আসুন দেশ-জাতি ও মাতৃভাষার জন্য কাজ করি

মো. মনিরুজ্জামান মনির
  প্রকাশিত : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৯:২৪
অ- অ+

মানুষের জন্য মাতৃভাষা স্রষ্টার দেয়া অফুরান দয়া ও অনুগ্রহ। মাতৃভাষা ব্যতীত কোনও জাতি তাদের মনের ভাবপ্রকাশ করতে পারে না। মানবজাতির অস্তিত্বের মূল অবলম্বন হলো মা-মাতৃভাষা-মাতৃভূমি। আর তাই মাতৃভাষা হলো মায়ের ভাষা। মায়ের ভাষাতেই মানুষ অতিসহজে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে। এই যোগ্যতা ও অধিকার স্রষ্টাই মানুষকে দান করেছেন।

পবিত্র কুরআনে সুরা রুমের ২২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘ওয়ামিন আ-ইয়াতিহি খালকুস সামাওয়াতে ওয়াল আরদি ওয়াখ তিলাফু আল সিনাতিকুম ওয়া আলওয়ানিকুম; ইন্না ফিজালিকা লাআ-ইয়াতিল্লিল আলামিন।’ অর্থাৎ ‘তাঁর (আল্লাহর) নিদর্শনাবলীর মধ্যে একটি নিদর্শন আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য; এতে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ সুরা আর রাহমানের ৩ ও ৪ নম্বর আয়াতেও মানুষের সৃষ্টি পরবর্তী মনের ভাব প্রকাশের বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।

অথচ আমাদের বাঙাালিদের আল্লাহ তায়ালার দেয়া অধিকার হরণ করার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে ঘৃণীত চক্রান্ত শুরু হয়। শত্রুরা পৃথিবীর মানচিত্র থেকেই মুছে দিতে চেয়েছিল আমাদের মায়ের ভাষা বাংলাকে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী বিশ্বের মানবসভ্যতার ইতিহাসে সর্বপ্রথম মাতৃভাষার মান-মর্যাদার ও অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবীতে আন্দোলন শুরু হয়।

এ আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ের শুরুতে পশ্চিম পাকিস্তানের জালিম সরকারের নির্বুদ্ধিতা, অহমিকা ও গোমরাহীর কারণে হানাদারদের পেটোয়াবাহিনীর গুলিতে সর্বপ্রথম মাতৃভাষার জন্য নিহত হন বাংলার গর্বিত সন্তান রফিক, বরকত, সালাম, জব্বার, শফিউরসহ আরও অনেকে। এর প্রতিবাদে সারা দেশের ছাত্র-ছাত্রীরা রাস্তায় নেমে আসে এবং মাতৃভাষা বাংলা চাই দাবীতে আন্দোলন জোরদার করে।

আন্দোলনে শহীদদের স¥রণীয় করে রাখার জন্য ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা সাঈদ হায়দারের নক্সানুযায়ী তৈরি করেন ২১ এর সর্বপ্রথম শহীদ মিনার। ২৪ ফেব্রুয়ারী এটি উদ্ভোধন করেন শহীদ শফিউর রহমানের পিতা। উক্ত শহীদ মিনারটির দৈর্ঘ্য ছিল ১১ ফুট।

১৯৫২ সালে ২১ নিয়ে প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’ লেখেন চট্রগ্রামের তৎকালীন সীমান্ত পত্রিকার সম্পাদক ও চট্টগ্রাম ভাষাসংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক মাহাবুবুলআলম চৌধুরী। ২১ এর সর্বপ্রথম হৃদয়স্পর্শ করা গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি’ লেখেন কলামিস্ট লেখক ও গবেষক আব্দুল গাফফার চৌধুরী। এর সুরকার ছিলেন শহীদ আলতাফ মাহমুদ। এছাড়া ১৯৫৩ সালের ১৭ জানুয়ারী ২১ নিয়ে প্রথম নাটক রচনা করেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত লেখক মুনীর চৌধুরী।

২১ নিয়ে সর্বপ্রথম উপন্যাস ‘আরেক ফাল্গুন’ লেখেন উপন্যাসিক ও চলচ্চিত্রকার ৭১ এর শহীদ বুদ্ধিজীবী জহির রায়হান। ২১ নিয়ে ১৯৫৩ সালে ‘২১শে ফেব্রুয়ারী’ নাম দিয়ে প্রথম সাহিত্য সংকলন বের করেন দেশবরেণ্য কবি হাসান হাফিজুর রহমান। এবছরেই ২১ নিয়ে প্রথম লিফলেট ছাপা হয়; যা বিতরণের দায়িত্ব পালন করেন বাংলার তিন কবি ও লেখক হাসান হাফিজুর রহমান, রফিকুল ইসলাম ও আমীরআলী। এছাড়া ১৯৫৩ সালের ২১ এর প্রথম আলোকচিত্র প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন বাংলার আরেক গর্বিত সন্তান শিল্পাচার্য জয়নুলআবেদীন।

এসব লেখনী আর আয়োজনের মধ্য দিয়ে বাঙালির মধ্যে মাতৃভাষা চেতনা আরো বেশি করে জাগ্রত হয়। ফলে বাংলা ভাষার দাবিতে ৫২-এর আন্দোলন একটা পরিণতির দিকে এগুতে থাকে। যা ৭১-এ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করে।

এরই ধারাবিহকতায় ৪৭ বৎসর পর বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের আতœত্যাগের স্বীকৃতি হিসাবে ‘জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা’ ইউনেস্কোর ৩১তম সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রস্তাবিত মহান ২১শে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্বব্যাপী পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়। বিশ্বের ১৮৮টি দেশের প্রতিনিধিরা এই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিলটি পাস করেন। নিঃসন্দেহে ওই দিনটি বাংলাদেশের জনসাধারণের জন্য অতি গৌরব, সম্মানের ও ঐতিহ্যময় দিন।

এই সাফল্যময় উদ্যোগটি প্রথম গ্রহণ করেছিলেন কানাডীয় ১০ সদস্য বিশিষ্ট একটি সংগঠন ‘মাতৃভাষা প্রেমিক গ্রুপ’। ১০ জনের মধ্যে ছিলেন বাংলার আরেক সাহসী সন্তান রফিকুল ইসলাম। তিনি তৎকালীন জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনানের কাছে প্রস্তাব পেশ করেন। এরপর থেকে ২০০০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী বিশ্বের ১৮৮টি দেশে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হয়। এ ধারাবাহিকতায় এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস গোটা বিশ্বে পালিত হচ্ছে। এটি বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে অতিসাহসী, গুরুত্বপূর্ণ ও পরিচিত জাতি হিসেবে তুলে ধরেছে।

তাই আসুন, আমরা সকলে মিলে গভীর শ্রদ্ধা ও ভক্তি সহকারে এদিনকে স্মরণ করি। যে শহীদদের আত্নত্যাগের বিনিময়ে আমরা মায়ের ও প্রাণের ভাষায় কথা বলতে পারছি, সেই শ্রেষ্ঠসন্তান ও শহীদদের সম্মানে যার যার অবস্থান থেকে দেশ-জাতি ও মাতৃভাষা বাংলার জন্য কাজ করি। এবারের ভাষাদিবসকে সামনে রেখে এই হোক আমাদের অঙ্গিকার।

লেখক: ৯০ দশকের ছাত্রনেতা।

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
জরুরি অবস্থা ঘোষণায় লাগবে মন্ত্রিসভার অনুমোদন, সিদ্ধান্তে একমত রাজনৈতিক দলগুলো
শিল্প খাতের মহানায়ক, সাহসী উদ্যোক্তা নুরুল ইসলামের পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী পালন
সংস্কার করে তারপরেই নির্বাচন দিতে হবে: নাহিদ ইসলাম
বনানীতে সড়ক অবরোধ সিএনজি অটোরিকশা চালকদের, তীব্র যানজটে দুর্ভোগ
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা