ফেসবুক কীভাবে আমাদের নিঃস্ব করছে!

অরুণ কুমার বিশ্বাস
| আপডেট : ২১ মে ২০১৯, ১৪:৪২ | প্রকাশিত : ২১ মে ২০১৯, ১০:১৪

শুরুতেই বলে রাখি আমি মোটেও প্রযুক্তিবিমুখ নই। বরং প্রযুক্তির ভালো দিকগুলো নিয়ে আমি প্রায়শ ভাবি, ভাবতেই থাকি। এই যেমন ছুরি-কাঁচি দিয়ে শল্যচিকিৎসকগণ অপারেশনের মাধ্যমে রোগীর জটিল রোগ সারান, কর্কটাক্রান্ত দেহকোষ ছেঁটে শরীরকে রোগমুক্ত করেন। কিন্তু আবার এই ছুরি দিয়েই বিশ^ব্যাপী হাজারও মানুষ খুন করা হচ্ছে। হয়তো প্রশ্ন করবেন, দোষ কার! ছুরির, নাকি খুনির অর্থাৎ মানুষের?

এবার মূল প্রসঙ্গে যাওয়া যাক। উপমহাদেশে ফেসবুক চালু হয়েছে দশক পেরোয়নি। এর মধ্যেই আমরা একটি নির্লজ্জ, অহংকারী, স্বার্থপর, মিথ্যুক, বালখিল্য, কূপম-ূক ও স্যাডিস্ট জাতি হিসেবে নিজেদের পেশ করে ফেলেছি। নির্লজ্জ কেন বলেছি? ফেসবুক খুললেই দেখবেন একশ্রেণির মানুষ ফেসবুকের মাধ্যমে নিজেদের এমন উচ্চতায় দেখানোর চেষ্টা করছে, যেন তার বা তাদের মতো প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি আর হয় না। ঔজ্জ্বল্যে আর চাকচিক্যে তাদের নিছক ‘লুব্ধক’ বললেও কম বলা হয়। তারা যেন পুরো সৌরম-লের ইজারা নিয়ে বসে আছে।

ফেসবুকের কল্যাণে মানুষ এখন অনেকটাই স্বার্থপর ও ঘরকোনো। বন্ধুত্ব বলে আদতে আর আবেগীয় কিছু নেই। পুরোটাই এখন ভার্চুয়াল। অ্যাকচুয়াল বা আন্তরিক সম্পর্ক বলে খুব কমই অবশিষ্ট আছে। ফেসবুক মানে এখন স্রেফ কেসবুক। ‘দেখো, দেখো, আমাকে দেখো। আমার মতো সুখী ও পারফেক্ট মানুষ আর হয় না।’ না, অন্যের সুখে আমি বিচলিত হচ্ছি না। অন্যকে নিয়ে ভাবার আমাদের সময় কোথায়! আমরা তো সবাই এখন আত্মসুখে মগ্ন।

কূপম-ূকতার কথা বলছিলাম। ফেসবুকে বঙ্গপুঙ্গবের মতো জ্ঞানী-বুদ্ধিমান প্রাণী যেন আর কোত্থাও নেই। তারা জানে না এহেন বিষয় ভূমণ্ডলে নেই। ভূরি ভূরি জ্ঞানের বহর সাজিয়ে ছেড়ে দেয় ফেসবুকের পাতায়। সেখানে কচিপাঠার বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে উঠতি লেখক, পড়তি ক্যারিয়ারবিষয়ক বক্তা, হবো হবো সেলিব্রিটি- সবার তত্ত্বকথা থরে থরে সাজানো। এরা প্রত্যেকে মহাবুদ্ধিমান, জ্ঞান জাহির করছে। এদের কাণ্ড দেখে হাসতে হাসতে চাপা ব্যথা হয়ে যায়। বুঝতে পারে না যে, ফেসবুক কারও বাসার ড্রয়িংরুম নয়, এটা একটা পাবলিক প্লেস। সোশ্যাল মিডিয়া।

হালে বলিউড স্টার নাসিরউদ্দিন শাহ্ বলেছেন, সোশ্যাল মিডিয়া হলো গিয়ে বেকুবের জ্ঞান জাহির করার জায়গা। কথাটা বেশ মনে ধরেছে। দুছত্র কবিতা বা গল্প লিখেছে কি লেখেনি, অমনি সে বিশাল একখানা সাইনবোর্ড লাগিয়ে বসে থাকে, সে নাকি এপার বাংলার প্রতিনিধিত্বকারী একমাত্র সাহিত্যিক। জাতিই শুধু বুঝলো না, তাই সে ফেসবুকের কাছে নালিশ দিচ্ছে।

এ-কথা অনস্বীকার্য মুঠোফোন আসার পর থেকে জাতি হিসেবে আমরা ক্রমশ চরম মিথ্যাবাদী হয়ে উঠেছি। যদি থাকি বাইরে, বলে দেই আমি তো ভাই বাথরুমে আছি। অবস্থান যদি হয় কিল্লার মোড়, ফোনে বলি আমি ভাই জ্যামে, শনির আখড়ায় বসে কচি শসা খাচ্ছি। কচিপানা সন্তানেরা অবাক বিস্ময়ে বাপের মুখের দিকে তাকায়। ভাবে, বাপটা আমার এত বড় মিথ্যুক! আমাদের এই মিথ্যুকপনা আরও হাজার গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে ফেসবুক। পেটে খিদে মুখে লাজ বলে একটা কথা আছে। আর ফেসবুকে আমরা সব আজেবাজে জিনিসে মেকআপ মেরে পাবলিকের সামনে হাজির করি।

ছেলে হয়তো ট্রেনের মামুলি সিগনালম্যান, ফেসবুকে বলি তিনি রেলওয়ের ডিরেক্টর। সঙ্গে একখানা যুতসই ছবি জুড়ে দেই, যাতে পাগল পাবলিক আবার তা বিশ^াসও করে। হয়তো তৃতীয় লিঙ্গ, কিন্তু প্রোফাইলে পিক্সে শোভা পায় মায়াবিনীর ছবি। ফলে পাবলিক ধরা খায়, যতক্ষণ না এবাবদ তার জমানো সব টাকা হাপিস হয়ে যায়।

অহংকারী কেন বললাম! একটু খেয়াল করে দেখবেন, বেশির ভাগ ফেসবুক ব্যবহারকারী নিজের ভালোটুকু শুধু দেখতে দেয়, দিনের আলোয় স্বামী-স্ত্রীর হাসিহাসি ছবি দেখি আমরা। অথচ রাতের বেলা মদ্যপ স্বামী যে তাকে সমানে কেলায়, সেই খবর কিন্তু জানি না। কেউ কেউ হয়তো সত্যি সুখী ও সফল, সেই খবর সাইনবোর্ড বিলবোর্ড আকারে প্রকাশ করে যারা ভাগ্যাহত, তাদের মনের কষ্টটাকে আরও খানিকটা উসকে দেয়। এর নাম স্যাডিজম। অন্যকে কাঁদিয়ে আনন্দ পাবার মতো জঘন্য মনোবিকার।

এবার খানিক বালখিল্যের কথা বলি। ফেসবুকের এই জিনিস আমাকে সবচেয়ে বেশি পীড়িত করে। যাকে যা না মানায় তিনি যদি সেই সাজে ফেসবুকে আবির্র্ভূূত হন, তখন তাকে অর্বাচীন বা বেকুব ছাড়া আর কী বলবেন আপনি! করপোরেট ম্যানেজার কোনো মলম ক্যানভাসারের মতোন মাল্টিকালার ড্রেস পরে তেড়াব্যাঁকা হয়ে ক্যাট ওয়াক করছেন, বা পদস্থ কর্মকর্তা (সরকারি বা তরকারি) স্টেজে উঠে সমানে কোমর দোলাচ্ছেন, আবার কেউ কেউ ভুলভাল বাংলিশে নীতিকথা শেখাচ্ছেন, শর্টকাটে জাতে উঠবেন কীভাবে সেই বিষয়ে জ্ঞান দিচ্ছেন, সেই খবর আবার তিনি নিজ দায়িত্বে তুলে দিচ্ছেন ফেসবুকের মুখে।

ফেসবুকের সবচেয়ে ভয়ানক জিনিস কী জানেন, ফেসবুকে ভাইরাল। আমি এর নাম দিয়েছি নিপাহ্ ভাইরাস। উড়ে এসে চড়ে বসে পাবলিকের ঘাড়ে। সুপার ইমপোজ করা বা ফটোএডিট করে বানানো ছবি জুড়ে দিয়ে দিলো আপনার প্রেস্টিজের তেরোটা বাজিয়ে! ফেসবুকের আপনি যে ‘আপনি’ নন, বা এই কথাটা যে আপনি বলেননি, সেটা প্রমাণ করবেন কীভাবে! বা এসব নিয়ে কোর্ট-কাচারি করার আগেই ফেসবুকের মাধ্যমে আপনার ক্যামেরা ট্রায়াল হয়ে যাচ্ছে। শত শত লোক দেখছে, আহা-উঁহু করছে। দিনশেষে মান-সম্ভ্রম হারিয়ে আপনি একেবারে নিঃস্ব।

মজার ব্যাপার, পাবলিক আপনার ভালো কথা শুনবে না, কিন্তু আজেবাজে কিছু ভাইরাল হলে পাল্লা দিয়ে তাতে লাইক-কমেন্টস দিতে থাকবে। যেন আপনার মতো মেছো ভোঁদর আর হয় না। আপনি স্রেফ একটা গাবগাছ। পাবলিক গুজব হেব্বি খায়! তেলের মতো ‘রিউমার’ও চোকচোক করে গেলে। গুজবের পাখায় ভর করে রানির কোলের কালো ছেলে কা কা করে উড়ে পালায়!

ঘর ভাঙছে ফেসবুক- এই অভিযোগ সর্বৈব মিছে নয়। কথায় বলে, অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। আবার ফেসবুকের মুখে রঙচঙে ছবি পোস্ট দেখে অনেকেরই মতিভ্রম হয়। ঘরে সুন্দরী বউ রেখে দুষ্টু পুরুষেরা পরকীয়ায় রত হয়। অবশ্য দোষ শুধু পুরুষের একার নয়, এই দৌড়ে নারীও কিছু পিছিয়ে নেই। তারাও স্বামীকে লুকিয়ে বেশ ঢুকুঢুকু প্রেম করে। লাও ঠেলা! ফলে কী হয়, সম্পর্কের সুতোয় আচমকা টান পড়ে। বহুল ব্যবহৃত পুরোনো জামার কলারের মতো সম্পর্কেরও ফেঁসো উঠে যায়। আর কফিনে শেষ পেরেকটা মারে এই ফেসবুক। মানুষকে ক্রমশ জনবিচ্ছিন্ন, মতিচ্ছন্ন আর নিঃসঙ্গ করে দেয়।

তাই বলি কি, সাধু সাবধান, সময়ে সামলান! নইলে নিজের মান-ইজ্জত যাবে, ঘর-সংসারও ভাঙবে। বুঝেশুনে ফেসবুক ব্যবহার করুন। নির্বোধের মতো ফেসবুকের বুকে যথেচ্ছ আঁচড় কাটবেন না। ছবি সাঁটাবেন না। কারণ আপনি জানেন না, বিপদ কোন দিক থেকে আসবে। চাই কি, শাঁখের করাতের মতো ফেসবুক দুদিকেই কাটবে। ঘরে এবং বাইরে।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :