সেই ‘সুইসকন্যা’কে হারানো মেয়ে দাবি আরেক মায়ের

মমিনুল ইসলাম বাবু, কুড়িগ্রাম
  প্রকাশিত : ২৬ জানুয়ারি ২০১৯, ০৯:০৬
অ- অ+

হারিয়ে যাওয়ার ৪৫ বছর পর মা-বাবার খোঁজে কুড়িগ্রামে এসেছিলেন সুইজারল্যান্ডের রওফা। সপ্তাহখানেক উলিপুর-চিলমারীতে হন্যে হয়ে খুঁজেও নিজের শিকড়ের সন্ধান না পেয়ে গত সপ্তাহে সুইজারল্যান্ডে পালক বাবা-মায়ের কাছে ফিরে গেছেন তিনি। নিজেকে সেই ‘সুইসকন্যা’র মা দাবি করে এখন দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন মেয়ে হারানো আরেক দুঃখী মা রফিতন বেওয়া।

ঘটনার অনেক অমিল থাকলেও রফিতনের দাবি, একই সময়ে (চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ) হারিয়ে যাওয়া তার নাড়িছেঁড়া ধন শাহেরাই এখনকার সুইজারল্যান্ডের রওফি।

তবে প্রবাসী কন্যা রওফির দাবি, সাড়ে তিন বছর বয়সে হারিয়ে যাওয়ার সময় তার নাম ছিল খোদেজা। হারিয়ে যাওয়ার পর বেসরকারি সাহায্য সংস্থা ‘টেরেডেস হোমস’-এর শিশুদের নোঙরখানা চিলমারীর ছিন্নমুকুলে তার আশ্রয় মেলে। এখানে চার বছর থাকার পর ১৯৭৮ সালে সুইজারল্যান্ডের এক দম্পতি তাকে দত্তক নিয়ে চলে যান। এরপর থেকে দীর্ঘ ৪২ বছর ধরে জেনেভা শহরে বেড়ে ওঠেন রওফি ওরফে খোদেজা।

স্বামী ও প্রবাসী বন্ধুদের সহায়তায় নাড়ির টানে জন্মভূমি বাংলাদেশে এলেও হারিয়ে যাওয়া বাবা-মা বা পূর্বসূরিদের খোঁজ পাননি বর্তমানে সুইজারল্যান্ডের শিক্ষিকা রওফা ওরফে খোদেজা। আর ফিরে যাওয়ার তিন দিন পর গতকাল সকালে মায়ের দাবি নিয়ে কুড়িগ্রাম জেলা ও পুলিশ প্রশাসন চত্বরে তাকেই খুঁজে ফিরছিলেন সন্তান হারানো মা রফিতন। এ জন্য তার সঙ্গে সাক্ষাতের সহায়তাও চান সাংবাদিকদের কাছে।

রফিতন বেওয়া জানান, উলিপুর উপজেলার দলদলিয়া ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের অর্জুন গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন তিনি। এখন থাকেন রাই ইউনিয়নের থেথরাই গ্রামে, যেখানে গিয়েছিলেন রওফা ওরফে খোদেজা। তার স্বামী ছাত্তার আলী ২২ বছর আগে মারা যান। স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন তিনি। এই সংসারে তার দুই মেয়ে ও এক ছেলে। বড় মেয়ে শাহেরা ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় খাবারের খোঁজে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে গিয়ে হারিয়ে যায়। সে সময় তার বয়স ছিল ৭-৮ বছর। এরপর অনেক খুঁজেও তাকে আর পাওয়া যায়নি।

আবেগাপ্লুত রফিতন বলেন, ‘ঘরোত খাবার নাই। চারপাকোত মঙ্গা। খাবার দিবের পাং না। ছওয়াটা মোর হারি গেইল।’

সুইজারল্যান্ডের রওফি থেথরাইয়ে থাকাকালে তিনি ছোট মেয়ের বাড়িতে অবস্থান করায় দেখা হয়নি। পরে ফেসবুকে ঘটনা জানাজানি হলে প্রতিবেশীরা তাকে খবর দেন।

অনেক আশা নিয়ে ছেলে রফিকুলসহ কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে এসেছিলেন রফিতন। ছুটির দিন হওয়ায় সেখানে তখন সুনসান নীরবতা। বড় বড় তালা ঝুলছে অফিসগুলোতে। চারদিকে ফ্যাল ফ্যাল চোখে লোকজন খুঁজছিলেন তিনি। কাকে কী বলবেন বুঝতে পারছিলেন না। পরে সাংবাদিকদের নজরে এলে তিনি চোখের পানি মুছতে মুছতে বলেন, ‘মোর বেটি কই? একনজর তাক মুই দেখিম। তোমরা একনা ব্যবস্থা করি দেও।’

রফিতন বেওয়ার ছেলে রফিকুল থেথরাই বাজারে ঝালবুটের দোকানি। তিনি জানান, হারিয়ে যাওয়া শাহেরা ছিল সবার বড় বোন। সে কয়েক মাস স্কুলেও পড়েছিল। তার বাবা ছাত্তার আলী ছিলেন ধবধবে ফরসা, মাও ফরসা। তারা প্রথমে দলদলিয়ার অর্জুন গ্রামে থাকলেও তিস্তার ভয়াবহ ভাঙনে সেই বাড়ি বিলীন হয়ে যায়। এর ছয় বছর পরে ২০১৩ সালে তারা থেথরাই শেখের খামার গ্রামে ওয়াপদা বাঁধে আশ্রয় নেন। এখনো মাকে নিয়ে সেখানেই অবস্থান করছেন তারা।

রফিতন ও রফিকুলের কথার সঙ্গে সুইজারল্যান্ডের রওফার অনেক অমিল রয়েছে। রওফা শ্যামবর্ণের হলেও রফিতন ও তার স্বামী ছিলেন অনেক ফরসা। রওফি সাড়ে তিন বছর বয়সে হারিয়ে যাওয়ার কথা বললেও রফিতন বেওয়ার মেয়ে শাহেরা হারিয়ে যায় ৭-৮ বছর বয়সে। দুজনের নামের মধ্যেও রয়েছে গরমিল। এ ছাড়া ১৯৭৪ সালে তারা ছিলেন পাশের দলদলিয়া ইউনিয়নের অর্জুন গ্রামে।

দুই পক্ষের বর্ণনার মধ্যে যথেষ্ট ফাঁরাক থাকলেও এক হারিয়ে যাওয়া মেয়ের আকুতি আর মেয়ের খোঁজে মায়ের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ানো এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে।

রাই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল জলিল শেখ বলেন, ‘রফিতনের হারিয়ে যাওয়া মেয়ের ঘটনা আমরা এলাকার সবাই জানি। এর আগেও হারিয়ে যাওয়া মেয়ের খোঁজে চট্টগ্রামে গিয়েছিলেন তিনি। বর্তমানে সুইজারল্যান্ডের বাসিন্দা রওফার সঙ্গে রফিতনের মেয়ের অনেক মিল পাওয়া যায়। বিষয়টি নিষ্পত্তিতে প্রয়োজনে দুজনের ডিএনএ টেস্ট করে দেখা দরকার। তাহলে বিধবা রফিতন মনে একটু শান্তি পাবেন।’

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
র‍্যাব সদর দপ্তরে আইনবিষয়ক সেমিনার ও এআই প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত
নারায়ণগঞ্জে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শহীদদের স্মরণে 'জুলাই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ' উদ্বোধন
দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাকে পিকআপের ধাক্কায় ব্যবসায়ী নিহত
অটোচালককে হত্যা: মির্জাপুরে জড়িতদের ফাঁসির দাবিতে মানববন্ধন
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা