মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর: তাদের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ, তবুও বহাল...

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা টাইমস
  প্রকাশিত : ০৯ মে ২০২৫, ১১:২৪| আপডেট : ১০ মে ২০২৫, ১২:৪০
অ- অ+

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ বেশ পুরনো। বিশেষ করে আটক করা মাদকদ্রব্য জব্দের পর কম দেখানো, একই পদে বছরের পর বছর বহাল থাকা, বিভিন্ন মদের বার বা সিসা লাউঞ্জ থেকে মাসোহারা আদায় অন্যতম। ঊধ্বর্তনদের ম্যানেজ করে প্রতিনিয়ত এমন ঘটনা ঘটলেও দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যারা ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে অধিদপ্তরকে নিজেদের কজ্বায় রেখেছিলেন তাদের অনেকে এখনও স্বপদে বহাল থেকে দায়িত্ব পালন করছেন। বঙ্গবন্ধু পরিষদের ব্যানারে যারা সক্রিয় ছিলেন তারাও এখন ভোল পাল্টে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ বলে দাবি করছেন।

অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা ও গণমাধ্যমের খবর বলছে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক (অর্থ ও হিসাব) তারিক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম দীর্ঘ সাত বছর ধরে একই পদে কর্মরত আছেন। একসময় নিজেকে আওয়ামী লীগ পরিবারের সন্তান পরিচয় দিতেন। নিজেও বঙ্গবন্ধু পরিষদের অর্থ সম্পাদক ছিলেন। যার প্রমাণ এ প্রতিবেদকের হাতে রয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, অনৈতিক সুবিধার মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন এই তারিক। তাছাড়া পছন্দের কার্যালয়কে ঘুষের বিনিময়ে অনুমোদন ছাড়া বাজেট দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এছাড়া যতবার ইন্সপেক্টরদের পদোন্নতির নথি উঠেছে ততবার তারিক তাদেরকে পদোন্নতি বঞ্চিত করতে নানান ষড়যন্ত্র করেছেন। অভিযোগ উঠেছে, তার কারণেই গত ২০ বছর অধিদপ্তরে চাকরি করলেও বহু ইন্সপেক্টর পদোন্নোতি পেয়ে সহকারী পরিচালক বা এডি হতে পারেননি।

সূত্র বলছে, মানিকগঞ্জে তারিক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলামের একাধিক প্লট রয়েছে। তাছাড়া একাধিক দোকানও আছে তার। অধিদপ্তরে যারা মহাপরিচালক হয়ে এসেছেন তাদেরকে কব্জা করে নিজের চেয়ার ঠিক রেখেছেন তিনি। ইন্সপেক্টরদের দশম গ্রেডের ফিক্সেশন বন্ধের জন্য সব ভারপ্রাপ্ত এডি মিলে কোটি টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন দপ্তর ম্যানেজ করেছেন এই তারিক। আওয়ামী লীগ আমলে বিচারপতি হওয়া একজন নারী বিচারপতির নিকটাত্মীয় তিনি। অভিযোগ রয়েছে, ওই নারী বিচারপতিকে ব্যবহার করে ইন্সপেক্টরদের পদোন্নতি আটকে দিয়েছেন তারিক। তাছাড়া অধিদপ্তরের পোশাক তৈরিতে টেইলার্সদের কাছ থেকেও মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েছেন। উৎকোচ ছাড়া কোনো বিল পাস করেন না মাদকের এই কর্মকর্তা।

তবে অভিযোগ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তারিক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম ক্ষিপ্ত হয়ে যান। বলেন, “এসব ফালতু বিষয় ছাড়া আর কিছু বলতে চান? যদি অন্য কোনো বিষয় থাকে তাহলে কথা বলেন, না হলে রেখে দেন।

এরপর তিনি ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।

তার বক্তব্য চাওয়ার কিছু সময় পর প্রতিবেদককে আনিসুর রহমান নামে যুবদলের কেন্দ্রীয় সদস্য পরিচয় দিয়ে একজন ফোন করেন। তিনি বলেন, “তারিক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলামের বিরুদ্ধে নিউজ করা যাবে না। তিনি হয়ত সামান্য কিছু অর্থ কামিয়েছেন.... কিন্তু তার মানে সংবাদ প্রচার করতে হবে?”

সংবাদ প্রচার করলে দেখে নেওয়ার হুমকিও দেন আনিসুর রহমান।

তবে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় বলছে, “এই নামে তাদের কোনো সদস্য নেই। আর বর্তমানে যুবদলের কোনো কমিটি নেই। যিনি ফোন করেছিলেন তিনি মিথ্যা পরিচয় দিয়েছেন।”

এদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত সহকারী পরিচালকের (এডি, ভারপ্রাপ্ত) দায়িত্বে রয়েছেন মোহাম্মদ শরীফ উদ্দিন। তিনি সিপাহি থেকে এডি হয়েছেন। অফিস প্রধান হিসেবে কোনো অভিজ্ঞতা না থাকায় নিম্নপদস্থরা তাকে মানেন না। ফলে মামলা পরিচালনা থেকে শুরু করে সব কার্যক্রমে বিঘ্ন হচ্ছে বলে জানিয়েছেন অধস্তন কর্মকর্তারা। এছাড়া এডি পদ পাওয়ার পর প্রভাব খাটিয়ে নিজের নিয়ন্ত্রণে খেয়াল খুশি মতো কার্যক্রম পরিচালনার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে।

নারায়ণগঞ্জ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো. রিফাত হোসেনের বিরুদ্ধেও অভিযোগের অন্ত নেই। অভিযানে জব্দ করা মাদকদ্রব্য নিজেই গায়েব করে দিতেন তিনি। গতবছর কক্সবাজার থেকে ৩০ হাজার পিস ইয়াবা নিয়ে ঢাকায় ঢোকে মাদক চক্রের দুই সদস্য। রিফাত হোসেনের নেতৃত্বে ২২ আগস্ট ইয়াবা ও গাড়িসহ তাদেরকে আটক করা হয়। পরে মামলার এজাহারে ইয়াবা দেখানো হয় আট হাজার। আদালতে আসামিদের স্বীকারোক্তিতে উঠে আসে ৩০ হাজার পিস ইয়াবার চালানসহ তারা ধরা পড়েছেন। এই নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা তৈরি হয়। প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে বাকি ২২ হাজার পিস ইয়াবা গেল কোথায়? এই ঘটনার পর ১৯ জুন রিফাত হোসেনকে মাদারীপুরে বদলি করা হয়। তবে রিফাত তদবির করে সেই বদলি বাতিল করান।

কিশোরগঞ্জের সহকারী পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) এনায়েত হোসেনের বিরুদ্ধেও রয়েছে নানান অভিযোগ। সম্প্রতি রাজধানীর বনানীর একটি সিসা লাউঞ্জে অভিযানে গিয়ে সরকারি নিয়ম বহির্ভূত কর্মকাণ্ড করে তার নেতৃত্বাধীন দলটি। সেখানে কর্মরতদের মারধরের একটি ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়। এই ঘটনায় তোলপাড় শুরু হলে এনায়েত হোসেনসহ গুলশান সার্কেলের পরিদর্শক আতাউরসহ আরও কয়েকজনকে ঢাকার বাইরে বদলি করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ তদন্ত শুরু করেছে ডিএনসি।

সূত্র বলছে, ডিএনসির নবম গ্রেডের কর্মকর্তারা সহকারী পরিচালক হওয়ার কথা। সেখানে দশম গ্রেডের কর্মকর্তা হয়েও অদৃশ্য উপায়ে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব বাগিয়ে নেয় এনায়েত হোসেন সিন্ডিকেট।

বহুল বিতর্কিত কক্সবাজার কার্যালয়ের সাবেক সহকারী পরিচালক এ কে এম দিদারুল আলমকে নিয়েও অভিযোগের অন্ত নেই। সাংবাদিককে মাদক মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টা, মাদক নিয়ন্ত্রণের নামে উল্টো মাদক কারবারে সহায়তা, টাকার বিনিময়ে মামলা বাণিজ্যএমন বহু অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। পরে সেখান থেকে তাকে সরিয়ে রংপুর বিভাগে সংযুক্ত করা হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দিদারুলের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ পুরোনো। ২০১১ সালে ডিএনসির ঢাকা মহানগর কার্যালয়ের হিসাবরক্ষক থাকাকালে সহকর্মীরা দিদারুলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছিলেন। এছাড়া ভারপ্রাপ্ত এডি হয়ে যে জেলায় গেছেন সেখানেও তার বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি চাঁদপুরের দক্ষিণ মতলবে মা ও ভাইকে মাদক মামলায় ফাঁসনোর অভিযোগ তুলে দিদারুলের নামে অধিদপ্তরে অভিযোগ জানিয়েছেন এক তরুণী। তবে এত অভিযোগের পরেও থেকেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. হাসান মারুফ ঢাকা টাইমসকে বলেন, “আমি নতুন। কোনো তথ্য জানার থাকলে অধিদপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা এবিষয়ে বলবেন।

জনসংযোগ কর্মকর্তা শেখ মুহাম্মদ খালেদুল করিম ঢাকা টাইমসকে বলেন, “পুরাতন যারা সদরদপ্তরে ছিলেন তাদেরকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। নতুন ডিজি দায়িত্ব নেওয়ার পর মাঠপর্যায়ে মাদকবিরোধী অভিযানের তৎপরতা বেড়েছে। তবে অনৈতিক কর্মকাণ্ডে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে তদন্ত কমিটি হচ্ছে এবং ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।”

বর্তমান ডিজি সব অপকর্মের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স জানিয়ে খালেদুল করিম বলেন, “কক্সবাজার, বনানীর ইস্যুতে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর আমরা তাৎক্ষণিক বিভাগীয় ব্যবস্থা নিয়েছি। কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী অপকর্মে জড়িত হলে আমরা ছাড় দিচ্ছি না।”

(ঢাকাটাইমস/০৯মে/এসএস/এফএ)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
ডিএনসিসির মহাখালী হাসপাতালে হিটস্ট্রোক সেন্টারের উদ্বোধন, মিলবে বিনামূল্যে চিকিৎসা
সুন্দরবনের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনে নিষেধাজ্ঞা জারী 
রাজনৈতিক দলের বিচারের বিষয়ে ভবিষ্যতে সিদ্ধান্ত: চিফ প্রসিকিউটর
হবিগঞ্জে দুই এলাকাবাসীর মধ্যে সংঘর্ষ, আহত ৫০
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা