জন অরণ্যে তুমি একা...
আদিম কাল থেকেই মানুষ যূথবদ্ধ জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলো, বলা হয় মানুষ সামজিক জীব, সমাজেই তার বসবাস। মানুষ একা বাঁচতে পারে না। বেঁচে থাকার জন্য সহযোগিতা প্রয়োজন। সভ্যতার শুরু থেকেই বিনিময় প্রথা ছিলো। একে অপরের সাথে পণ্য, সেবা বিনিময় করতো। আগের গ্রাম গুলোও ছিলো একেকটা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের মতোই। একে অপরের প্রয়োজন মিটিয়ে উদ্বৃত্ত সম্পদ বিনিময় করে নিজেদের চাহিদা পূরণ করতো।
সময় এখন দ্রুত যাচ্ছে, গতিময়তাকেই জীবন বলা হয়। থমকে থাকায় সুযোগ নেই। থেমে গেলে আপনি পিছিয়ে যাবেন। উন্নয়নশীল বাংলাদেশের মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরে সবচেয়ে জোড়ালো ভূমিকা রেখেছে দেশের জনশক্তি। বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে মোট কতজন বাংলাদেশি এই মুহূর্তে দেশের বাইরে আছেন, তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া মুশকিল।
মূলত চার ধরনের জনশক্তি আমরা দেশের বাইরে রপ্তানি করি, (১) পেশাজীবী (২) দক্ষ শ্রমিক, (৩) মাঝারি দক্ষ শ্রমিক ও (৪) অদক্ষ শ্রমিক। দুঃখের বিষয় হচ্ছে মাত্র ৪% পেশাজীবী আমরা পাঠাতে পারছি। ৩৩% দক্ষ, ১৫% মাঝারি মানের দক্ষ ও প্রায় অর্ধেক জনশক্তি ৪৮% অদক্ষ শ্রমিক দেশের বাইরে যাচ্ছে। এখানে উল্লেক্ষ্য যে, প্রতিযোগিতার বিশ্বে টিকে থাকার জন্য দক্ষতা ভীষণ প্রয়োজন। এই ৪৮% যদি পেশাজীবী হতো তাহলে এই দেশের প্রতিবিম্ব একেবারেই ভিন্ন হতে পারতো। এইদেশের মানুষ জীবনের পরোয়া না করে সমুদ্র পথেও বিদেশ যাবার স্বপ্নে বিভোর, কত তাজা প্রাণ যে সাগরের নোনা জলে সমাহিত হয়েছে.....
গ্রামীণ অর্থনীতি নির্ভর বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষ গ্রামেই বাস করেন। জীবন ও জীবিকার তাগিদে তাদের স্বজনেরা শহরে, বন্দরে কাজ করেন। যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবারের প্রচলন এখানে রকেট গতিতে এগিয়ে চলছে। বলা হচ্ছে, প্রতিদিন এক ঢাকা শহরেই ৪/৫ লাখ লোক কোন না কোন কাজে আসেন আবার কাজ শেষে ফিরেও যান। আর এর উপর ১৭০০ জন লোক প্রতিদিন এই নগরে আশ্রয়ের জন্য ঢুকছেন। কতজন বেরিয়ে যাচ্ছেন এর সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও এই পরিমাণ যে একেবারেই নগণ্য তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। দেশের মোট জনসংখ্যার ১২% লোক এখন এই শহরে আছেন। এর বাইরে চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, রাজশাহীতেও প্রচুর মানুষ বসবাস করে থাকেন।
নানা কারণেই মানুষ তার ঠিকানা পরিবর্তন করে থাকেন। অর্থনৈতিক কারণেই মূলত মানুষ স্থানান্তরিত হয় বেশি। এর পাশাপাশি নদী ভাঙন, বেকারত্ব, ভূমিহীনতা, কাজের অভাব ও অতি দারিদ্র্য অন্যতম। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবেও স্থানান্তরিত হচ্ছে বা হবে অনেক মানুষ।
দেশ ও দেশের বাইরে যারা আছেন তাদের সিংভাগ আবার সুযোগ ও সামর্থ্য না থাকায় একা থাকে। পরিবার পরিজন থাকেন দেশে বা গ্রামের বাড়িতে। পরিবারের স্বচ্ছলতা ও দেশের অর্থনীতির এই চালিকাশক্তির কথা আসলে আমরা কতজন ভাবি? প্রবাসে বা শহরে যারা আছেন তারা কেমন আছেন, কি করছেন এই ব্যাপারে অনেকেরই সুস্পষ্ট ধারণা না থাকলেও প্রত্যাশার পারদ কখনো নিম্নমুখী হয় না।
আমাদের সম্পদ সীমিত, কিন্তু চাহিদা অসীম, অর্থনীতিবিদগণ তাই বলেন। যাবতীয় চাহিদা মেটানোর পরেও থাকে কিছু বাড়তি আবদার। আর এই সব আবদার করার জন্য যদি তালিকা করা হয়, তবে প্রথমেই থাকবে শহরে বা প্রবাসে থাকা কোন স্বজন এর নাম। হাসিমুখে সেই আবদার তারা পূরণ করেও থাকেন।
‘নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস, ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস’; সবাই কি বোঝেন ব্যথিতের বেদন? অনেক বন্ধু, স্বজন আছেন দেশের বাইরে। একটু অবসর পেলে ফোন করেন, অনেক লম্বা সময় নিয়ে কথা বলেন, আমরা প্রায়সই বিরক্ত হই, তারা কিন্তু গাঁটের পয়সা খরচ করেই খোঁজ খবরটুকুও নিচ্ছেন। এমন পরিবারের ছেলেও এখন প্রবাসে আছেন, যে একসময় ছিলেন খবই অবস্থাসমপন্ন। প্রচুর জমি জমা থাকার পরেও সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে এখন অমানসিক পরিশ্রম করছেন। পরিবারের দিকে তাকিয়ে দেশেও আসতে পারছে না, এটাই জীবন...
এমন একজন কে আমি জানি, যার বাবা এই পৃথিবীতে থেকেও নেই, জন্মের পরেই অন্য একজনকে বিয়ে করে স্ত্রী সন্তানদের খোঁজ নেননি আর। মায়ের বয়েস অল্প, সাথে এই বাচ্চা, কে দ্বায়িত্ব নিবে? বিয়ে দিয়ে দেয়া হয় তার নানা বাড়ি থেকে, আর ছেলেটির জায়গা হলো চাচাদের কাছে। কিন্তু কে নিবে এই হনুমানের (ভুল করে হয়তো মানুষ হয়ে জন্মেছে সে!) ভার? সমবয়েসী চাচাতো ভাই বোনদের সাথে স্কুলে যাওয়া তো দূরের কথা, খেলাধুলার সুযোগটুকুও পায়নি।
১৫/১৬ বছর বয়সে বয়েস বাড়িয়ে পাসপোর্ট বানিয়ে মামা বাড়ির কোন এক আত্নীয়ের সহায়তায় সৌদি আরবে চলে আসে। আজ প্রায় ১৭ বছর এই ছেলে ওখানেই আছে, দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন নিয়মিত মায়ের কাছে। স্বামী সন্তান নিয়ে মায়ের এখন ভরা সংসার। জমি জমা, সহায়-সম্পদ সবই ভোগ দখলে আছে তাদের, এই সম্পদ এখন তার গলার কাঁটা। আদৌ সে এই সম্পদ ফিরে পাবে কি না, সেই ভয়ে দেশেই আসছে না...
এমন আরো একজন আছেন, যিনি ঢাকায় থাকেন। তিন বোন আর ছোট এক ভাই রেখে বাবা পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন, সংসারের ভার তাকেই বইতে হয়েছে। ভাই বোনদের পড়ালেখা করানো ও বিয়ে দিয়েছেন। ছোট ভাইকে পাঠিয়েছেন ইতালিতে। বোনদের বিয়ে দিতে দিতে তার বয়েস এখন ৫৫, ইতিমধ্যে মা মারা গিয়েছেন। বাবা জমি জমা কিছুই রেখে যেতে পারেননি, বসত ভিটেই সম্বল, সংসারের খরচ যোগাড় করতে গিয়ে জমি জমা বা সম্পদ কিছুই করতে পারেননি। অবসরে গিয়ে তিনি কি নিয়ে থাকবেন এই ভাবনায় অবসরেও যেতে চাইছেন না। ইদানীং খুব বিষন্ন দেখায়...
জীবন ও জীবিকার জন্য এই ত্যাগ এর কোন মূল্যায়ন নেই? হয়তো এভাবেই হারিয়ে যাবে কিছু দুর্লভ মানব জীবন। জীবন একটাই আর সময় কারো জন্য অপেক্ষাও করে না। ছুটে চলার এই জীবনে আমরা সবাই একা। পরিবারের জন্য কিছু করতে গিয়ে কেউ কেউ হারিয়ে ফেলছেন নিজেকেই, তার বিনিময়ে ভালো থাকে তাদেরই স্বজন। কিন্তু এই ৭০০ কোটি মানুষের ভিড়ে এই একাকীত্বের শেষ নেই...
আমার দাদু থাকেন গ্রামের বাড়িতে, শহরে তার ভালো লাগে না, মফঃস্বলে থাকেন মা, সহায়সম্পদ যা কিছু আছে তার দেখভাল ও সবার সাথে সমন্বয়ের কাজটুকু তিনিই করে থাকেন। পাঁচ ছেলে মেয়েকে মানুষ করে তিনিও আজ একা, ভীষণ একা। ছেলে মেয়ে, মা, শাশুড়ি সবাইকে দেখে রাখতে হয়। নাতি নাতনিদের আবদার, গ্রামের সহায়সম্পদ, শহরের দালানকোঠা থেকে ছেলের ঢাকার বাসায় রান্না ঘরের মসলা শেষ কি না, চাল লাগবে কি? হলুদ কিনে রোদে শুকাতে হবে, তার পর কলে ভাঙিয়ে তা ছেলে মেয়েদের বাসায় পাঠাতে হবে... অনেক কাজ যে তার।
সেদিন আম্মাকে ফোন করেছিলাম রাতে, জিজ্ঞাসা করলাম, ‘খেয়েছো?’। এড়িয়ে যাচ্ছিলেন, বললেন, ‘মুড়ি খেয়েছি, রান্না করতে ইচ্ছে করছে না।’ অথচ খুব ভোরে ঢাকায় আসবো বলে চারটায় উঠে আমার জন্য রান্না করে দিয়েছেন । খুব খারাপ লাগা থেকেই মেয়েদের স্কুল কামাই করেও এক সপ্তাহের জন্য আম্মার কাছে রেখে এসেছি আমার পরিবার। আমি তো চাকরি করি, অফিস তো আর আবেগ বোঝে না। মাত্র চারদিন আমি একা আছি, এবার আমার ছোট মেয়ে সায়রা নিহাদ ফোন করে প্রতিদিন শুধু একটা কথাই বলে ,‘বাবা তুমি আসবা না?’। বুকের ভেতর অদ্ভুত দহন, দম বন্ধ হয়ে আসছে...
দিনের পর দিন, বছরের পর বছর যারা দেশের বাইরে বা নিজের বাড়ির বাইরে থাকেন, পরিবার পরিজন ছাড়া আপনারা কেমন আছেন...
লেখক: উন্নয়ন ও অধিকার কর্মী