মিরসরাইয়ের দুই শীর্ষ জঙ্গির খোঁজে পুলিশ

ইব্রাহিম খলিল, চট্টগ্রাম
  প্রকাশিত : ১৯ মার্চ ২০১৭, ০৮:৪১| আপডেট : ১৯ মার্চ ২০১৭, ০৮:৫৪
অ- অ+

চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের সন্দেহভাজন জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের এক সপ্তাহের মধ্যে সীতাকুণ্ড পৌরসদরে দুটি জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। পুলিশ প্রশাসনের ধারণা, জঙ্গিদের আতুরঘর এই মিরসরাই ও সীতাকুণ্ড। এই এলাকার বাসিন্দা জেএমবির দুই কেন্দ্রীয় নেতাকে খুঁজছে পুলিশ।

এর আগে রাজধানীর হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁ ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার পর পুলিশ প্রশাসন আঙুল তুলেছিল মিরসরাইয়ের জোরারগঞ্জ উপজেলার সোনাপাহাড় গ্রামের দিকে। স্থানীয়ভাবে জঙ্গিদের গ্রাম হিসেবেও পরিচিত এই গ্রাম। আর এ মিরসরাই থেকেই যাত্রা শুরু হয় জেএমবির।

স্থানীয় লোকজন জানান, পুলিশের তালিকাভুক্ত জেএমবির অন্তত দুজন কেন্দ্রীয় নেতার বাড়ি সোনাপাহাড় গ্রামে। দীর্ঘদিন ধরে তারা পলাতক। এ গ্রামের আরো কয়েকজন জঙ্গি দেশের বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) সূত্র জানায়, জঙ্গিদের যে তালিকা সিএমপির হাতে রয়েছে, তাতে অন্তত দুজন শীর্ষ জঙ্গিসহ কয়েকজনের বাড়ি মিরসরাইয়ের সোনাপাহাড় গ্রামে। সম্প্রতি কুমিল্লার চান্দিনায় পুলিশের ওপর বোমা নিক্ষেপকারী জঙ্গি জসিম ও হাসানের বাড়িও এই গ্রামে।

মিরসরাই সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার মাহবুবুল আলম জানান, সোনাপাহাড় গ্রামের হারুনুর রশিদ ওরফে রুবেল ও এমরান হোসেন শিহাব জেএমবির কেন্দ্রীয় নেতা। তারা দীর্ঘদিন ধরে পলাতক। গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর গাজীপুরে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত মামুন ও হেলালের বাড়িও সোনারপাহাড় গ্রামে। চট্টগ্রাম নগরীর মাঝিরঘাটে সাহা করপোরেশনে ডাকাতির ঘটনায় গ্রেপ্তার জঙ্গি মিনহাজুল ইসলাম মধ্যম সোনাপাহাড় গ্রামের বাসিন্দা।

সোনাপাহাড় গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় পাঁচ বছর আগে এই গ্রামে জঙ্গিদের আনাগোনা বাড়ে। এক ব্যক্তি জানান, এই গ্রামে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণও চলে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জোরারগঞ্জ টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র তৌফিকুল ইসলাম ওরফে জাবেদ প্রথম সোনাপাহাড় গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠায় জিহাদের ডাক দেন। ২০১১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত কখনো প্রকাশ্যে কখনো গোপনে তার তৎপরতায় সাড়া দেয় অনেকে। তবে সঠিক সংখ্যা জানা নেই কারো।

গ্রামবাসীদের দেয়া তথ্যমতে, গ্রামের শফিউল ইসলামের ছেলে ইমরান হোসেন শিহাব, মনু মুন্সির ছেলে হারুনুর রশীদ ওরফে রুবেল, আবুল বশরের ছেলে রাসেল ওরফে মামুন, সেকান্দার বাদশার ছেলে হেলাল উদ্দিন ওরফে হেলাল, তোফাজ্জল হোসেন দুলালের ছেলে মিনহাজুল ইসলাম সাজিল ওরফে সাজিদসহ বেশ কয়েকজন দেশের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গি হামলার সঙ্গে যুক্ত।

তাদের মধ্যে শিহাব ও রুবেল পলাতক। মামুন ও হেলাল ২০১৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর গাজীপুরের জয়দেবপুর থানার যোগীতলা এলাকার পরিত্যক্ত একটি বাড়িতে নাশকতার প্রস্তুতিকালে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা যান। পরে তাদের পরিচয় শনাক্ত করতে না পারায় আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের মাধ্যমে বেওয়ারিশ হিসেবে লাশ দাফন করা হয়।

পুলিশ সূত্র জানায়, এর আগে ২০১৫ সালের ১২ জানুয়ারি রাতে একটি চলন্ত ট্রাকে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় শিহাব ও তার সহযোগীরা। এ ঘটনায় নগরীর রিয়াজউদ্দিন বাজারের ব্যবসায়ী এনামুল হক মারা যান। ঘটনাস্থল থেকে শিহাবকে আটক করে জোরারগঞ্জ থানার পুলিশ। কিন্তু স্থানীয় একজন আওয়ামী লীগ নেতা তাকে থানা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান বলে অভিযোগ আছে।

অন্যদিকে মিনহাজ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর সোনাপাহাড় গ্রামে অভিযানে যায় পুলিশ। গ্রামের প্রবেশপথে পুলিশের সঙ্গে দেখা হয় জঙ্গি রুবেলের। পুলিশ তার কাছেই জানতে চায় রুবেলকে চেনেন কি না। পুলিশকে বোকা বানিয়ে রুবেল চ¤পট দেন। পরে রুবেল ও শিহাব এলাকা ছেড়ে আত্মগোপন করেন।

নগরীর মাঝিরঘাটে সাহা করপোরেশনে ডাকাতি ও খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তার মিনহাজুল তার জবানবন্দিতে জানান, রুবেল ও তার বাড়ি একই গ্রামে। রুবেলের হাত ধরে তার জঙ্গি হয়ে ওঠার কাহিনিও তিনি পুলিশের কাছে বর্ণনা করেন। নগরীর বায়েজিদের চন্দ্রনগরে অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নেয়া এবং রুবেলের পরামর্শে সত্য গোপালকে হত্যা করে টাকার ব্যাগ লুটের কথাও পুলিশের কাছ স্বীকার করেন তিনি। মিনহাজ বর্তমানে চট্টগ্রাম কারাগারে আছেন।

ধারণা করা হয়, সোনাপাহাড় গ্রামটি দুর্গম এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ বলে জোরারগঞ্জ এলাকাকে জঙ্গিদের ঘাঁটি হিসাবে বেছে নেয়া হয়। সেখান থেকে পাশের সীতকু- এলাকায়ও আস্তানা গাড়ছে জঙ্গিরা। এ এলাকা থেকে সহজে চট্টগ্রাম মহানগরী ও ঢাকায় এবং বারৈয়ারহাট থেকে খাগড়াছড়ি হয়ে অনায়াসে তিন পার্বত্য জেলায় যাতায়াত করা যায়। ফলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের এ শিল্প জোন ঘিরে জঙ্গিদের অবস্থান গড়ে ওঠে বলে ধারণা করা হয়।

এ ছাড়া মিরসরাইয়ে দেশের বৃহত্তম অর্থনৈতিক জোন, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণসহ সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে বিদেশিরা আসছেন এখানে। তাদের টার্গেট করে মিরসরাই ও সীতাকু-ে জঙ্গিরা আস্তানা গড়ে তুলছে বলে ধারণা করছেন চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার নুরে আলম মিনা।

জাবেদের হাত ধরে মিরসরাইয়ে জঙ্গির উত্থান

কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী পৌর সদরের বৈথের মহল্লার মুদি দোকানি জজ মিয়ার ছেলে তৌফিকুল ইসলাম জাবেদ। ২০০৯ সালে কটিয়াদীর চরজাগালিয়া কারিগরি স্কুল থেকে এসএসসি পাস করার পর ভর্তি হন জোরারগঞ্জ টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। সেখানে পড়াশোনার সময় বসবাস করতেন সোনাপাহাড় গ্রামের একটি ভাড়া বাসায়।

গ্রামের লোকজন জানান, জাবেদ ২০১১ সালের দিকে গ্রামের বেদেপাড়ার পূর্ব পাশের একটি বাসায় ভাড়া থাকতেন। রাতের বেলায় মাদরাসা পড়ুয়া ছেলেদের নিয়ে গ্রামের জাফরের খামারের চায়ের দোকানে ইসলামি আলোচনায় মিলিত হতেন। ইসলামি আলোচনার আড়ালে যে জঙ্গি তৎপরতা চলত, তা প্রথম দিকে স্থানীয়রা বুঝতে পারেনি।

পরে গ্রামের রুবেল, মামুন, হেলাল, মিনহাজসহ বেশ কয়েকজনের আচরণে হঠাৎ পরিবর্তন দেখে বিষয়টি আঁচ করা যায়। তারা গ্রামের অন্য যুবক ছেলেদের জিহাদের পথে শরিক হওয়ার আহ্বান জানাতেন।

২০১৪ সালের দিকে বেশ কয়েকবার তাদের কর্মকাণ্ডে গ্রামের লোকজন ক্ষেপে গিয়েছিল। পরে তারা আস্তে আস্তে গ্রাম থেকে বেরিয়ে যায়। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জঙ্গি জাবেদ নগরীর কর্ণফুলীর খোঁয়াজনগর থেকে গ্রেনেডসহ গ্রেপ্তার হয়। পরবর্তী সময়ে গ্রেনেড বিস্ফোরণে মারা যান তিনি।

ডাকাতি ও খুনের ঘটনায় মিনহাজুল পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হলে জঙ্গি তৎপরতার বিষয়টি এলাকার লোকজনের কাছে পরিষ্কার হয়। এরপর জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত অন্যরা এলাকা থেকে সটকে পড়ে। একই বছর ডিসেম্বর মাসে গাজীপুরের জয়দেবপুরে রাসেল ওরফে মামুন ও হেলাল র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। খবর পেলেও তাদের পরিবার ভয়ে সন্তানদের লাশ আনতে যায়নি।

গাজীপুরে বন্দুকযুদ্ধে নিহত জঙ্গি রাসেল সম্পর্কে এলাকাবাসী জানায়, রাসেল প্রায় এক বছর ধরে আত্মগোপনে ছিলেন। গত বছর নভেম্বর মাসে তার বাবা আবুল বশর মারা যান। ওই সময় পরিবারের লোকজন তাকে খবর দিলে তিনি বাবার জানাজায় থাকতে পারবেন না জানিয়ে বলেছিলেন, ‘আল্লাহ আমাকে এদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়ে রেখেছেন। বাবা বেহেস্তে যাবেন। আমি জানাজায় আসতে পারব না।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পুলিশের তালিকাভুক্ত সোনাপাহাড় এলাকার সাত জঙ্গির মধ্যে পলাতক শিহাব, গাজীপুুরে নিহত মামুন ওরফে রাসেল পড়তেন স্থানীয় জোরারগঞ্জ নজির আহম্মদ দাখিল মাদরাসায়। তারা দুজন ওই মাদরাসা থেকে ২০১৩ এবং ২০১২ সালে দাখিল পরীক্ষা দেন। মাদরাসা সুপার শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘আমার মাদরাসার ওই দুই ছাত্র দাখিল পরীক্ষার পর জঙ্গি কর্মকাণ্ডে স¤পৃক্ত হয় বলে আমি জেনেছি। তাদের এ ধরনের কর্মকাণ্ডে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছে জোরারগঞ্জ টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের কিছু ছাত্র। জঙ্গিবাদের মতো সন্ত্রাসী কর্মকা- থেকে বাচ্চাদের বাঁচাতে আমরা এখন প্রতিটি ক্লাসে হাদিসের সহি শিক্ষা দেওয়ার জন্য শিক্ষকদের নির্দেশ দিয়েছি।’

(ঢাকাটাইমস/১৮মার্চ/মোআ)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
মানবিক করিডরের নামে কোনো কিছু জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে না, মির্জা ফখরুলের হুঁশিয়ারি 
জম্মু-কাশ্মীরে হামলার ভারতীয় প্রতিবেদন ‘ভুয়া এবং মিথ্যা’: পাকিস্তান
নিষিদ্ধ হচ্ছে যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ: আসিফ মাহমুদ
হোটেল আমারিতে পুলিশ-ডিএনসির যৌথ অভিযান চলছে 
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা