প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা থাকবে তো?

কাওসার রহমান
 | প্রকাশিত : ১১ অক্টোবর ২০১৮, ০৯:০০

কোনো একটি দেশের অর্থনীতি পরিমাপের মাপকাঠি হচ্ছে জিডিপি প্রবৃদ্ধি। মহাজোট সরকারের প্রায় ১০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি স্থিতিশীল জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। এ সময়ে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি দুটি মাইলফলক অর্জন করেছে। প্রথম দফায় ৫ শতাংশের বেড়াজাল ভেঙে ৬ শতাংশের ক্লাবে ওঠে প্রবৃদ্ধি। দ্বিতীয় দফায় ৬ শতাংশের বৃত্ত ভেঙে ৭ শতাংশের ক্লাবে যোগ দেয় এই প্রবৃদ্ধি। বর্তমানে ৭ শতাংশের বৃত্ত ভেঙে ৮ শতাংশের মাইলফলক অর্জনের পথে রয়েছে দেশের অর্থনীতির এই মাপকাঠিটি।

সংরক্ষণবাদী বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগীরা এই প্রবৃদ্ধির স্বীকৃতি দিতে বেশ বিলম্ব করলেও অবশেষে তারা এদেশের এই অর্জনকে মেনে নিয়েছে। এখন উন্নয়ন সহযোগীরাই বলছেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তথা আর্থিক বৃদ্ধি ৭ শতাংশের ওপরে অর্জিত হবে। সম্প্রতি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) তার ‘এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক ২০১৮’ তে বলেছে, গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশে ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। আর বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহে ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকায় চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৭ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি পেতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে। আর জিডিপির আকার ২৭৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। উল্লেখ্য, গত তিন অর্থবছরে ৭ শতাংশ ছাড়ানো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পর চলতি অর্থবছরের বাজেটে বাংলাদেশ সরকার ৭ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য ঠিক করেছে।

চলতি অর্থবছরটি হচ্ছে নির্বাচনের বছর। এ বছরে দেশের অর্থনীতির গতি কিছুটা শ্লথ থাকবে। কারণ নির্বাচনের ডামাডোল এবং নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর্বে অন্তত তিন মাস দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা- মন্থর থাকবে। সরকারি অর্থ ব্যয়ও বিশেষ করে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বাস্তবায়ন কমে যাবে। যার প্রভাব দেশের অর্থনীতিতে পড়াটা স্বাভাবিক।

যদিও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলছেন, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন, অর্থনৈতিক কার্যক্রমে বিরূপ প্রভাব পড়বে না। তার মতে, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন অনেক উঁচুতে অবস্থান করছে। গত ১০ বছরে প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় দেশে এমন একটি উপযুক্ত ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে, যেটা বজায় থাকবে। ফলে কোনো কিছুতে এটা বাধাগ্রস্ত হবে না।

তবে অর্থমন্ত্রীর মতো নির্বাচন নিয়ে শঙ্কিত নয় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকও। তারাও বলছে, গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ২ শতাংশ; আগের বছরে যা ৩ শতাংশ ছিল। শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি ১০ দশমিক ২ শতাংশ থেকে বেড়ে ১২ দশমিক ১ শতাংশ হয়েছে। তবে সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে কিছুটা কমে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ হয়েছে। এই তিন খাতেই চলতি অর্থবছরে ভালো প্রবৃদ্ধি হবে। ভোগ্যপণ্যের ব্যবহার এ অর্থবছরে বাড়বে এবং সরকারি বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনে অবদান রাখবে বলে এডিবি মনে করছে। এছাড়া বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সেবা ও শিল্প খাতও বড় অবদান রাখবে। ফলে ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন ঘিরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তেমন কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।

শুধু নির্বাচন নয়, বাংলাদেশের জন্য আরও একটি শঙ্কার কারণ হচ্ছে চলমান বৈশ্বিক বাণিজ্য-যুদ্ধ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সৃষ্ট এ বাণিজ্য-যুদ্ধে এখন অনেক দেশই জড়িয়ে পড়ছে অথবা যুক্তরাষ্ট্র অনেক দেশকেই এই যুদ্ধে জড়াতে বাধ্য করছে তার কর্মকা-ের মাধ্যমে। এ যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতির গতি শ্লথ হয়ে পড়বে। বৈশ্বিক বাণিজ্য সংকুচিত হবে। ফলে তার একটি প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পড়াটা স্বাভাবিক। তবে এডিবি তার পূর্বাভাসে বলছে, ‘বাণিজ্য-যুদ্ধের’ কারণে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ধীর গতির আশঙ্কা থাকলেও বাংলাদেশের রপ্তানি এবং রেমিট্যান্স প্রবাহে ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকবে। পাশাপাশি আমদানি ব্যয়ও কিছুটা কমবে। ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি বাণিজ্য-যুদ্ধে ক্ষতির হাত থেকে বেঁচে যাবে।

এডিবির পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০১৮ সালে এশিয়ার প্রবৃদ্ধি হবে ৬ শতাংশ। ২০১৯ সালে তা কমে ৫ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে আসতে পরে। সেখানে বাংলাদেশের ৭ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ‘খুবই ভালো’।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষ বছরে অর্থাৎ ২০০৮-০৯ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল ৫.১৪ শতাংশ। এখান থেকেই মূলত দেশের আর্থিক বৃদ্ধির উত্থান শুরু হয়। সেখান থেকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের প্রথম অর্থবছরেই জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ওপরে উঠে যায়। অর্থাৎ ২০০৯-১০ অর্থবছরে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয় ৬.০৭ শতাংশ। পরের ২০১০-১১ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬.৭১ শতাংশে। ২০১১-১২ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয় ৬.২৩ শতাংশ। ২০১২-১৩ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয় ৬.০৩ শতাংশ। আর মহাজোট সরকারের প্রথম পাঁচ বছরের মেয়াদের শেষের বছরে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয় ৬.০১ শতাংশ। এই সরকারের পাঁচ অর্থবছরের দেশের গড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬.২১ শতাংশ।

সরকারের শেষ বছরে (২০১৩-১৪) জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অস্থিরতাজনিত পরিস্থিতি সত্ত্বেও ছয় শতাংশের ওপরেই (৬.০১ শতাংশ) জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়। অথচ সব উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল এ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের নিচে নেমে যাবে। এখানে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো ১৯৯১ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির গড় হার ছিল ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৬ দশমিক ২ শতাংশে।

বর্তমান সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম অর্থবছর ২০১৪-১৫ সালে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয় ৬.৬ শতাংশ। প্রায় এক দশক ৬ শতাংশের বৃত্তে ‘আটকে’ থাকার পর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রথমবারের মতো ৭ শতাংশের ‘ঘর’ অতিক্রম করে। এ বছর প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয় ৭.১ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এই ধারাবাহিকতায় চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি পেতে পারে বলে এডিবি মনে করছে। যদিও এ অর্থবছরের বাজেটে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭.৮ শতাংশ।

চূড়ান্ত হিসাবে দেখা যায়, গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জিডিপির আকার দাঁড়িয়েছে ২৭৪ বিলিয়ন ডলারে। এর আগের অর্থবছরে (২০১৬-১৭) জিডিপির আকার ২৫০ বিলিয়ন ডলার ছিল। তার আগের অর্থবছরে (২০১৫-১৬) ছিল ২২১ বিলিয়ন ডলার।

টানা ১০ বছর ৬ ও ৭ শতাংশের ওপর প্রবৃদ্ধি ধরে রাখাটা এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার। সেই অবিশ্বাস্য সাধন করেছে বাংলাদেশ। ২০১৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফিচ গ্রুপের বিএমআই রিপোর্টে ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধির নেতৃত্বের তালিকায় বাংলাদেশসহ ১০টি দেশের নাম উঠে এসেছিল। ওই প্রতিষ্ঠানটি বলেছিল, আগামী ১০ বছর বাংলাদেশসহ ১০টি দেশের বাজার বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে নেতৃত্ব দেবে। বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী শিল্প খাত আর কয়েক বছরের মধ্যেই বিশ্বের অন্যতম উৎপাদন অঞ্চলে পরিণত হবে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান এক-চতুর্থাংশের বেশি। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে প্রশংসনীয় প্রবৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিচ্ছে তৈরি পোশাক এবং অবকাঠামো নির্মাণ খাত। ফলে বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নতুন চালিকাশক্তি হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ফিচ গ্রুপের বিএমআই রিপোর্টই সত্যি হয়েছে। বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নতুন চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ এখন ৮ শতাংশের মর্যাদাকর প্রবৃদ্ধি অর্জনের স্বপ্ন দেখছে। সেই স্বপ্নের দ্বারপ্রান্তে এখন বাংলাদেশ। কিন্তু এই প্রবৃদ্ধি অর্জন শুধু সরকারি খাতের বিনিয়োগের ওপর নির্ভর করে সম্ভব হবে না। গত অর্থবছর দেশে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল জিডিপির ৩১ শতাংশ। জাতীয় এই বিনিয়োগের মূল চালিকাশক্তি ছিল সরকারি বিনিয়োগ। সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসাবে কাজ করে বেসরকারি খাত। কোনো দেশেই মোট বিনিয়োগে বেসরকারি খাতের অবদান ৮০ শতাংশের নিচে হয় না। কিন্তু আমাদের এখানে বেসরকারি খাত যে পরিমাণে বিনিয়োগ করার কথা সে পরিমাণে বিনিয়োগ করছে না। এজন্য বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে। ওই পরিবেশ তৈরি করতে না পারলে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়বে না। সেই দিকটি মাথায় রেখে সরকারকে এগুতে হবে। ভবিষ্যতে ৮ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য সরকারি ও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ আরও বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।

কাওসার রহমান: নগর সম্পাদক, দৈনিক জনকণ্ঠ

সংবাদটি শেয়ার করুন

অর্থনীতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

অর্থনীতি এর সর্বশেষ

কার্ডহোল্ডারদের জন্য গ্রীনপিন সেবা চালু করলো এনসিসি ব্যাংক 

অগ্রণী ব্যাংক কর্মচারী সংসদ সিবিএ কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আবু জাফর 

ইসলামী ব্যাংকের কুমিল্লা জোনের কর্মকর্তা সম্মেলন অনুষ্ঠিত

জনতা ব্যাংকের নতুন ডিএমডি মো. ফয়েজ আলম

‘গ্রিন ফ্যাক্টরি অ্যাওয়ার্ড-২০২৩’ পেল ওয়ালটন

আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকার কমানোর পরামর্শ আইএমএফের

তাপপ্রবাহ: ২ হাজার শ্রমজীবীকে সোনালী ব্যাংকের ছাতা উপহার

রংপুরে জনতা ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক সম্মেলন অনুষ্ঠিত

ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স অ্যাওয়ার্ড পেল ইসলামী ব্যাংক

সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের উপশাখাসমূহের বার্ষিক ব্যবসায়িক সম্মেলন অনুষ্ঠিত

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :