বিএনপির দুই পক্ষের দ্বন্দ্বে বন্ধ হলো ২০০ বছরের কাটাগড়ের মেলা

ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে স্থানীয় বিএনপির অন্তর্কোন্দল ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বন্ধ হয়ে গেল আধ্যাত্মিক সাধক দেওয়ান শাগের শাহ (রহ.) স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক কাটাগড়ের মেলা।
ফকির-সন্ন্যাসীদের মিলনমেলা খ্যাত এই মেলাটি ২০০ বছর ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। প্রতি বছর ১২ চৈত্র দেওয়ান শাগের শাহ (রহ.) তিরোধান দিবস উপলক্ষে তিন দিনব্যাপী ওরস, ঘোড়দৌড় ও গ্রামীণ মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন ও বৈশ্বিক মহামারি করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে দুই বছর বন্ধ ছিল মেলাটি। এছাড়া এবারই প্রথম দলীয় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বন্ধ হলো ঐতিহাসিক এ মেলা।
স্থানীয়রা জানান, ৫ আগস্ট পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ বছর মেলাটির নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া হয়ে উঠে স্থানীয় বিএনপির দুটি গ্রুপ। মেলা আয়োজনে পৃথক দুটি কমিটি গঠন করে বিভক্ত দুই গ্রুপই মেলার অনুমোদন চেয়ে প্রশাসনের নিকট আবেদন করেন। সম্প্রতি এ নিয়ে স্থানীয়ভাবে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে বিবদমান দুই গ্রুপ। সংঘর্ষে দুই গ্রুপের ১২-১৪ জন আহত হয়। সংঘর্ষের ঘটনায় পৃথক দুটি মামলা করেন তারা।
এছাড়াও বিবদমান গ্রুপগুলো পৃথক সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করায় এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে এ বছর মেলাটির অনুমতি দেননি প্রশাসন। তবে মাজারকেন্দ্রিক ফকির-সন্ন্যাসীদের অবস্থান, জিকির, ধ্যান, জপ, ভক্তিমূলক সংগীত পরিবেশন ও ভক্তদের আগমন, শ্রদ্ধা নিবেদন চলবে প্রতিবছরের ন্যায়।
এলাকাবাসী ও স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, দেওয়ান শাগির শাহ’র বার্ষিক ওরস উপলক্ষে গ্রামীণ মেলাটি আগামী ২৫ মার্চ থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত অনুমোদনের জন্য রূপাপাত ইউনিয়নের বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলী আক্কাচ মন্টু ও উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য আনিচুর রহমান টিটু ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক বরাবর গত ৫ মার্চ আবেদন করেন। অপরদিকে ১৬ মার্চ সাতদিনের অনুমোদনের জন্য জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করেন কাটাগড় দেওয়ান শাগির শা’র মাজারের খাদেম ইরাদত ফকির।
জানা যায়, উপজেলার রুপাপাত ইউনিয়নের কাটাগড়ে অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে আস্তানা গাড়েন আধ্যাত্মিক সাধক দেওয়ান শাগীর শাহ (রহ.)। সে সময় থেকেই দেশ-বিদেশের ফকির-সন্ন্যাসীরা তার সান্নিধ্যে আসা শুরু করে। নড়াইলের জমিদার কালি শঙ্কর রায় এই আধ্যাত্মিক সাধকের ভক্ত ছিলেন বলে দাবি করেছেন বেশ কয়েকজন আঞ্চলিক ইতিহাস সংগ্রাহক, সে হিসেবে দুইশ বছরের কিছু কমবেশি এ মেলার ইতিহাস।
আনুষ্ঠানিকভাবে তিনদিনের মেলা হলেও প্রতিবছর ৭ থেকে ৮ দিন ধরে চলে এ মেলা। নাড়ির টানে এ প্রাণের মেলায় আশপাশের এলাকার মানুষ ছুটে আসেন। এ সময় আশপাশের ৮-১০টি গ্রামে ঈদের আনন্দ বয়ে যায়। দূর-দূরান্ত থেকে বেড়াতে আসে আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব। ১২ চৈত্রে এ মেলা শুরু হলেও সপ্তাহ খানেক আগে থেকেই বসতে শুরু করে বিভিন্ন রকম দোকান-পসরা। হোটেল, মিষ্টির দোকান। চিনির তৈরি নানা নকশার সাজ-বাতাসা, রসগোল্লা বালিশ মিষ্টিসহ নানাপদ মিষ্টির সমাহার এ মেলার প্রধান আকর্ষণ। এ ছাড়া নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দোকান, পোশাক, কসমেটিক, খেলনা, কাঠের তৈরি খাট-পালঙ্ক, ফার্নিচার, মাটি ও বেতের তৈরি জিনিসপত্রে কয়েক হাজার দোকান বসে। মেলা উপলক্ষে বোয়ালমারী, আলফাডাঙ্গা, মধুখালী, কাশিয়ানী, মুকসুদপুর, সালথা, নগরকান্দা উপজেলার লাখো মানুষের সমাগম ঘটে। ইতোমধ্যে যে সকল দোকানপাট আসছে স্থানীয়দের কাছে মেলা বন্ধের খবর শুনে তারা চলে যাচ্ছেন বলে জানালেন আয়োজক কমিটির একাংশের সাধারণ সম্পাদক আজাদ মোল্যা।
মেলাটির আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক ও মাজারের খাদেম মো. ইরাদত ফকির জানান, শত শত বছর যাবত কাটাগড় ঐতিহ্যবাহী মেলা হয়ে আসছে। বংশ পরম্পরায় আমরা এ মাজার ও মেলার আয়োজন করি দলমত নির্বিশেষে স্থানীয়দের নিয়ে। এ বছর গ্রামের মানুষের মধ্যে অন্তর্কোন্দলে মারামারি, মামলা হয়েছে। অনেকেই জেলে আছে আবার অনেকেই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে। প্রশাসন জানিয়েছিলেন যদি আপনারা দুই গ্রুপ মিলেমিশে মেলায় আসতে পারেন তাহলে অনুমতি দেওয়া যেতে পারে।
রূপাপাত ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আজিজার রহমান মোল্যা বলেন, ৫০ বছর ধরে সবাইকে নিয়ে মেলা করে আসছি। এ বছর বিএনপির লোকজনের মেলার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ঝগড়া বিবাদ, হামলা মামলার জন্য মেলাটি বন্ধ হয়ে গেছে। যা অত্যন্ত দুঃখজনক ও নিন্দনীয়। যতদূর জেনেছি দুই গ্রুপ এক হওয়ার কোনো সুযোগ নেই, এখনও সময় আছে ঐতিহ্যের স্বার্থে, এলাকার সুনামের স্বার্থে এক হয়ে মেলাটির আয়োজন করুন।
শেখর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ইসরাফিল মোল্যা বলেন, এ মেলাটি আমাদের এলাকার ঐতিহ্য, এটা শুধু মেলা নয়, এর সাথে সামাজিক মর্যাদা, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সম্পৃক্ত। এলাকার হাজার হাজার মানুষ এ মেলাকে কেন্দ্র করে, ব্যবসা-বাণিজ্য করে লাখ লাখ টাকা আয় করে থাকেন। নিজেরা নিজেরা কোন্দল করে আজ সে পথটি রুদ্ধ করে দেওয়া হলো।
এ ব্যাপারে বোয়ালমারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাহমুদুল হাসান বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে সব কিছু জানানো হয়েছে। অনুমতির বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষই দেখবেন।
বোয়ালমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তানভীর হাসান চৌধুরী বলেন, মেলা অনুষ্ঠিত হওয়ার বিষয় আমাদের কোনো আপত্তি নেই, যেহেতু এ নিয়ে ওই এলাকায় দ্বন্দ্ব-সংঘাত হয়েছে তাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আমরা অনুমতি দিচ্ছি না। তবে দুই পক্ষ এক হয়ে এলে বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। মাজারকেন্দ্রিক ওরস ও ভক্তদের ভক্তি-শ্রদ্ধা নিবেদনে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো বাধা নেই।
(ঢাকা টাইমস/২৪মার্চ/এসএ)

মন্তব্য করুন