এত জলজট, তবু পলিথিন ছাড়ছে না মানুষ

সৈয়দ অদিত, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ০৭ আগস্ট ২০১৭, ১২:৩৮ | প্রকাশিত : ০৭ আগস্ট ২০১৭, ০৮:২৫

পলিথিনের মত অপচনশীল দ্রব্যে পানি নিষ্কাষণের লাইন বন্ধ হয়ে নিত্য দুর্ভোগ হচ্ছে বর্ষায়। জলজটে যখন মানুষ ভুগছে, তখন সরকারি সংস্থার সমালোচনা ছাড়াও জনসচেতনতার অভাব, যেখানে সেখানে আবর্জনা ফেলা, বিশেষ করে পলিথিনের অতি ব্যবহার নিয়ে কথা উঠেছে। কিন্তু এ বিষয়ে টনক নড়ছে নগরবাসীর, এমন প্রমাণ মেলে না বাজারে গেলে। কি কাঁচা বাজার, কি শুকনো বাজার, কি ফলপট্টি, সব জায়গায় পণ্য কিনলেই পলিথিনে করে নিয়ে যাচ্ছে ভোক্তারা।

রাজধানীর হাতিরপুল বাজারের সবজি বিক্রেতা বাচ্চু মিয়া ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘পলিথিনের ব্যাগে বাজার না দিলে কাস্টমার বাজার নিবার চায় না। আমাগো বাধ্য হইয়া পলিথিন ব্যবহার করন লাগে।’

বাজার করতে আসা হাফিজ উদ্দিন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘একটা বাজারের ব্যাগের দাম ১৫ টাকা। আর সেখানে একটা পলিথিনের দাম এক টাকার কম। সেখানে বিক্রেতার থেকে পণ্য কেনার সময় তারা পলিথিনের দাম নিয়ে নেয়। আর এটা ব্যবহার করাও অনেক সহজ।’

পলিথিন ব্যবহারের ব্যাপারে রাজধানীর কারওয়ানবাজারের আরেক ক্রেতা লিয়াকত আলী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘বাসায় পলিথিন নিয়ে বাসায় মাছ মাংস ফ্রিজে রেখে দেই। আর কাজ ফুরিয়ে গেলে ফেলে দেই। এই পলিথিনটাই আমাদের কাছে অনেক সহজলভ্য মনে হয়। তবে আমাদের সমস্যা হল পলিথিনের ব্যবহার আমরা সঠিকভাবে করতে পারছি না।’

রাজধানীর কারওয়ানবাজারে বাজার করতে আসা মতিউর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আলাদা করে ব্যাগ নিয়ে আসা ঝামেলা। দোকানদাররা পলিথিনে দিচ্ছে এতেই কাজ হয়ে যাচ্ছে। ফলে আলাদা করে ব্যাগের কোনো প্রয়োজন হয় না।’

পলিথিনের বাজার দাম সম্পর্কে সবজি বিক্রেতা আফজাল আলী ঢাকাটাইমসকে জানান, ‘পলিথিনের দাম খুব কম। ২০ থেকে ৪০ টাকায় ১০০ পলিথিন ব্যাগ পাওয়া যায়। ফলে এগুলো বিনামূল্যে ক্রেতাদের দিতে কোনো সমস্যা হয় না।’

বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য মতে বাংলাদেশে প্রতিদিন প্রায় গড়ে এক কোটির ওপর পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করছেন সাধারণ মানুষ।

একটা সময় ছিল যখন শহর ও গ্রামে পাটের ব্যাগ হাতে নিয়ে বাজার করতে যেতেন ক্রেতারা। কিন্তু গত কয়েক দশতে থার্মোপ্লাস্টিক জাতীয় পদার্থ দিয়ে প্রস্তুত, হালকা ওজনের সহজে বহনযোগ্য ও দামে সস্তা পলিধিন ব্যাগ দেশের প্রতিটি এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। ব্যবহারকারীদের কাছে এর চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়াতে দেশের বিভিন্ন স্থানে শত শত পলিথিন কারখানা গড়ে ওঠে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগের পরিচালক আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, ‘পলিথিনের ব্যবহার কখনই কম ছিল না। আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি।’

অবৈধ পলিথিন কারখানার কোনো পরিসংখ্যান আছে কিনা জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘কতগুলো আছে এর কোনো সঠিক সংখ্যা আমাদের জানা নেই। আমরা তথ্য পেলে অভিযান চালাই। অবৈধ কিছু পাওয়া গেলে জরিমানা ও সেগুলো জব্দ করা হয়।’

লোকবলের অভাবে অভিযান নিয়মিত চালানো যাচ্ছে না উল্লেখ করে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের লোকবলের সংকট রয়েছে। একটি এলাকায় অভিযান চালানোর পর আবার সেই এলাকায় আসতে লেগে যায় ছয় মাস। তাহলে কীভাবে নির্মূল করা সম্ভব?’

পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনায় নিয়ে ২০০২ সালে পলিথিনের উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ করে সরকার। ২০০২ সালের পরিবেশ সংরক্ষন আইনে বলা আছে, পলিথিন ব্যাগ বিক্রয়, প্রদর্শন, মজুদ ও বাণিজ্যিকভাবে বিতরণ করা যাবে না।

পরিবেশ সংরক্ষন আইন (সংশোধিত) ২০০২ অনুযায়ী, এ আইন অমান্য করলে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু বাজারে গেলে এই আইন প্রয়োগের নমুনা বোঝা যায় না।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) গবেষণায় বলা হচ্ছে, শুধু ঢাকায় প্রতিদিন ১ কোটি ৪০ লাখ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার হচ্ছে, যা প্রতি মাসের হিসেবে দেখা যায় ৪০ কোটিরও বেশি।

ওই গবেষণায় পবা ঢাকার জলাবদ্ধতার জন্য পলিথিনকে মূখ্য কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। তারা বলছে, ‘পলিথিনের ব্যাগ একবার ব্যবহার করেই ফেলে দেওয়া হয়। যার ফলে ড্রেন ও সুয়্যারেজ, নালা-নর্দমা, খাল, ডোবা ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। এই কারণে সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার প্রকোপ বেড়ে যায়।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকায় পাওয়া যায় পলিথিন তৈরির মেশিন। জায়গাও লাগে কম। ছোট ঘরে এ মেশিন বসিয়ে দানাদার পলিথিলিন থেকে পাতলা পলিথিন তৈরি করা হয়। বিভিন্ন কারখানায় মোটা পলিথিন উৎপাদনের পাশাপাশি পলিথিনের শপিং ব্যাগও তৈরি হচ্ছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক এম এ মতিন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘পলিথিন অপচনশীল দ্রব্য হওয়ায় মাটিতে সূর্যলোক, পানি এবং অন্যান্য উপাদান প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করে। আর এই পলিথিন মাটিতে পচতে প্রায় ৪০০ বছর সময় নেয়, যা পরিবেশ ও মানুষের জন্য চরম ক্ষতিকর।’

এম এ মতিন বলেন, ‘সরকার চাইলে পলিথিন একেবারেই নিষিদ্ধ করে দিতে পারে। পলিথিন ব্যাগের বিরুদ্ধে সরকারের নিয়মিত মনিটরিং নেই। যার কারণে পলিথিন উৎপাদনকারীরা সাহস পেয়ে যাচ্ছে। সরকারের নিয়মিত মনিটরিং না থাকায় শুধু ঢাকায় প্রতিদিন দেড় কোটির বেশি পলিথিন উৎপাদিত হচ্ছে। উৎপাদন খরচ একেবারেই কম বলে সহজেই সবার কাছে এটি চলে যাচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ না করলে ভবিষ্যতে পরিবেশের চরম বিপর্যয় ঘটবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল অনুষদের অধ্যাপক শহীদ আখতার হোসেন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘সারা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে পলিথিনের ব্যবহার আছে। তবে তারা ব্যবহৃত পলিথিন রিসাইকেল করে আবার ব্যবহার করে। কিন্তু বাংলাদেশের অবস্থা ভিন্ন। বাংলাদেশের মানুষ পলিথিন ব্যবহার করে যেখানে-সেখানে ফেলে দেয়। ফলে দেশে পরিবেশ বিপর্যয়ের শঙ্কা দেখা দেয়।’

শহীদ আখতার বলেন, ‘সমস্যা যেখানে আছে সেখানে সমাধানও আছে। মাথাব্যাথা হলে মাথা কেটে ফেলার কোনো প্রশ্নই আসে না। দেশে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কোনো মনিটরিং নেই। ফলে সবাই পলিথিন ব্যবহার করে যেখানে-সেখানে ফেলে রাখে। ব্যবহৃত পলিথিন এমন স্থানে ফেলতে হবে, যেখানে পরিবেশের কোনো ক্ষতি যেন না হয়।’

(ঢাকাটাইমস/০৭আগস্ট/এসও/ডব্লিউবি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

রাজধানী বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :