দার্শনিক শিল্পপতি সুফি মিজানুর রহমান: পুরুষোত্তম

বহুল আলোচিত ও বহু প্রশংসিত শিল্পগোষ্ঠী পিএইচপির প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান সুফি মিজানুর রহমানকে শিল্পপতি হিসেবে স্বতন্ত্র মর্যাদা প্রদান করতেই হয়। কেননা দেশের অন্যতম একটি বৃহৎ কর্পোরেট শিল্পগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করার ফলে তিনি তো শিল্পপতি ছিলেনই, তদুপরি সুফিবাদে দীক্ষিত হওয়ার পর ‘সুফি’অভিধাও অর্জন করেন। শিল্পপতি অনেক কিন্তু ‘সুফি শিল্পপতি’ মাত্র একজনই, তিনি সুফি মিজানুর রহমান। শিল্প যদি বস্তুগত সম্পদ হয়, সুফিবাদ ভাবসম্পদ। জনাব সুফি মিজানুর রহমান শিল্পসৌধের ওপর ভাবসম্পদের প্রাসাদ নির্মাণ করে ‘সুফি শিল্পপতি’আখ্যা পেয়েছেন। তিনি স্বয়ং এই খেতাব ধারণ করেননি, ২০০১ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের আল্লামা রুমী সোসাইটি তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘সুফি’ উপাধিতে ভূষিত করে এবং দস্তারবন্দি করে।
তিনি ঢাকা বিভাগের নারায়ণগঞ্জের মানুষ; কর্মব্যাপদেশে এসে পড়েছিলেন চট্টগ্রাম বিভাগের বন্দর শহর চট্টগ্রামে। সেই চট্টগ্রাম যেখানে আকাশ পাহাড়ে এসে মিশে এক স্বপ্নময় অপার্থিব জগতের দুয়ার খুলে দেয়; সেই ভাবালুতার প্রশ্রয়ে ভাবুক সুফি মিজানের অন্তর উতলা, উন্মনা হয়ে যায় আধ্যাত্ম সাধনার অবারিত সুযোগ ও সুমহান ঐতিহ্যে অবগাহন করে। সুফি তত্ত্বের মরমীবাদ তাকে আকর্ষণ করে।
চট্টগ্রামের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা পড়ে গেলেন। চট্টগ্রামের আছে একটি সাগর-বঙ্গোপসাগর, একটি নদী-কিংবদন্তীর কর্ণফুলী, একটি বন্দর-সমুদ্র বন্দর; এছাড়া বাংলাদেশের ওয়াল স্ট্রীট খ্যাত পাইকারি বাণিজ্য কেন্দ্র খাতুনগঞ্জ; চট্টগ্রামের আছে বারো আউলিয়া; দেশের অন্য কোন জেলায় প্রকৃতি, সম্পদ ও আধ্যাত্মিকতার এমন অপূর্ব মেলবন্ধন কোথাও মেলে না। এই চট্টগ্রাম থেকেই জনাব সুফি মিজান ব্যবসায়, শিল্পপ্রতিষ্ঠার প্রেরণা এবং পারলৌকিক মুক্তির পথনির্দেশ লাভ করেন।
শিল্প-কারখানা গড়ে বৈষয়িক সমৃদ্ধির চূড়ায় আরোহণের পরও জনাব সুফি মিজানের মনে শান্তি ছিলো না। কিসের যেন অভাব, শূন্যতায় তার অন্তর হাহাকার করতে থাকে। ভাবে বিভোর হয়ে শিল্পপতি মিজানুর রহমান আধ্যাত্মিক সম্পদের খোঁজে চট্টগ্রামের সুফি দরবেশদের মাজারে ছুটে বেড়ান। অবশেষে চট্টগ্রামের আধ্যাত্মিক তীর্থ ইছাপুর তথা ফটিকছড়ির মাইজভান্ডারে গিয়ে পারলৌকিক সম্পদের খনি খুঁজে পান। সেখানে হজরত গাউসুল আজম মাইজভান্ডারীর খলিফা ও প্রথম জীবনীকার হজরত মওলানা সৈয়দ আবদুচ ছালাম ঈছাপুরীর পদতলে নিজেকে সঁপে দেন। তার কাছে বাইয়াত গ্রহণ করলে আধ্যাত্মিক জগতের সিংহ দুয়ার খুলে যায় তার সামনে।
তার প্রতিষ্ঠিত শিল্পগোষ্ঠীর নামকরণের সময়ও পিরের কথা মনে রেখেছেন জনাব সুফি মিজান। অন্য ব্যবসায়ীরা নিজের নামে অথবা তাদের পিতামাতা, পিতামহ কিংবা ছেলেমেয়ের নামে তাদের ব্যবসায় বা শিল্পের নামকরণ করেন। জনাব সুফি মিজান তার প্রতিষ্ঠিত শিল্পগোষ্ঠীর নামকরণ করতে গিয়ে পির আবদুচ ছালাম ইছাপুরী (রহ.) এর নামের সাথে মিল রেখে তিন শব্দের একটি নাম উদ্ভাবন করলেন। সালাম শব্দের অর্থ শান্তি আর শান্তির।
ইংরেজি প্রতিশব্দ পিস আর তিনি সারাজীবন মানবের উন্নতি আর সুখের জন্য কাজ করেছেন। তাই শান্তি, সুখ আর অগ্রগতি—এই তিনটির ইংরেজি প্রতিশব্দ পিস, হ্যাপিনেস এবং প্রসপারিটি নিয়ে গড়ে তোলেন পিএইচপি ফ্যামিলি।
স্বাধীনতার পর চট্টগ্রামে ইরানি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পৃষ্ঠপোষকতায় রুমী, হাফিজ, সাদী, গালিবের কাব্যালোচনার মাধ্যমে সুফি তত্ত্বের চর্চা শুরু হয়। সুফি মিজান তার আগে থেকে চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা এবং চট্টগ্রামে সুফি তত্ত্ব চর্চার পথ উন্মুক্ত হওয়ায় তিনি উৎসাহিত হয়ে উঠেন। একই সময়ে সুফিতত্ত্ব সন্ধানী গবেষক সৈয়দ আহমদুল হক এবং প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ রেজাউল করিম চৌধুরী রুমীর মসনবী চর্চার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সৈয়দ আহমদুল হকের লালখানবাজার বাঘঘোনাস্থ বাসভবন ‘রুহ আফজা’ কুটিরে সাপ্তাহিক মসনবী আলোচনার আসর বসতে থাকে। সুফি মিজানও আল্লামা রুমী সোসাইটির সদস্য পদ গ্রহণ করে মসনবী আলোচনায় নিয়মিত অংশ নিতে থাকেন। তিনি বর্তমানে রুমী সোসাইটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও ভাইস চেয়ারম্যান।
সুফিরা একটি বিশেষ জীবনধারা অনুসরণ করেন, সুফিবাদ একটি দার্শনিক প্রত্যয়। এই অর্থে সুফি মিজানুর রহমানের মুকুটে আরো একটি পালক যুক্ত হতে পারে, সেটি হলো দার্শনিক শিল্পপতি। ব্যবসায়, শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠা এবং সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও দাতব্য কর্ম ইত্যাদি নানারূপে যিনি নিজেকে প্রকাশ করেন, তিনি মিজানুর রহমানের বহিরঙ্গ তথা তার বাহ্যিক সত্তা। তার আরো এক সত্তা আছে, যেখানে তিনি ভাবের ভেলায় চড়ে কূল-কিনারহীন ভবসাগর পাড়ি দেওয়ার দুঃসাহসে ভর করে বৈঠা বেয়ে চলেছেন। রাশি রাশি ভারা ভারা ফসলে ভরা তার সোনার তরী। কিন্তু শেষ পারানির কড়ি তো নেই, তা সংগ্রহের জন্য তিনি নিত্য আধ্যাত্ম সাধনায় ডুবে থাকেন।
পিরের মুরিদ হওয়ার পর তার মধ্যে বিরাট পরিবর্তন আসে। তখন তিনি গৃহী হয়েও যেন অন্য কোনো জগতের বাসিন্দা। সন্ন্যাস জীবন, সংসার ভোলা পীর-ফকির, সাধু-সন্ন্যাসীর জীবন অবলম্বন না করলেও তিনি যে সে গোত্রেরই মানুষ তাতে সংশয় রাখা চলে না। তিনি বিয়ে থা করে সংসার জীবনে থিতু হয়েছেন, স্ত্রী তাহমিনা রহমান এবং সাত পুত্র ও এক কন্যা নিয়ে ভরপুর সফল জীবনের সুনিপুণ নির্মাতা। প্রথম জীবনে চাকরি, অতঃপর ব্যবসায় প্রবৃত্ত হয়ে ঈর্ষণীয় সিদ্ধি ও সমৃদ্ধির স্বর্ণশিখরে আরোহণ করেছেন, যে শিল্প সাম্রাজ্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন, বাহ্যত এখনো তিনিই তার আনুষ্ঠানিক প্রধান। তথাপি তার মনে শান্তি নেই; স্রষ্টার জন্য, পরম পুরুষের জন্য, পরমাত্মার সঙ্গে মিলনের জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকে তার জীবাত্মা।
লালন সাঁইর গানের মতোই তার দেহরূপ খাঁচার ভিতর মনরূপ এক অচিন পাখির নিত্য আসা-যাওয়া চলে। এই অদৃশ্য পাখির সঙ্গে দেহের যে লীলা, তাকে যিনি অনুভব করতে পারেন, উপভোগ করতে পারেন, তিনিই তো সুফি সাধক।
সুফি মিজানের জীবন সত্যিই সুফি সাধনার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ব্যবসা-বাণিজ্যে যখন ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করেন, কথা বলার এবং নিঃশ্বাস ফেলার ফুরসৎ পান না, তখনো সৃষ্টিকর্তার কাছেই পড়ে থাকে তার মন। তিনি মনে মনে তার প্রভুর নাম জপ করেন। রসুলের জন্য, তার মুর্শিদের জন্য কাঁদে তাঁর অন্তরাত্মা। দিনে মাত্র তিন-চার ঘণ্টা ঘুমান তিনি। সারা বছর রোজা রাখেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ কখনো কাজা করেন না। রাত ভোর হওয়ার অনেক আগেই তিনি শয্যা ত্যাগ করেন। ওজু করে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করেন। তারপর জিকিরে মগ্ন হয়ে যান একালের সুফি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান।
একজন মানুষের জীবনে যত সদগুণ, যত সদ্ভাবের বিকাশ ঘটা সম্ভব, সুফি মিজানুর রহমানের জীবনে তার ভরপুর সমাবেশ ঘটেছে। এক মানব জীবনে সম্ভব সমস্ত মানবিক গুণাবলীর অপূর্ব সমন্বিত প্রকাশ ঘটেছে তার জীবনে। মানবতার ধ্বজাধারী হিসেবে, সত্য ও সুন্দরের উপাসক হিসেবে, মঙ্গলময় ব্যক্তিত্ব হিসেবে, সমাজ উন্নয়নকর্মী ইত্যাদি নানারূপে বিকশিত হয়েছে সুফি মিজানুর রহমানের মানবসত্তা। একই মিজানুর রহমান তিনি কিন্তু কত রূপ, কত বিচিত্র প্রকাশ তার। এই যে নানা রূপের, নানা রঙের মিজানুর রহমান, যাঁকে বিনি সুতোর মালায় গেঁথে তোলা হলে আবার একজন অখণ্ড ও অবিভাজ্য মিজানুর রহমানকে পাওয়া যাবে।
এই বহুধা-বিদীর্ণ সুফি সাহেব এক অখণ্ড মানবসত্তারই ভিন্ন ভিন্ন রূপ। গভীরে তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে দেশ, সমাজ ও অর্থনীতির প্রায় সর্বক্ষেত্রকে ছুঁয়ে গেছে সুফি সাহেবের প্রতিভা। জীবনের এমন কোনো দিক নেই যা তাকে স্পর্শ করেনি। তার কর্মকৃতি শুধু বিচিত্রগামী নয়, সর্বত্রগামী হয়েছে বললেই বোধ করি তার প্রতি সুবিচার করা হয়। জীবনের সর্বপ্রান্তদেশে নিজেকে বিস্তৃত ও বিকশিত করতে গিয়ে তাঁর নিজেরও রূপান্তর ঘটেছে। এভাবে তিনি পূর্ণরূপে বিকশিত এক সম্পূর্ণ মানবজীবনের অধিকারী হয়ে ওঠেন। তিনি তখন একজন পূর্ণ মানবের রূপ পরিগ্রহ করেন। যিনি সাধারণের মধ্যে থেকেও অসাধারণ; যিনি এক জ্যোতির্ময় পুরুষ, হয়তো পুরুষোত্তমই তাঁর যথার্থ অভিধা।
শুধু শিল্পপতি বা দার্শনিক নন, তাঁর আরো বহুতর পরিচয় রয়েছে। যেমন- তিনি একজন শিক্ষাব্রতী, সমাজহিতৈষী, মানবতাবাদী, মঙ্গলময়, সর্বোপরি মানবকল্যাণে নিবেদিত একজন মানুষ - এক জীবনের আঁধারে যখন এতসব গুণের সমাবেশ ঘটে, তখন তিনি আর সাধারণ মানুষ থাকেন না; তিনি হয়ে ওঠেন অনন্য সাধারণ এক জীবনের উপমা। তখন সে জীবনে মহামানবের ছায়াপাত ঘটে। আরো মহিমান্বিত হয়ে মানবসত্তাকে ছাড়িয়ে ছাপিয়ে যান পুরুষোত্তম সুফি মিজানুর রহমান।
জনাব সুফি মিজান বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই জীবন ধারণের জন্য যে ব্যবসায় বৃত্তি অবলম্বন করেছিলেন, আজো তাতেই থেকে গেলেও ইতিমধ্যে সুফিবাদে দীক্ষিত হওয়ার পর তাঁর মনোজগতে বিপুল পরিবর্তন ঘটে যায়। সেই মিজানুর রহমান আর বর্তমান মিজানুর রহমান এক নামে এবং দেহে এক হলেও অন্তরে এক নন, দুয়ের মধ্যে মৌলিক রূপান্তর ঘটে গেছে। তাঁকে যতক্ষণ ব্যবসায়িক কাজকর্ম করতে হয় ততক্ষণ করেন, তারপর অফিসেই কোরআন পাঠ, তসবিহ জপতে জপতে এমন এক আধ্যাত্মিক ভুবনে ডুব দেন, যে তখন তিনি বহির্জগৎ থেকে সম্পূর্ণ বিযুক্ত। অফিসে ধ্যানের পর খোঁজ নেন বাইরে কোথায় জালালউদ্দিন রুমীর মসনবী পাঠের আসর, লালন শাহ, হাছন রাজা, শাহ আবদুল করিম, রাধারমণের গানের জলসা বসেছে, কোথায় ছেমা মাহফিল হচ্ছে, সেখানে গিয়ে সামিল হয়ে যান।
নারায়ণগঞ্জের ভূমিপুত্র: সুফি মিজান নারায়ণগঞ্জের ভূমিপুত্র। তেতাল্লিশের বারো মার্চ তাঁর জন্মসন, সাকিন চরপাড়া গ্রাম, কাঞ্চন পৌরসভা, রূপগঞ্জ থানা, ঢাকা বিভাগ। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দ। যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষের জন্য বাংলার ইতিহাসে স্মরণীয় একটি বছর। এই যুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যেই পিতা সুফি মোহাম্মদ দায়েম উদ্দিন প্রধানের ঘরে মাতা রাহাতন ভূঁইয়ার কোল আলো করে যে শিশুটি জন্ম নিয়েছিলো, উত্তরকালে সেই শিশুটিই শান্তির বার্তা বহন করে হয়ে উঠবে যুদ্ধের যথার্থ এন্টি-থিসিস। তিনি পিএইচপি নামে যে শিল্পগোষ্ঠীর পত্তন করবেন, তার আদি কথাটাই হচ্ছে পিস বা শান্তি। এ কেমন কূটাভাস যে, যুদ্ধকে সঙ্গী করে যার জন্ম, উত্তরকালে তিনি যুদ্ধবিরোধী হয়ে গেলেন!
গ্রামের পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনান্তে ভর্তি হন গ্রামেরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভারত চন্দ্র স্কুলে; অতঃপর সেখান থেকে ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে এসএসসি উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে নারায়ণগঞ্জের তোলারাম কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। পরবর্তী সময়ে একই কলেজে বি.কম ক্লাসে ভর্তি হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি লাভ করেন। বি.কম পাস করেই ঢুকে পড়লেন গোলামির চাকরিতে। প্রথমে ১০০ টাকা মাইনেতে নারায়ণগঞ্জের একটি জুট মিলে; তারপরে ১৯৬৫-তে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান-এর (বর্তমানে সোনালী ব্যাংক) চাকরি পেলেন ইন্টারভিউ দিয়ে। কর্মস্থল চট্টগ্রাম। ১৯৬৭-তে ব্যাংক বদল করে ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংকের (বর্তমানে পূবালী ব্যাংক) চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ শাখায় যোগদান করলেন ৮০০ টাকা বেতনে। সেখানে বৈদেশিক বিভাগের ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করেন।
চট্টগ্রামের একটি সদাগরি ঐতিহ্য আছে। বঙ্গোপসাগর, কর্ণফুলী নদী এবং খাতুনগঞ্জ এই তিনের সমন্বয়ে চট্টগ্রামের সদাগরি ঐতিহ্য ধাপে ধাপে সৃষ্টি হয়েছে। সাগর ও নদী চট্টগ্রামকে সুপ্রাচীনকাল থেকে নৌ বাণিজ্যের সুবিধা দিয়েছে। সর বা পালের জাহাজের সাহায্যে যারা সাগর, মহাসাগর পাড়ি দিয়ে নানা দ্বীপ ও দেশে দেশে বাণিজ্যের পসরা নিয়ে ঘুরে বেড়াত, তাদের একজন কিংবদন্তীর চাঁদ সওদাগর। জাহাজি ব্যবসা, দোভাষী ব্যবসা, স্টিভিডোরিং ইত্যাদি নানা পর্যায় অতিক্রম করে খাতুনগঞ্জের গদিভিত্তিক সদাগরি বাণিজ্যের রূপ পরিগ্রহ করে। সদাগরি বাণিজ্যের পোশাকী নাম ট্রেডিং। সুফি মিজানও ট্রেডিং দিয়ে ব্যবসা বাণিজ্যের জগতে পা রেখেছিলেন।
ওদিকে ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংকের চাকরি করতে করতেই এসে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শেষে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশ করলো। বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের আবির্ভাব এবং নব্য বাংলাদেশের নতুন করে শুরু হওয়া ব্যবসা-বাণিজ্যের জগতে একজন নবীন ব্যবসায়ী সুফি মিজানের সাবধানী পথচলা সমসময়ে আরম্ভ হয়। এই সমাপতন কী নিছক কাকতালীয় ঘটনা? না, এর মাঝে গভীরতর কোনো তাৎপর্য নিহিত রয়েছে? সেটা ভেবে দেখার বিষয়।
পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ এই সাক্ষ্য দেয় যে, বাংলাদেশ যতই এগিয়েছে, সুফি মিজানুর রহমান নামে একজন ব্যবসায়ীর উত্থান ঘটেছে। বস্তুত সুফি মিজানুর রহমান এবং বাংলাদেশ একই সময়ের সৃষ্টি। ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান সম্পূর্ণরূপে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ফসল এবং স্বাধীন বাংলাদেশ ও সুফি মিজান হাত ধরাধরি করে চলেছে।
ব্যাংক চালু হলে জনাব সুফি মিজান চাকরিতে যোগদান করেছিলেন। স্বাধীনতার প্রথম অরুণোদয়ের রাঙা প্রভাতে তখন ঝলমলে অবনী, সোনা রোদে মাখামাখি হতে হতে মানুষের চোখে স্বপ্নের ওড়াওড়ি; সুফি সাহেবের চোখেও স্বপ্নের অঞ্জন, তিনি হয়ে গেলেন ড্রিম মার্চেন্ট। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে তাঁর চোখে তখন সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের হাতছানি। দেশ গঠনের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার তাগিদ অনুভব করলেন অন্তর থেকে। তাঁর ভিশন ছিল। তিনি লক্ষ্য করলেন স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ব্যবসায়ীর সংখ্যা অনেক কমে গেল। কেননা, বেশির ভাগ ব্যবসায়ীই ছিলেন অবাঙালি। যারা ভারত ও পাকিস্তান থেকে এসেছিলেন, তারাই ব্যবসা জানতেন। তৎকালীন আদমজী, বাওয়ানী, দাউদের মতো বড় বড় সব শিল্প কারখানাই ছিল তাদের। স্বাধীনতার পর যখন তারা নিজেদের দেশে ফিরে গেলেন, তখন ব্যবসা ক্ষেত্রে বিশাল একটি শূন্যতা তৈরি হলো। ঠিক এই সময়টাকে কাজে লাগালেন মিজানুর রহমান।
ব্যাংকে চাকরির সুযোগে ব্যবসা-বাণিজ্য বিশেষ করে আমদানি-রপ্তানির ব্যবসাটা ভালো করে রপ্ত করেছিলেন, এখন নিজে যখন ব্যবসা আরম্ভ করছেন, তখন সেই বাস্তব অভিজ্ঞতাটা কাজে লেগে গেল। প্রথম দিকে জাপান থেকে টায়ার-টিউব, মিল্ক পাউডার, সুতা, পুরোনো কাপড়, স্পেয়ার পার্টস প্রভৃতি আমদানি করতেন। সেখানে সফলতার পরপরই ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে যান। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এসেছে একের পর এক সফলতা।
পায়ের তলায় যখন শক্ত জমি খুঁজে পেলেন তখন তিনি চলে গেলেন শিল্প প্রতিষ্ঠানের দিকে। শিল্পের সবাই ভোগ্যপণ্য উৎপাদনের কারখানা, যেমন-চিনি, সয়াবিন বড়জোর রড, সিমেন্ট ফ্যাক্টরি করে তৃপ্ত হন, সুফি মিজান কিন্তু মৌলিক ও ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠানের দিকে মনোনিবেশ করেন।
সৃষ্টিশীল উদ্যোক্তা সুফি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান দেশের মানুষের চাহিদার দিকে লক্ষ্য রেখে নিজের ব্যবসা-বাণিজ্যকে বিস্তৃত করেছেন। তিনি বেশ চিন্তাভাবনা করে, প্রস্তুতি নিয়ে শিল্পের জগতে পদার্পণ করেন। খেয়ালে নয়, হুজুগে নয়, নিছক অর্থোপার্জন বা শিল্পপতি হওয়ার জন্য তিনি শিল্প প্রতিষ্ঠা করেননি, দেশের শিল্পায়ন নিয়ে তিনি দীর্ঘদিন ধরে যে চিন্তাভাবনা করেছেন তারই ফলশ্রুতিতে তিনি এক একটি শিল্পের গোড়াপত্তন করেন। এক কথায় বিস্তর মাথা ঘাটিয়ে, গবেষণা করে, তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করার পরই যখন সমীচীন মনে হয়েছে, তখনই শিল্পাঙ্গনে তাঁর ভীরু পদসঞ্চার ঘটে। তবে জাদু আছে তাঁর হাতে। যখনই যে প্রকল্পে তিনি হাত দিয়েছেন, সেখানে মুঠো মুঠো সোনা ফলেছে। সময়ের ব্যবধানে তাঁর শিল্পভাবনায় অনূদিত হয়ে গড়ে উঠতে থাকে একের পর এক শিল্প-কারখানা এবং এক সময় কুড়িটি শিল্প সমবায়ে এক বিশাল শিল্প সাম্রাজ্য পিএইচপি ফ্যামিলি আত্মপ্রকাশ করে। জনাব সুফি মিজানুর রহমান পিএইচপি ফ্যামিলির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, শুধু তাই নয়, তিনিই পিএইচপি ফ্যামিলির প্রাণপুরুষ, থিঙ্কট্যাঙ্ক এবং চিরন্তন প্রেরণার উৎস।
পিএইচপি ফ্যামিলির অধীনস্থ শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের নাম এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে –
১. পিএইচপি কোল্ড রোলিং মিলস লি., ২. পিএইচপি কন্টিনিউয়াস গ্যালভানাইজিং মিলস লি., ৩. পিএইচপি স্টিলস লি., ৪. পিএইচপি এনওএফ কন্টিনিউয়াস গ্যালভানাইজিং মিলস লি., ৫. পিএইচপি ফ্লোট গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজ লি., ৬. পিএইচপি পাওয়ার জেনারেশন প্ল্যান্ট লি., ৭, পিএইচপি পাওয়ার কোম্পানি লি., ৮. পিএইচপি শিপ- ব্রেকিং অ্যান্ড, রি-সাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিজ লি., ৯. পিএইচপি ওভারসিজ লি., ১০. পিএইচপি ল্যাটেক্স এন্ড রাবার প্রোডাক্টস লি., ১১. পিএইচপি ফিশারিজ লি., ১২. বে-টারমিনাল অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লি., ১৩. পিএইচপি স্পিনিং মিলস লি., ১৪. পিএইচপি রোটর স্পিনিং মিলস লি., ১৫. পিএইচপি স্টক অ্যান্ড সিকিউরিটিজ লি., ১৬. পিএইচপি এগ্রো প্রোডাক্টস লি., ১৭. পিএইচপি কটন মিলস লি., ১৮. পিএইচপি অটো মোবাইলস লি., ১৯. পিএইচপি মোটরস লি., ২০. পেলিকন প্রোপার্টিজ লি.।
বর্তমানে পিএইচপি গ্রুপের বার্ষিক লেনদেন পাঁচ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। গ্রুপের অধীনস্থ ২০টি প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। ২০০৯-১০ আর্থিক বছরে পিএইচপি শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক, ভ্যাট ও আয়করসহ ৬০০ কোটি টাকা জমা দিয়েছে সরকারি কোষাগারে।
তিনি একজন ব্যতিক্রমী শিল্পপতি। কোনো শিল্পপতি শুক্রবার জুমাবারের টিভির পর্দায় দর্শন দিয়ে ধর্মদেশনা দেন না। এক্ষেত্রে সুফি মিজান তা করেন এবং সেজন্য তিনি অনন্য।
একাধিকজন শিল্পপতি মিলে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার নজির আছে। ইঞ্জিনিয়ার আফছার উদ্দিন আহমদ একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন সত্য, তবে সেটি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু সুফি মিজান ইউআইটিএস নামে আইটি-বেজড্ দেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছেন, সেটি সাধারণ নয়, সাধারণ বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি চট্টগ্রাম ক্যাম্পাস, ইউএসটিসির সঙ্গেও সুফি মিজান যুক্ত আছেন। বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া সাইডার ইন্টারন্যাশনাল, আই হসপিটালে তাঁর অংশগ্রহণ এবং ষোলশহর জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদ্রাসায় ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে জামেয়া মহিলা মাদ্রাসা স্থাপন করেছেন।
ভারতে রতন টাটার চেয়ে বড় ফিলানথ্রপিক পারসোনালিটি বোধ হয় আর কেউ ছিল না। আজিম প্রেমজির কথাও আসতে পারে। রতন টাটা তার আয়ের ৬৬ শতাংশ বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠানে ও জনসেবামূলক কাজে দান করেছেন। আজিম প্রেমজি জনকল্যাণমূলক কাজে ২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দান করেন। ভারতীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৪৬ হাজার ১০৮ কোটি ৫৫ লাখ রুপি।
রতন টাটা শিল্প-সংস্কৃতিরও উদার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। একবার চিত্রশিল্পী বিকাশ ভট্টাচার্যের একটি ছবির নিলাম হচ্ছিলো। নিলামের দর কোটি রুপির অঙ্কে পৌঁছলে যারা নিলাম ডাকে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তারা আর কেউ ডাক দিতে সাহস করলেন না। এ সময় একমাত্র রতন টাটাই কোটি রুপিতে ছবিটি কিনে নেন।
সুফি মিজানও শিল্পী, সাহিত্যিক ও সাংবাদিকদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। একটি উদাহরণ দিচ্ছি, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান ও মরমী গানের খ্যাতিমান শিল্পী, গীতিকার ও সুরকার আবদুল গফুর হালী সুফি মিজানের বদান্যতায় শেষ জীবন স্বচ্ছন্দে অতিবাহিত করেন।

মন্তব্য করুন