চট্টগ্রাম বন্দর আধুনিকায়নে দেশের স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে: কর্নেল অলি

লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) প্রেসিডেন্ট খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. কর্নেল অলি আহমদ বীর বিক্রম (অব.) বলেছেন, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১৯টি দেশের মধ্যে সমুদ্রবন্দরে আমদানি পণ্য খালাসের প্রক্রিয়া শেষ করতে সবচেয়ে বেশি সময় লাগে পাকিস্তানে। এক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর। চট্টগ্রাম বন্দরের সার্বিক অব্যবস্থাপনার বিষয়টি বহুল আলোচিত। আমদানিকারকরা তাদের আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আমদানি করা পণ্যের দামও বাড়িয়ে দেন। এতে ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হন। যেহেতু দেশের সিংহভাগ পণ্যের আমদানি-রপ্তানি হয় এ বন্দর দিয়ে, সেহেতু বন্দরের অব্যবস্থাপনা দূর করতে দেরি হলে দেশের উন্নয়নে এর প্রভাব পড়বে। এ বন্দরের গতিশীলতা বৃদ্ধির পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি সড়ক অবকাঠামোর উন্নয়নসহ অন্যান্য দিকেও দৃষ্টি দিতে হবে। বন্দর নিয়ে যে পদক্ষেপই নেওয়া হোক না কেন, দেশের স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করা হবে, এটাই প্রত্যাশা।
শনিবার গণমাধ্যম বিষয়ক উপদেষ্টা সালাহ উদ্দীন রাজ্জাক স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে তিনি এসব কথা বলেন।
এলডিপির প্রেসিডেন্ট বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর এবং বৃহত্তম বন্দর। দেশের প্রায় ৯৯ শতাংশ কনটেইনার এবং ৯৩ শতাংশ আমদানির-রপ্তানি কার্যক্রম এই বন্দরের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়ে থাকে। যদিও বাংলাদেশে আরও দুইটি সমুদ্র বন্দর রয়েছে তথাপিও এটি বাংলাদেশের একমাত্র বন্দর বললে অত্যুক্তি হবে না।
কর্নেল অলি বলেন, বাংলাদেশের ৯২ শতাংশ বৈদেশিক বাণিজ্য এবং তার ৯৮ শতাংশ নিউ মুরিং কনটেইনার টার্মিনাল দিয়ে সম্পন্ন হয়। প্রাকৃতিক কারণে ২০০ মিটারের বেশি দৈর্ঘ্যের জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়তে পারে না। এ কারণে বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশ প্রতিদিন প্রায় ১০ লাখ ডলারের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দরকে আন্তর্জাতিক মানের বন্দরে উন্নীত করতে অন্তর্বর্তী সরকার বিশ্বের খ্যাতিমান বন্দর ব্যবস্থাপনা সংস্থাগুলোকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। যদি সরকারের পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়িত হয়, তাহলে দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
তিনি বলেন, চলতি অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৬.৩৩ শতাংশ বেড়েছে, যা অব্যাহত অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্যে ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষণ দেখাচ্ছে। ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে পণ্য আমদানি হয়েছে ৭.৮৭ কোটি টন। গত অর্থবছরের একই সময়ে পণ্য আমদানি হয়েছিল ৭.৪০ কোটি টন। এই সময়ে এসব আমদানি পণ্যের শুল্কায়নযোগ্য মূল্য দাঁড়িয়েছে ৪.২৩ লাখ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের ৩.৭০ লাখ কোটি টাকার তুলনায় ১৪.৩৫ শতাংশ বেশি।
কর্নেল অলি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের মূল অংশে ১২টি জেটি (বার্থ) রয়েছে। এই ১২টি জেটিতে ১২টি প্রাইভেট বার্থ অপারেটর পণ্য উঠানামার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। কিন্তু এর সকল স্থাপনা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্তৃক তৈরি করা হয়েছে। এছাড়াও চট্টগ্রাম বন্দরের দুটি টার্মিনাল রয়েছে। যথাক্রমে চট্টগ্রাম কনটেইনার টার্মিনাল (সিসিটি) এবং নিউ মুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি), এই দুইটি টার্মিনালও একটি প্রাইভেট অপারেটর কর্তৃক পরিচালিত হয়। তাছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরে বিশেষ করে কনটেইনার হ্যান্ডলিং এর জন্য যে সকল যান্ত্রিক উপকরণ ব্যবহৃত হয় তাও বেশ পুরোনো ধরনের।
তিনি আরও বলেন, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে তাল মিলিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ তাদের নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের আমদানি রপ্তানি কার্যক্রমকে সহায়তা করে আসছে। যেমন ২০১০ সালে বাংলাদেশের সমগ্র রপ্তানি পরিমাণ ছিল প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার। আর ২০২৪ সালে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় আড়াইশো গুণ। এই আড়াইশো গুণ রপ্তানি চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমেই সম্পাদিত হয়েছে। তবে এই সময়ের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরে তেমন কোন উন্নত আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন বা উল্লেখযোগ্য কোন ইনফ্রাস্ট্রাকচার তৈরি করা হয়নি। বন্দরের দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমেই এই বর্ধিত পরিমাণ হ্যান্ডলিং সামাল দেয়া হয়েছে। গড়ে প্রতি ৪ বছরে বন্দরের মাধ্যমে contianer handing এর পরিমাণ ১ মিলিয়ন TEUS হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ তার সীমিত resources ব্যবহার করে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এই বর্ধিত পরিমাণ কনটেইনার হ্যান্ডলিং কার্যক্রম সম্পন্ন করে আসছে। কিন্তু পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার ভারত, পাকিস্তান এবং কলম্বোর সাথে তুলনা করলে দেখা যায় বাংলাদেশের বন্দর সমূহে FDI একেবারেই নগণ্য। বাংলাদেশে কেবলমাত্র ২০২৪ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালটি (PCI) সৌদি আরব ভিত্তিক Red Sea Gateway Terminal ( RSGT) নামক একটি টার্মিনাল অপারেটরের নিকট ২২ বছর মেয়াদে আধুনিক পদ্ধতিতে পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এটি বাংলাদেশের বন্দর খাতে উল্লেখ করার মতো প্রথম বিদেশি বিনিয়োগ। সে তুলনায় ভারত এবং কলম্বোর বেশ কয়েকটি টার্মিনাল বিদেশি অপারেটর কর্তৃক পরিচালিত হচ্ছে। তাই বিশ্বের বিনিয়োগের ধারার সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশের উন্নয়নের জন্য, বন্দরের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য-বাংলাদেশের বন্দর সমূহে বিদেশি বিনিয়োগ অপরিহার্য।
কর্নেল অলি বলেন, বিশ্বের যে সকল দেশে ITO গণ বিনিয়োগ করেছে এবং বন্দর/ টার্মিনাল পরিচালনা করছে সে সকল দেশের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, বন্দর খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা গেলে, দেশের ইমেজ বৃদ্ধি পায় বিদেশের বিভিন্ন বন্দরের সাথে কানেক্টিভিটি বৃদ্ধি পায় এবং আন্তর্জাতিক টার্মিনাল অপারেটর (ITO ) গণ আধুনিক যন্ত্রপাতি ও কম্পিউটারাইজড সিস্টেমের মাধ্যমে বন্দর ব্যবস্থাপনায় উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হয়। এতে বিনিয়োগ কৃত দেশের আমদানি রপ্তানি কার্যক্রমে গতিশীলতা বৃদ্ধি পায়।
সাবেক এ যোগাযোগ মন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান আমদানি রপ্তানি কার্যক্রম দক্ষতার সহিত সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা এবং দক্ষিণ এশিয়া তথা সারা বিশ্বের সাথে প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় এগিয়ে থাকার লক্ষ্যে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ তাদের বৃহত্তম টার্মিনাল অর্থাৎ, Newmooring Container Terminal (NCT) এ বিদেশি বিনিয়োগ পাওয়ার লক্ষ্যে UAE ভিত্তিক একটি International Terminal Operator (ITO) যা বিশ্বব্যাপী Dubai Port World (DPW) নামে সুপরিচিত এই DPW এর সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। DPW চট্টগ্রাম বন্দরে আধুনিক যন্ত্রপাতি ক্রয়, বন্দরটিকে State of the art টেকনোলজিতে রূপান্তরিত করণ এবং আধুনিক কম্পিউটারাইজ সিস্টেম প্রবর্তনের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরের হ্যান্ডলিং কার্যক্রমে দক্ষতার উন্নয়ন ঘটাবে। এতে অত্যন্ত স্বল্পতম সময়ে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ হতে পণ্য উঠানামা সম্ভব হবে এবং বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় বেশ কিছুটা এগিয়ে থাকবে। এ ধরনের একটি আন্তর্জাতিক টার্মিনাল অপারেটরের সাথে বিনিয়োগ চুক্তিতে উপনীত হওয়ার সময় সুনির্দিষ্ট ভাবে বিনিয়োগের পরিমাণ, আমাদের বাংলাদেশের স্থানীয় জনশক্তি কে অধিক বেতনে নিয়োগ, বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির কনটেইনার হ্যান্ডলিং যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে অপারেশনের দক্ষতা বৃদ্ধি, কম্পিউটারাইজেশন নেটওয়ার্ক এর মাধ্যমে সারা বিশ্বের বন্দর সমূহের সাথে এককভাবে যোগাযোগের সক্ষমতা ইত্যাদি বিষয়সমূহ অন্তর্ভুক্ত করে একটি ভারসাম্যপূর্ণ Negotiation এর মাধ্যমে এই ধরনের বিনিয়োগ আকর্ষণ করা গেলে একদিকে যেমন দেশের বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে অন্যভাবে বন্দর সমূহের দক্ষতা বৃদ্ধি পেয়ে বহিঃবিশ্বে বাংলাদেশের সুনাম বৃদ্ধি পাবে এবং বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাপকভাবে এর সুফল ভোগ করবে। বিশেষ করে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য বহিঃবিশ্বে প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় অনেকটুকু এগিয়ে গিয়ে রপ্তানি বৃদ্ধিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।
তিনি বলেন, প্রতিদিন চট্টগ্রাম বন্দর থেকে চাঁদার নামে কোটি কোটি টাকা তুলে নেয় রাজনৈতিক নেতাদের একটি চক্র। এ চাঁদা দেওয়া প্রতিষ্ঠানেরা দুর্নীতির মাধ্যমে তাদের খরচ উঠে নেয়। ফলে, স্বচ্ছ, আন্তর্জাতিক মানের ব্যবস্থাপনা এলেই এই ‘চাঁদা-চক্র’ ভেঙে যাবে। কাজেই তারা আতঙ্কিত— এটাই বাস্তবতা। চট্টগ্রাম বন্দর শুধু একটি বন্দর নয়— এটি বাংলাদেশের সম্ভাবনার পরীক্ষার ক্ষেত্র। গত পনেরো বছরে বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর নামে যে পরিমাণ লুটপাট হয়েছে, তা আমাদের চোখের সামনেই ঘটেছে। প্রায় পৌনে তিন লক্ষ কোটি টাকার বেশি অর্থ লোপাট হয়েছে প্রকল্প বাজেট ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে, অসমাপ্ত কাজের বিল তুলে, রাজনৈতিক বিবেচনায় অদক্ষ প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিয়ে, ঘুষ-কমিশনের বিনিময়ে বরাদ্দ বণ্টন করে। এর বাইরেও অপচয় হয়েছে আরও ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। এই পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ সরকারের কয়েক বছরের বাজেটের সমান।
(ঢাকাটাইমস/২৪মে/এমআর)

মন্তব্য করুন