শিশুরা আমাদের খেলনা নয়

দিলরুবা সরমিন
  প্রকাশিত : ০৫ আগস্ট ২০১৯, ১৩:০৯
অ- অ+

সন্তান গর্ভধারণ থেকে মরণ অব্দি সন্তানের জন্য লড়াইটা কেবল মায়ের একার কেন? কেন একজন স্বাবলম্বী ‘মা’ তার সন্তানের জিম্মা পাবেন না? কেন তিনি উপযুক্ত বা যোগ্য হবার পরও সন্তানের আইনগত অভিভাবক হতে পারবেন না? কেন নাবালক কন্যা শিশু বা পুত্র শিশুর শরীর ও সম্পত্তির অভিভাবক ‘মা’ হতে পারবেন না ?

মায়ের ‘জিম্মা ও অভিভাবকত্ব’ পাওয়া না পাওয়ার যুদ্ধ চলছে আমাদের দেশে যুগ যুগ ধরে। মাঝে মাঝে কিছু ব্যতিক্রম ঘটনা ছাড়া কোনো অবস্থাতেই পরিবর্তন হচ্ছে না অবস্থার। মাঝখানে শুধু হয়রানির শিকার হচ্ছে মা ও শিশু। সময় নষ্ট হচ্ছে আদালতের। ক্ষেত্র বিশেষে পকেট ভারী হচ্ছে আইনজীবীদের।

অথচ এটা একটা স্বমীমাংসিত বিষয়। নিজের মনোজগতের দরজা–জানালা খুলে দিলেই ব্যাপারটা সুস্পষ্ট ও স্বাভাবিক। বাচ্চাদের জীবন নিয়ে এই নাটক, এই খেলা, এই অগ্নিপরীক্ষার শুরুটাও আশ্চর্যজনকভাবে স্বামী–স্ত্রীর বিবাহ বিচ্ছেদের পরই শুরু হয়। কেন? কেন অযথা এই বিষয়ের অবতারনা?

একটা বাচ্চা মাতৃগর্ভে আসা থেকে শুরু করে ‘মা’ যতদিন বেঁচে থাকেন ততদিন নানাভাবে মাকেই সন্তানের জন্য বাংলাদেশে লড়াই করে যেতে হয় । কেন?

সন্তান গর্ভে ধারন করা যে রকম আনন্দের ঠিক তেমনি শারীরিক, মানসিক ক্ষেত্রবিশেষে আর্থিক সব দায়িত্ব–কষ্ট মাকেই বহন করতে হয়। প্রাকৃতিক কারণে মা সন্তান গর্ভে ধারন করবেন এটাই স্বাভাবিক। সেই জন্যই তাকে গর্ভকালীন বিশেষ যত্ন নেওয়ার কথা আমরা বলি । কিন্তু আসলে বাস্তবতা কি?

সন্তান গর্ভধারণের শারীরিক কষ্ট–প্রসবের যন্ত্রণা মা সহ্য করতে মানসিকভাবে সম্পূর্ণ প্রস্তুত থাকেন। তবে পাশাপাশি গর্ভধারিণী মা প্রত্যাশা করেন, তার আশপাশের মানুষ, নিকটজন তাকে অন্তত মানসিক সুখ–শান্তি দেবেন আর গর্ভধারণ–প্রসবকালীন এবং প্রসব পরবর্তী সময়ে সার্বিক সহযোগিতা করবেন। এটা কি খুব বেশি চাওয়া ?

আমাদের দেশে বেশিরভাগ মাতৃমৃত্যু বা শিশুমৃত্যু মূলত যেসব কারণে, তার মাঝে উপরোক্ত বিষয়গুলি কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখছে ।

একজন মা বা একজন নবজাতক অবেলায়–অসময়ে চলে গেলে সার্বিকভাবে দেশ ও জাতির যে ক্ষতিটা হয় সেটা আসলে আমরা জানি না বা জানতে, বুঝতে চাই না ।

মায়েদের লড়াই এখানেই শেষ নয়। কেবল শুরু । গর্ভধারণের পর থেকে তাকে অনেকটা বোঝা হিসেবেই দেখা হয়। বিশ্ব ব্রক্ষ্মাণ্ডের এই বিশাল কর্মযজ্ঞে সরাসরি জড়িত থাকার পরও অধিকাংশ লাঞ্ছনা গঞ্জনা নির্যাতন গর্ভধারিণীকেই সহ্য করতে হয়।

তারপর প্রসব পর্ব পার হয়ে বাকি সব দায়দায়িত্বই মাকে বহন করতে হয়। মা হাসিমুখে কান্না লুকিয়ে সব মেনে নেন। সকলের মত মায়েরও ধারনা-বিশ্বাস সন্তানের সব দায়ভার নেওয়ার জন্যই তার জন্ম যা মৃত্যু অব্দি তার পালন করতেই হবে।

সমস্যা আসলে এখানে না । সমস্যা ভিন্ন জায়গায় । মা সব মেনে নিতে প্রস্তুত । যুগে যুগে মায়েরা এই সবই করে আসছেন এবং করবেন । সমস্যার শুরু হয় ‘আমিত্ববাদ’ থেকে।

যখন কোনো সংসারে ভাঙনের শব্দ শুনতে পাওয়া যায় তখন আর রক্ষা নাই । কোনো প্রকার দায়িত্বকর্তব্য পালন করুক চাই না করুক বাবা হয়ে উঠতে সাধ হয়। এমনকি মাকে হয়রানি করার জন্য দাদা–চাচা ক্ষেত্র বিশেষে দাদী–ফুপুর পাশাপাশি চাচি–ফুপাও মায়ের অধিকার হরণ করতে প্রস্তুত।

অথচ একবার কেউই ভাবেন না এই সেই মা, যিনিই সন্তান ধারন, প্রসব, লালনপালন করেছেন এতদিন ।

বাংলাদেশের আইন প্রচলিত আইন আররও কঠিন মাকে তার সন্তানের জিম্মা বা অভিভাবক নিয়োগের ক্ষেত্রে ।

কেন?

যদি কি-না মা-বাবার তালাক হয়ে যায় সেই ক্ষেত্রে ‘মেয়ে শিশু সাবালিকা না হওয়া অব্দি বা বিয়ে না হওয়া অব্দি আর ছেলে শিশু ৭ (সাত) বছর হওয়া অব্দি মায়ের জিম্মায়’ কেন? মায়ের গর্ভে শিশুটি যখন ছিল তখন মা, যদি সেই শিশুটির সব বোঝা মা বহন করতে পারেন তবে শিশুটি জন্ম লাভের পরেই মায়ের সব অধিকার কেন সীমিত হবে?

পিতার অধিকার নিয়ে আমার কোনো প্রশ্ন নাই । পিতা যথাযথ সন্তানের প্রতি দায়িত্বকর্তব্য পালন করুন তার অধিকার ক্ষুণ্ন হবার নয়।

পিতা যদি স্বামী ও পিতা হিসেবে স্ত্রী ও সন্তানের প্রতি যথাযথ দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করেন সেই ক্ষেত্রে কারো কোনো সমস্যা নাই । কিন্তু পিতা বা স্বামী কেবল ভ্রূণ প্রবেশের ভূমিকা রেখেই এই যে স্ত্রী বা সন্তানের মায়ের প্রতি বা সন্তানের প্রতি কোনো প্রকার দায়িত্ব–কর্তব্য পালন না করেই কেবল ‘পিতৃত্ব’ দাবিদার হন সেই ক্ষেত্রে অবশ্যই নিন্দনীয়।

পিতা কেবল একটি শব্দ নয় । অনেক দায়িত্ব–কর্তব্যর সমন্বিত ব্যক্তি বটে। তাকে তার স্ত্রী ও সন্তানের প্রতি যথাযথ দায়িত্ব–কর্তব্য পালন করার দায়–দায়িত্ব ধর্ম ও রাষ্ট্রীয় আইন দিয়েছে। সেই সব কিছু পালন তিনি পালন করেন বলেই সমাজ মনে করে নেয়। আসলেই কি? অধিকাংশ ‘বিবাহ বিচ্ছেদের’ পর দেখা যায় ‘সন্তান’ এর জিম্মা ও অভিভাবকত্ব নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে অযথা টানাহেঁচড়া হচ্ছে । কেন?

স্বামী-স্ত্রীর নানা কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ হতেই পারে। তারজন্য সন্তান কেন তাদের বিচ্ছেদের ‘ভিকটিম’ হবে?

সন্তানের নিজস্ব ইচ্ছা–অনিচ্ছা, ভালোলাগা–খারাপ লাগা, সুবিধা–অসুবিধা, মঙ্গল–অমঙ্গলের বিষয় এখানে জড়িত। সে একজন স্বাধীন মানুষ । তাকে এই পৃথিবীতে আসতে আমরা সাহায্য করেছি বলে তার জীবন আমরা কিনে নিয়েছি এই ধারনা ভুল।

প্রশ্ন থাকে কন্যা সন্তান আসলেই সাবালিকা হবার আগে বা বিয়ের আগে তার ভালো বা মন্দ বোঝে কি-না ?! এটা আসলে আমরা মনে করি। এটা আমাদের নিজস্ব ধারনা। শিশুরা সব কিছুই বোঝে। তারা জন্মের পর তাদের ক্ষুধামন্দার আরাম–আয়েশের যদি বহিঃপ্রকাশ করতে পারে তাহলে সাবালিকা কন্যা সন্তান বা সাত (৭) বছরের পুত্র সন্তান বুঝবে না কেমন করে যে তার সর্বোত্তম মঙ্গল কোথায়, কিভাবে–কার কাছে?

মূলত আমাদের যা প্রয়োজন সেটা হলো আমাদের চিন্তা–চেতনা, ধ্যান–ধারনা, মন-মানসিকতার ইতিবাচক পরিবর্তন। প্রয়োজন শিশুর সর্বোত্তম মঙ্গল কার কাছে, কোথায় কিভাবে হবে এটা শিশুর পাশাপাশি সমাজ–সংসার–আইন– আদালতের চিন্তা করা। কেবল ‘মা’ বিয়ে করলেই সব অধিকার হারাবে ‘বাবা’ বিয়ে করলেও কোনো সমস্যা নাই এই গতানুগতিক চিন্তা থেকে বের হয়ে আসা।

শিশুর সর্বোত্তম মঙ্গলই আমাদের কাম্য। সেটা কেবল মাতা বা পিতার দিক বিবেচনা করে নয়। দেখতে হবে আজকের শিশুর আগামী দিন সুন্দরভাবে গঠনে কার বেশি ভূমিকা ছিল এবং আছে বা রাখতে পারবে।

দুর্ভাগা এই দেশে শিশুদের মনোজগৎ নিয়ে ভাবার মানুষ বা সময় কোথায়? শিশুদের যেমন আমরা হাতে খেলনা ধরিয়ে দেই, ঠিক তেমনি তাদেরকেও আমরা ‘আমাদের খেলনা’ ভাবি। নইলে একটু উষ্ণতার জন্য যখন শিশুর মাকে প্রয়োজন হয় তখন উত্তপ্ত বালুকায় মায়ের বুক খালি করার এত পাঁয়তারা কেন?

লেখক: আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
ফিরে দেখা ৪ জুলাই: সারাদেশে ছাত্র ধর্মঘটের ডাক, উত্তাল সব বিশ্ববিদ্যালয়
এবার স্থানীয় সরকার নির্বাচন থেকেও ইভিএম বাদ
আগামী কয়েক দিন ভারি বৃষ্টির সম্ভাবনা, পাউবো কর্মচারীদের কর্মস্থলে থাকার নির্দেশ
নির্বাচন ভবনে রোপণ করা গাছ থেকে সরানো হলো আউয়াল কমিশনের নামফলক
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা