার্যক্রম সংঘটিত হচ্ছে এসব স্পটে।

ছিনতাইকারীদের বেপরোয়া আচরণে প্রায়ই গুরুতর আহত এমনকি প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। সড়ক ও অলিগলিতে নির্বিঘ্নে চলতে ভয় পাচ্ছেন মানুষ। গত বৃহস্পতিবার ঢাকার কেরানীগঞ্জে ব্যাংকে ডাকাতির চেষ্টা হয়। এ ঘটনায় জড়িতরা বয়সে কৈশোর উত্তীর্ণ।

এমন পরিস্থিতিতে ভুক্তভোগী ও নগরবাসী প্রশ্ন তুলছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে। ছিনতাই রোধে পুলিশ নানান পদক্ষেপের কথা জানালেও কমেনি ছিনতাই।

ছিনতাই বেড়ে যাওয়ার পেছনে কারও কারও বক্তব্যে কিছু কারণ সামনে আসছে। সূত্র বলছে, রাজধানীর থানাগুলোতে যেসব কর্মকর্তা (ওসি, এসআই, এএসআই) বর্তমানে কর্মরত আছেন, তাদের প্রায় সবাই নতুন। তারা ঢাকার অলিগলি চেনেন না। আবার এলাকাভিত্তিক অপরাধীদের নিয়েও তেমন কোনো তথ্য নেই তাদের কাছে। ফলে অপরাধী শনাক্তে বেগ পেতে হচ্ছে পুলিশকে।

এরই সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা। ছিনতাই ও ডাকাতির মতো ঘটনা বাড়ার এটি বড় কারণ। এ ছাড়া ৫ আগস্টের ধাক্কার পর পুলিশি কার্যক্রম এখনো পুরোদমে স্বাভাবিক হয়নি।

বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার ৫০টি থানা এলাকায় গত দুই মাসে (১ নভেম্বর থেকে ২৪ ডিসেম্বর) ৪০টি ছিনতাইয়ের মামলা হয়েছে। সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন শতাধিক ভুক্তভোগী। এ সময়ে ছিনতাইকারীদের হাতে নিহত হন দুজন। গুরুতর আহত হন অন্তত পাঁচজন। আর গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন থেকে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিনতাইকারীদের হাতে সাতজন নিহত হন।

ডিএমপির তেঁজগাও বিভাগের একজন পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন) নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘থানায় এখনো পুলিশ সদস্য ও অফিসারের ঘাটতি আছে। ক্ষেত্রবিশেষে দুজন কনস্টেবল ও একজন এসআই বা এএসআই দিয়ে ডিউটি করাতে হচ্ছে। তাদের অনেকে আবার রাজধানীতে নতুন। তাই অপরাধী শনাক্ত বা তাদের ধরতে পারছে না পুলিশ। তাছাড়া রাতে ও ভোরে সড়কে পুলিশের কম উপস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা।’

গত শনিবার ডিএমপি কমিশনার সাজ্জাত আলী এক অনুষ্ঠানে রাজধানীতে ছিনতাইকারী বেড়েছে বলে স্বীকার করেন। তিনি সেদিন ছিনতাইয়ের বিরুদ্ধে পুলিশের সাঁড়াশি অভিযানের ঘোষণা দেন। এরপরই ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে এক দিনে শতাধিক ছিনতাইকারী আটক হয়। এখনো চলছে পুলিশের অভিযান।

কমিশনারের ঘোষণার পর এখন পর্যন্ত দুই শতাধিক ছিনতাইকারী আটক হয়। তবে ছিনতাইয়ে জড়িত অনেকে জামিনে বেরিয়ে আবার অপকর্ম করছে বলে জানায় পুলিশ।

ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘ঢাকায় ছিনতাইকারীদের থাকতে দেওয়া হবে না। পুলিশকে বলা হয়েছে যারা এই অপকর্মে জড়িত, তাদের আইনের আওতায় আনতে। সেই অনুযায়ী থানা পুলিশ কাজ করছে।’ দ্রুতই এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে নগরবাসীকে আশ্বস্ত করতে চান কমিশনার।

ডিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি, মিডিয়া) তালেবুর রহমান ছিনতাই ও ডাকাতি রোধে অভিযান অব্যাহত থাকার কথা জানান।

এদিকে র‌্যাব জানায় গত ৫ আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১০৩ জন ছিনতাইকারী গ্রেপ্তার করে তারা। এর মধ্যে সেপ্টেম্বর পাঁচজন, অক্টোবরে ৬১ ও নভেম্বর ৩৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য বলছে, চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনায় রাজধানীর বিভিন্ন থানায় গত আগস্ট থেকে নভেম্বর ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৬৫টি, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে দুটি কম।

তবে পুলিশের এই পরিসংখ্যানের চেয়ে বাস্তবে অপরাধ আরও বেশি ঘটছে বরে জানা যায়। অনেক ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা চুরি ও ছিনতাইয়ের ঘটনায় থানায় অভিযোগ করেন না। শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে কাস্টমসের একজন কর্মকর্তার বাসার আসবাব তার বন্ধু ট্রাকে নিয়ে আসার পথে যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়ায় ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। ১২ থেকে ১৫ জনের একটি ছিনতাইকারী দল তাকে ছুরিকাঘাত করে টাকা ও মালামাল নিয়ে যায়। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী কোনো মামলা করেননি।

আইনশৃঙ্খল বাহিনী বলছে, ঢাকার প্রবেশপথগুলো সব সময় টার্গেট করে থাকে অপরাধীরা। বিশেষ করে সড়ক, রেল ও নৌপথে সন্ধ্যা কিংবা ভোররাতে ঢাকায় ফেরা নগরবাসী ছিনতাইয়ের শিকার হন বেশি।

অবাধ বিচরণ অপরাধীদের

গত ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আসাদগেট এলাকায় যানজটে স্থবির সড়কে চাপাতি হাতে তিন যুবককে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। একপর্যায়ে তাদের একজন একটি প্রাইভেটকারের খোলা জানালা দিয়ে মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে সটকে পড়ে। মহসিন নামে একটি ফেসবুক আইডি থেকে সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

গত ২৩ অক্টোবর মোহাম্মদপুরের মোহাম্মদীয়া হাউজিং লিমিটেড এলাকায় বেসরকারি খাদ্যপণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নেসলের গাড়ি থামিয়ে ১২ লাখ টাকা ও ব্যাংকের চেক বই ছিনিয়ে নেয় একদল ছিনতাইকারী।

দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার ফটোসাংবাদিক নাঈমুর রহমান ১৩ নভেম্বর রাত সাড়ে ৯টার দিকে মোহাম্মদপুর বসিলার তিন রাস্তার সামনে চার অস্ত্রধারীর কবলে পড়েন। তার কাছ থেকে সাত হাজার টাকা, একটি নাইকন ডিএসএলআর ক্যামেরা, একটি নাইকন ক্যামেরার লেন্স, একটি মোবাইল ফোন নিয়ে যায় তারা। এ ঘটনায় তিনজন ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

২২ নভেম্বর ভোরে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সামনে ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন পুলিশের কনস্টেবল সোহেল। এই পুলিশ সদস্যের পেটে ছুরি চালিয়ে মুঠোফোন ও মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারী।

১৫ ডিসেম্বর মগবাজার ওয়ারলেস এলাকায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আহত ক্যাটারিং কোম্পানির কর্মচারী মো. হাবিব মারা যান। ঘটনার দিন ভোরে গ্রাম থেকে মগবাজার ওয়ারলেসে এসে ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন তিনি। তার কাছ থেকে টাকা ও মোবাইল ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে হাবিব বাধা দেন। এ সময় তার মাথায় ও শরীরে ছুরিকাঘাত করে ছিনতাইকারীরা।

পটপরিবর্তনের পর মোহাম্মদপুরের পরিবেশ বেশি খারাপ হয়েছে। দিনে-দুপুরে বড় আগ্নেয়াস্ত্র হাতে গোলাগুলি বা রামদা-চাপাতি হাতে প্রকাশ্যে ছোটাছুটি বেড়েছে। কখনো ভোরে, কখনো দিনে-দুপুরে ফাঁকা সড়কে ছিনতাই, কখনো বসে থাকা মানুষদের কোপানো হচ্ছে। ২০ অক্টোবর নবোদয় হাউজিংয়ের বি ব্লকের ৪ এ সড়কে তরুণীকে ঘিরে ধরে ছিনতাইয়ের একটি দৃশ্য সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়।

গেল সাড়ে চার মাসে মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্প ও আশপাশের এলাকায় সাতটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এছাড়া ক্যাম্পে প্রায় দিন বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে গোলাগুলি ঘটেছে। পুলিশ, র্যাব ও সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযানে অপরাধীরা ধরা পড়ছে। তবে এখনো সংঘটিত হচ্ছে নানা অপরাধ।

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ওমর ফারুক বলেন, ‘বাজারে দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতির পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মনোবলেও চিড় ধরেছে। এরই সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা। এছাড়া ৫ আগস্টের পর বিভিন্ন থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র ছিতাইনকারীরা ব্যবহার করছে।’

চুরি-ছিনতাই বেড়ে যাওয়ায় অপরাধপ্রবণ এলাকা শনাক্ত করে র‌্যাবের গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে বলে জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল মুনীম ফেরদৌস। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘চিহ্নিত এলাকায় র্যাবের টহল কার্যক্রম ও নিরাপত্তা চৌকি বাড়ানো হয়েছে। মধ্যরাত ও ভোরে বাস টার্মিনালসহ ঢাকার প্রবেশপথে চুরি-ছিনতাই রোধে আমরা কাজ করছি।’

(ঢাকাটাইমস/২৭ডিসেম্বর/কেএ)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
সাম্য হত্যার বিচার না হলে সারা দেশ অচল করে দেওয়া হবে, হুঁশিয়ারি ছাত্রদলের 
ঝালকাঠিতে সার্ভেয়ারকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ চাচাতো ভা্ইয়ের বিরুদ্ধে
বায়রা সদস্যদের ওপর হামলার ঘটনায় দোষীদের আইনের আওতায় আনার দাবি
চাঁপাইনবাবগঞ্জে বজ্রপাতে তিনজনের মৃত্যু, মারা গেছে তিনটি গরু
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা