ইসরাইলি দখলদারি বাড়ছে তো বাড়ছেই

আবুল কাশেম, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৯:২২

ইসরাইলি সরকার দখলকৃত পশ্চিম তীরে তার বিশাল ঔপনিবেশিক প্রকল্পকে আরও বৃদ্ধি করার ঘোষণার প্রাক্কালে তেলআবিবে মৃত্যুবরণ করেছেন ফিলিস্তিন-ইসরাইলে শান্তির জন্য কাজ করা ইসরাইলের সমাজবাদী ব্যক্তিত্ব উরি অ্যাভনেরি। এটি খুবই দুঃখজনক ঘটনা। এক হাজার ইহুদি বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ এগোচ্ছে বলে জানিয়েছে ইসরাইল। ইসরাইলের এই কর্মকাণ্ডকে আমরা ভ‚মি চুরি বলে থাকি। এরই মধ্যে ৩৮২টি ঘর স্থাপনে চ‚ড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে দখলকৃত পশ্চিমতীর ও পূর্ব জেরুজালেমসহ ফিলিস্তিনিদের ভ‚মি দখল করে গড়ে ওঠা ১৪০টি কলোনিতে ৬ লাখ ইহুদি বসতি রয়েছে। এটি বিশ্বের শেষ ঔপনিবেশিক দ্ব›দ্ব এবং ফিলিস্তিনি অঞ্চলগুলোতে বিশাল নির্মাণ উদ্যোগের একটি নিরবচ্ছিন্ন প্রতিক্রিয়া।

পশ্চিম তীরের পাহাড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে লাল ছাদসমূহ, সুইমিংপুল, লন এবং আধুনিক রাস্তা, সুপার মার্কেট ও বাগান। আর এসব কিছুই ভয়ানক প্রাচীর ও কাঁটাতারের বেড়া দ্বারা আবৃত। এ বিষয়টি আমাদের মতো মধ্যপ্রাচ্যের সংবাদ প্রতিনিধিদের কাছে বড় কোনো গল্প নয়।

এটি ভ‚মি চুরির তালিকায় নতুন সংযোজন, যা আমাদের জন্য ক্লান্ত রুটিন। এমন ঘটনার পর আমাদের রুটিনের যেটুকু পরিবর্তন হয় তা খুবই সামান্য। তা হলো ইসরাইলের নতুন করে বসতি স্থাপনের ঘোষণার তথ্য আপডেট করা এবং যাদের ভ‚মি দখল করা হয়েছে সেই ফিলিস্তিনিদের বিক্ষোভ। একই সত্য ইসরাইলের গুটিকয়েক কর্মী এবং বামপন্থি গোষ্ঠীগুলোর ব্যাপারেও যারা এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। যাদের মধ্যে ছিলেন উরি অ্যাভনেরি। যখন ইসরাইল তাদের কথা শোনা বন্ধ করেছে তখনও তারা সত্যটাই বলেছে।

আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অবৈধভাবে ফিলিস্তিনি জমিতে বসবাসকারী ইহুদি ঔপনিবেশিকের সংখ্যা ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তির সময় ৮০ হাজার থেকে সাত বছরের মধ্যে বেড়ে দেড় লাখে দাঁড়িয়েছিল। আর এই বাড়তি ৭০ হাজার ইহুদির প্রত্যেকে নিষিদ্ধ ‘একতরফা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল এবং অসলো চুক্তি ব্যবহার করেই ভ‚মি দখল করেছিল। তারা তাদের নতুন বাড়ির সীমানা অতিক্রম করেছিল। কিন্তু এটা কোনো মীমাংসা নয়।

রেডক্রসের ১৯৪৯ জেনেভা কনভেনশন ইন্টারন্যাশনাল কমিটির আর্টিকেল ৪৯ এ বেশ সুনির্দিষ্ট। তা হলো দখলদারি ক্ষমতা ওই অঞ্চলের নিজস্ব বেসামরিক জনগণকে বিতাড়িত বা স্থানান্তর করতে পারবে না। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এবং সাধারণ পরিষদ, আইসিআরসি এবং আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালত এই ৪৯ নং আর্টিকেল বাস্তবায়নের ব্যাপারে একমত হয়েছে। কিন্তু এটাও কোনো মীমাংসা নয়।

পশ্চিম তীরে উপনিবেশগুলো বর্ধিত করে মাঝে মাঝে শুধুমাত্র বাইবেলের ভ‚খণ্ডে ইহুদিদের ফেরত পাঠানো হয় না বরং এটি ফিলিস্তিনিদের শাস্তিস্বরূপও করা হয়। ২০১২ সালে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে অ-সদস্য পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের অনুমোদন দেওয়ার পর এর প্রতিক্রিয়ায় সেসময় পশ্চিমতীরে নতুন তিন হাজার বসতি স্থাপনের ঘোষণা দেয় ইসরাইল। গত সপ্তাহে ফিলিস্তিনির দ্বারা একজন ইসরাইলিকে হত্যার প্রতিবাদে আদম কলোনিতে চার শ বসতি নির্মাণ করবেন বলে ঘোষণা দেন দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী এভিগডোর। তার এই বক্তৃতায় নিজস্ব ডান উইং সহকর্মীদেরও বিব্রত করেছে।

ফিলিস্তিনের আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীদের ঠেকানোর জন্য এই সীমান্ত দেয়ালকে আমরা সমর্থন করলেও পশ্চিম তীরে ইসরাইলের কাজকে সমর্থন করি না।

ক্যামব্রিজ বিশেষজ্ঞ ইয়োনাটান মেন্ডেল আমাদের কাছে এই ঘটনার একটি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, যা তার সরলতা এবং সততার মধ্যে উত্তেজনাপূর্ণ: ‘একটি একক বসতিকে একটি সুরক্ষিত প্রকল্পের শুরু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আর এটি নিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট না হওয়ার যুক্তি হিসেবে এর চারপাশে আরো বসতি গড়ে ওঠে। তারপর নতুন প্রতিষ্ঠিত বসতিগুলো সুরক্ষিত করার জন্য ব্লক করা হয় এবং এদের মধ্যে নিরাপদ চলাচলের জন্য রাস্তা তৈরি করা হয়। আর সড়ক নিরাপদ করার জন্য এবার এই সড়কের পাশেও আরো বসতি বানানো প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এমনভাবে উপনিবেশ গড়ে তুলে ফিলিস্তিনিদের থেকে নিরাপদ থাকতে দেয়াল তুলেছে ইসরাইল এবং বসতির পাশে সেনাবাহিনীর টহল বসিয়েছে দেশটি।’

মেন্ডেল লিখেছেন, এটি ক্রমবর্ধমান মহাপরিকল্পনা, যা নিরাপত্তার ওপর নিরাপত্তার স্তর তৈরি করে চলেছে, আর বসতিও দিন দিন বাড়ছে। অথচ গুরুত্বপূর্ণ সত্য হলো যে, ঔপনিবেশিকরা এবং তাদের বসতিগুলো একসময় ফিলিস্তিনিদের নিরাপত্তা হুমকির কেন্দ্রীয় কারণ ছিল। সেই অপরিহার্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা-ই এখন ইসরাইলের জন্য বড় হুমকি।

১৯৯৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব স্টেট ম্যাডেলেইনি আলব্রাইট মধ্যপ্রাচ্য সফরে গিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করেন। তখন তিনি ইসরাইলকে একতরফা কাজ থেকে বিরত থাকতে আহ্বান জানান। যার মধ্যে ছিল ফিলিস্তিনি বসতির উত্তেজনাপূর্ণ বিস্তার, ভ‚মি জব্দ, বাড়ি ধ্বংস এবং আইডি জালিয়াতি। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, সেসময় উপনিবেশ, সম্পত্তি চুরি, জালিয়াতি এবং পরিচয়পত্র গ্রহণ আলব্রাইটের চোখে পড়েনি। তিনি কি শুধু উত্তেজিত ফিলিস্তিনিদেরই দেখেছিলেন? তিনি কি ইসরাইলের আন্তর্জাতিকভাবে অবৈধ এবং নৈতিকভাবে অপমানজনক এই কাজগুলোকে নিষ্ঠুর ও খারাপ হিসেবে দেখেন না? কিভাবে তিনি এটি পারলেন?

২০০১ সালে আরিয়েল শ্যারন নিজেই বর্ণনা করেছিলেন বসতি ইসরাইলি সমাজের একটি গুণগত উপাদান এবং ঔপনিবেশিকতা বিষয়ে আমরা সেসময় বিশেষ কয়েকটি কথার মুখোমুখি হয়েছিলাম: ‘বিশ্বের ঘটনা’ বলে উল্লেখ করত ইসরাইলিরা। শ্যারনকে লেখা চিঠিতে ২০০৪ সালে জর্জ ডব্লিউ বুশ এটিকে ‘বিশ্বের নতুন বাস্তবতা’ বলে উল্লেখ করেন। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল ইসরাইলের ঘটনাকে বসতি স্থাপন, প্রতিবেশিত্ব, শহরতলি, জনগণের কেন্দ্র বলে উল্লেখ করেন এবং পশ্চিম তীরকে ‘দখলদারিত্ব অঞ্চল’ বলার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। বরং তিনি এটিকে বিতর্কিত অঞ্চল বলার আহ্বান জানান। যদি ইসরাইলিরা শুধুমাত্র ‘বিতর্কিত’ অঞ্চল ছাড়া ‘দখলকৃত’ অঞ্চলগুলোতে না থাকত তবে বর্তমানের এমন ঘটনা ঘটত না। এখানে জেনেভা কনভেনশনগুলোর প্রয়োগ করা হয়নি।

এই বিতর্কিত অঞ্চলগুলোতে অবশ্যই ‘সন্ত্রাসী হামলা’ ছিল যখন ফিলিস্তিনিরা ইসরাইলিদের ওপর হামলা করেছিল। কিন্তু এটি মারাত্মক সংঘর্ষে রূপ নেয় যখন ইসরাইলিরা ফিলিস্তিনিদের গুলি করে হত্যা করে। ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের মাঝে প্রাচীর শুধুমাত্র প্রাচীর নয় বরং এটি ‘নিরাপত্তা বেড়া’ বা বিচ্ছেদ দেয়াল। ঔপনিবেশিকতার এই চিত্র আপনাকে স্তব্ধ করে দেবে।

এখন নিরীহ পাঠক এবং দর্শক আমাদের মতো প্রতিবেদকদের জিজ্ঞাসা করতে পারেন, তাহলে কেন নিরীহ ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারীদের বিরুদ্ধে আরবদের সহিংস করে তোলা হচ্ছে? যারা বিতর্কিত অঞ্চলে বাড়ি বানাচ্ছে যা বেড়া দ্বারা চিহ্নিত ছিল। এটি মাঠ আর বাগানের পার্থক্য করার মতো বিভক্ত করা যেত? এই সব প্রতিবেশিত্ব, বেড়া, বিতর্কিত সবই এক কাপ চায়ের মাধ্যমে সমাধান করা যেত অথবা আইনজীবীদের মাধ্যমেও নিষ্পত্তি করা যেত? এমনকি বারাক ওবামা ৯ বছর আগে কায়রোতে ফিলিস্তিনিদের ‘বিচ্ছিন্নতা’ সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন। দখলদারিত্বের অবসান চান তিনি। যেমন তারা সকালে ঘুম থেকে উঠেন, আবহাওয়া পরীক্ষা করে গাজার সৈকতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন বা লেবাননে একটি সাপ্তাহিক ছুটি উপভোগ করেন, তবে তারপর আবার বাড়ি ফিরে যেতে পারেন না।

এই পরিসংখ্যান তাদের জন্য যারা নিখুঁত, নীরস এবং প্রকৃত ঘটনা জানতে চান। বর্তমানে পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেমজুড়ে ছয় লাখ ইহুদি বসতি রয়েছে এবং পশ্চিম তীরে এক হাজার বসতি স্থাপনের কাজও দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। আর সেটি অবশ্যই ইসরাইল তৈরি করবে।

সদ্য পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়া উরি অ্যাভনেরি নেতানিয়াহু, ট্রাম্প এবং তার উপদেষ্টা ও জামাতা জেরার্ড কুশনারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এছাড়া তিনি বয়কটের ক্যাম্পেইনও পছন্দ করতেন না। ২০১২ সালে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি যে, এই পরিবর্তনের পথ একদিন পরিবর্তিত হবে। অনেকটা বার্লিন ওয়াল ধ্বংসের মতো। তা কেউ ঘটার পূর্বে ভাবতে পারবে না।’ তিনি ডোনাল্ড রামসফ্লেডের সবচেয়ে কুখ্যাত উক্তি ব্যবহার করে বলেন, ‘এটি ঘটবে!’

আমি কী তার কথায় একমত এখনো নিশ্চিত নই।

দ্য ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আবুল কাশেম

রবার্ট ফিস্ক: দ্য ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকার মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি

সংবাদটি শেয়ার করুন

আন্তর্জাতিক বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

আন্তর্জাতিক এর সর্বশেষ

কলকাতা হাইকোর্টের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ মমতার

ভারী বৃষ্টিপাতে ক্ষতিগ্রস্ত কারাগার, পালালো শতাধিক বন্দি 

ভারতে লোকসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় পর্বে ১৩ রাজ্যের ৮৮ আসনে ভোটগ্রহণ শুক্রবার

ইরানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে গ্রেপ্তার করতে চায় আর্জেন্টিনা, কিন্তু কেন?

স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ, দায়িত্বপালন থেকে বিরত থাকবেন স্পেনের প্রধানমন্ত্রী 

ইউক্রেনকে গোপনে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র

ইসরায়েল-ইরান সংঘাত: সিরিয়া কি নতুন যুদ্ধক্ষেত্র হবে?

ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিবে জ্যামাইকা

পাকিস্তানের পর এবার শ্রীলঙ্কা সফরে ইরানের প্রেসিডেন্ট

বিরল সফরে ইরানে উত্তর কোরিয়ার প্রতিনিধিদল

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :