মশার কামড়ে সৃষ্টি হয় যেসব ভয়ংকর রোগ

স্বাস্থ্য ডেস্ক, ঢাকাটাইমস
  প্রকাশিত : ২৭ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:৫৪
অ- অ+

ক্ষুদ্র প্রাণি মশা ছোট মাছি প্রজাতির পতঙ্গ। এই ছোট মাছি প্রজাতির পতঙ্গ দীর্ঘ ২৫০০ বছর ধরে পৃথিবীর বুকে টিকে আছে। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ৩,৫০০ এর বেশি প্রজাতির মশা পাওয়া গেছে। যেসব মশা নিয়মিত মানুষকে কামড়ায় তারা প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষের শরীরে রোগজীবাণু সংক্রমণের চলক হিসেবে কাজ করে।

মশার দাঁত সংখ্যা ৪৭টি। মশা কামড়ায়, হুল ফোটায় না। মশা তার লম্বা প্রোবোসিসের মাধ্যমে মানুষের ত্বকের ভেতর সুঁইয়ের মতো করে প্রবেশ করে এবং রক্ত চুষে নেয়। এই প্রক্রিয়াটিকে কামড় বলা হয়। মশা কামড়ানোর সময় একটি ব্যথানাশক তরলও শরীরে প্রবেশ করায়, ফলে কামড়ানোর সময় তেমন অনুভূতি হয় না।

মশা কিন্তু রক্ত খেয়ে বেঁচে থাকে না! মূলত রক্তের প্রোটিন অংশটি কাজে লাগিয়ে তারা ডিম পাড়ে। তাইতো পুরুষ মশা কখনো হুল ফোটায় না।

পুরুষ মশা কেবল একদিন বাঁচে। নারী মশা সচরাচর ৬-৮ সপ্তাহ বেঁচে থাকে। আর পুরুষ মশা একদিনের বেশি বাঁচলেও; তাদের পরিস্থিতি একেবারেই নাজুক হয়ে পড়ে।

অধিকাংশ প্রজাতির স্ত্রীমশা স্তন্যপায়ী প্রাণীর রক্ত পান করে থাকে। মেরুদণ্ডী প্রাণীর, যেমন স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখি, সরীসৃপ, উভচর প্রাণী এবং এমনকি কিছু মাছের শরীর থেকে রক্ত শোষণ করে হাজার রকমের প্রজাতি রয়েছে। যদিও যেসব প্রাণীর শরীর থেকে রক্ত শুষে নেয় তা তাদের শরীরের তুলনায় খুবই অল্প, কিন্তু কিছু মশা রোগজীবাণু সংক্রামক। মশার মাধ্যমে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, ফাইলেরিয়া, পীতজ্বর, জিকা ভাইরাস প্রভৃতি রোগ সংক্রমিত হয়ে থাকে।

অন্য যেসব প্রজাতি নিয়মিত মানুষকে কামড়ায় না, কিন্তু অন্যান্য প্রাণীদের শরীরে রোগ সংক্রমণের চলক, তারা মূলত বিভিন্ন কারণে, যেমন হঠাৎ বন ধ্বংস, তাদের বাসস্থান থেকে উৎখাত হলে ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। অ্যানোফিলিস, কিউলেক্স, এডিস, হেমাগোগাস, প্রভৃতি হল রোগ সংক্রমণের চালক হিসেবে কাজ করা মশাদের বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ও সাধারণভাবে সবচেয়ে পরিচিত।

ছোট্ট এই প্রাণীটি কারণে কত ভয়ংকর রোগের হতে পারে তা হয়তো অনেকেই জানেন না। এ প্রতিবেদনে তুলে ধরা হলো মশার কামড়ে সৃষ্টি হয় এমন কিছু ভয়ংকর রোগ।

ডেঙ্গু

সাধারণত উষ্ণমন্ডলীয় দেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি দেখা যায়। জিকা বা চিকনগুনিয়ার মতো স্ত্রী এডিস মশার মাধ্যমে এই রোগ ছড়ায়। উচ্চমাত্রায় জ্বর, তীব্র মাথাব্যথা (মাথার সামনের অংশে), চোখের পেছনে ব্যথা, মাংসপেশীতে ও হাড়ের সংযোগস্থলে ব্যথা, র‍্যাশ, বমি বমি ভাব, বিতৃষ্ণাবোধ ইত্যাদি এই রোগের উপসর্গ। ডেঙ্গু জ্বর প্রাণঘাতী হতে পারে।

লা ক্রস এনসেফালাইটিস

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কিছু নির্দিষ্ট অরণ্যাঞ্চলে এমন এক বিরল ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে, যা মশার কামড়ে মানুষের মস্তিষ্কে ভয়াবহ প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে। ভাইরাসটির নাম লা ক্রস ভাইরাস। একবার শরীরে প্রবেশ করলে এটি সোজা পৌঁছে যেতে পারে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে, এমনকি আক্রান্ত করতে পারে নিউরনকে। যে সমস্ত মশা গাছের কোটরে জন্ম নেয় তাদের কাছে থেকে এই রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা বেশি। বয়স্করা এই রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভবনা থাকলেও ১৬ বছরের নিচের বাচ্চাদের জন্য এই রোগ অত্যন্ত ভয়ংকর। আটলান্টিক মহাসগরের দক্ষিণ পাড়ের দেশগুলোতে এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়। এই রোগের উপসর্গ হিসেবে আক্রান্ত ব্যক্তির জ্বর ও বমি বমি ভাব হয়। তবে দীর্ঘ মেয়াদে এই রোগে ভুগলে আক্রান্ত ব্যক্তি শারীরিকভাবে বিকলঙ্গ হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে।

জিকা

সম্প্রতি কালে মশাবাহিত ভয়ংকর রোগগুলোর মধ্যে জিকা অন্যতম। জিকা ভাইরাস যে রোগ সৃষ্টি করে তার নাম জিকা জ্বর। এর উপসর্গগুলো হলো জ্বর, মাথাব্যথা, অবসাদগ্রস্ততা, অস্থিসন্ধিতে ব্যথা, পেশীতে ব্যথা, শরীরে লালচে দাগ বা ফুসকুড়ি ইত্যাদি। এই ভাইরাসের কারণে মারাত্মক জটিলতা হয় গর্ভস্থ শিশুর, ছোট আকৃতির মাথা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। এই রোগের প্রাদুর্ভাব আমাদের দেশে তুলনামূলক কম।

ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস

এটি মশাবাহিত একটি ভয়ংকর রোগ। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি স্নায়ুবিকভাবে দুর্বল হয়ে পুঙ্গ হয়ে যেতে পারে। এই রোগের ভীতিকর দিকটি হলো, এটি কোনো প্রকার উপসর্গ ছাড়াই দেখা দেয়। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি বুঝতেই পারে না যে তিনি ওয়েস্ট নাইল ভাইরাসে আক্রান্ত। এই রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।

ওয়েস্টার্ন ইকুয়িন ইনসিপহালিটিস

কিউলেক্স মশার কামড়ে এই রোগ হয়। জ্বর, মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব ইত্যাদি এই রোগের উপসর্গ। সাধারণত বয়স্ক লোকেরা এই রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। পৃথিবীর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি এই রোগী দেখা যায়। তবে সংখ্যার বিচারে তা একেবারেই নগণ্য। ১৯৬৪ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত এই রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা মাত্র ৭০০ জন।

চিকনগুনিয়া

আফ্রিকা মহাদেশে এই রোগ বেশি হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আফ্রিকার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এই রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দক্ষিণ এশিয়ায়ও বেড়ে চলেছে। ডেঙ্গু ও জিকার ভাইরাস বহনকারী মশা এই রোগের কারণ। উপসর্গও ডেঙ্গুর মতো। তবে এই রোগে আক্রান্ত রোগী হাড়ের সংযোগস্থলে তীব্র ব্যথা অনুভব করে। রোগটির কোনো প্রতিষেধক নেই।

ইয়োলো ফিভার

এর লক্ষণগুলো জন্ডিসের মতো। এই রোগ হলে সারা শরীর হলুদ রঙের হয়ে যায় এবং তীব্র জ্বর ও বমি বমি ভাব থাকে। আফ্রিকান দেশগুলোতে এই রোগ বেশি হয়ে থাকে।

লিমফেটিক ফাইলেরিয়াসিস

মশাবাহিত রোগের মধ্যে লিমফেটিক ফাইলেরিয়াসিস কম পরিচিত হলেও এটি খুব ভয়ংকর। রোগটি ফাইলেরিয়া ধরনের একটি মারাত্মক ইনফেকশন, যার প্রভাবে মানুষের পা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক গুণ ফুলে ভারী হয়ে ওঠে। আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা এবং প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম তীরবর্তী অঞ্চলে এই রোগের প্রাদূর্ভাব বেশি দেখা যায়।

জাপানি এনসেফালাইটিস

এ রোগ ছড়ানোর জন্য দায়ী কিউলেক্স মশা বাড়ির চারপাশের জলাভূমি ও স্থির পানি কিংবা কৃষি জমিতে জন্ম নেয়। মানবদেহে সংক্রমণের পর রোগটি কেন্দ্রীয় নার্ভ সিস্টেমে প্রবেশ করে। এছাড়া জ্বর, মাথা ব্যাথা ও বমি বমি ভাব হয়। এশিয়া এবং পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়।

সেন্ট লুইস এনসেফালাইটিস

কিউলেক্স মশাবাহিত একটি ভয়ংকর রোগ এটি। যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমের রাজ্যগুলোতে এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়। উপসর্গ হিসেবে জ্বর, মাথা ব্যাথা ও বমি বমি ভাব ইত্যাদি হয়ে থাকে। তবে এর তীব্রতা বাড়লে আক্রান্ত ব্যক্তি কয়েকদিনের জন্য সম্পূর্ণ অচেতন হয়ে যেতে পারে। শিশুদের তূলনায় বয়স্করা এই রোগের ঝুঁকিতে বেশি থাকে। রোগটির কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি।

ইস্টার্ন ইকুয়িন ইনসিপহালিটিস

যুক্তরাষ্ট্রের মশাবাহিত রোগের মধ্যে ইস্টার্ন ইকুয়িন ইনসিপহালিটিস অন্যতম। আমেরিকার ফ্লোরিডা, জর্জিয়া এবং নিউ জার্সিতে এই প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়। এই রোগে আক্রান্ত এক-তৃতীয়াংশ লোক মারা যায় এবং যারা রোগ আক্রান্ত হওয়ার পর বেঁচে যায় তাদের মস্তিস্কে সমস্যা দেখা দেয়। এই রোগের কোনো প্রতিষেধক নেই।

ভেনিজুয়েলা ইকুয়িন ইনসিপহালিটিস

উপসর্গ এবং ফলাফলের দিক দিয়ে এটি ইস্টার্ন ইকুয়িন ইনসিপহালিটিস গোত্রের রোগ। তবে এই রোগ গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রে বেশি ক্ষতিকর। কারণ এর ফলে অকালে গর্ভপাত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। দক্ষিণ এবং মধ্য আমেরিকায় এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়।

সাবধানতা

মশাবাহিত ভাইরাস থেকে নিজেকে রক্ষার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো মশার কামড় এড়ানো। এজন্য রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র বলছে: বাইরে গেলে লম্বা হাতা জামা ও ফুলপ্যান্ট পরুন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত মশারোধী স্প্রে ব্যবহার করুন। বাড়ির চারপাশে যেকোনো স্থায়ী পানি জমে না থাকে, তা নিশ্চিত করুন। মশার কামড় থেকে সাবধানে থাকুন কারণ এর ফলাফল হতে পারে প্রাণঘাতী। সচেতনতা এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়াই হতে পারে সবচেয়ে বড় সুরক্ষা।

(ঢাকাটাইমস/২৭ এপ্রিল/আরজেড)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
শিক্ষার্থীদের সভা-সমাবেশ ও মিছিলে অংশগ্রহণ বন্ধের নির্দেশ, হচ্ছে আলোচনা-সমালোচনা
উত্তরায় প্রাইভেটকারসহ দুই অপহরণকারী গ্রেপ্তার
প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে নতুন ঘর পেল চার জেলায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ৩০০ পরিবার
ঈদের আগেই আসছে নতুন নোট, নকশায় থাকছে জুলাই অভ্যুত্থানের গ্রাফিতি
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা