হাসিমুখে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা: এক অমূল্য বিনিয়োগ

ড. আসিফ আহমেদ
 | প্রকাশিত : ২৬ এপ্রিল ২০২০, ১৬:৫১

সমাজ-সংসার একটা জালের মতো। প্রতিটা বুনন এখানে সমান গুরুত্ব রাখে। কোথাও একটা বুনন ছিড়ে গেলে, দুর্বল হয়ে গেলে পুরো জালের মূল উদ্দেশ্য নষ্ট হতে বাধ্য। সমাজের এই বুননে প্রতিটা পেশাজীবী কোনো না কোনোভাবে তার অবদান রেখে চলেছে, তা সে আমরা তাকে স্বীকৃতি দিই বা না দিই।

কৃষক এবং শ্রমজীবী মানুষের গায়ের ঘাম ঝরিয়ে সরাসরি আমাদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থা্নের যাবতীয় যোগান দিয়ে চলে। একবার ভাবুন তো, আজ যদি বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ না হতো, আমদানিনির্ভর খাদ্যপণ্য নিয়ে কতদিন আমরা স্বেচ্ছাগৃহবন্দী হয়ে থাকতে পারতাম এই বৈশ্বিক দুর্যোগে? কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই মৌলিক সেবা দানকারী মানুষগুলো অর্থনৈতিক, সামাজিক, স্বাস্থ্য, মানবিক কোনো দিক থেকেই সমাজের মানসম্পন্ন অবস্থায় বাস করে না। এমনকি তাদের সাথে সৌজন্যমূলক ব্যবহার করার ক্ষেত্রেও আমরা বড়ই কৃপণ। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে তাদের তৈরি করা পণ্য বা সেবা আমরা বেশ চড়া দামে গ্রহণ করলেও, সেটার সুফল তারা চোখে দেখে না, মধ্যস্বত্বভোগীরাই মূল মুনাফাটুকু পকেটে ভরে। তাদের হাড়ভাঙা খাটুনিকে ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতা না জানিয়ে চাষা বলে গাল দেই। এর চেয়ে কদর্য আর কিই বা হতে পারে!

চব্বিশ ঘণ্টা সেবাদানকারী মানুষগুলোর কথা ভাবুন। পুলিশ, ডাক্তার, নার্স, সাংবাদিক এ রকম পেশার সাথে যারা জড়িত তাদের ঘড়িতে আলাদা কোনো কাজের সময় বলে কিছু থাকে না। যেকোনো জরুরি ডাক এলে খেয়ে না খেয়ে তাদের ছুটতে হয়, ঘরে হয়তো অসুস্থ সন্তান, স্ত্রী/স্বামী, বাবা-মা। এমনকি নিজের অসুস্থতাকে একপাশে সরিয়ে চলে যেতে হয় দায়িত্বে। এরাও কিন্তু মানুষ। আপনি-আমি তাদের কাছে গিয়ে পাঁচ মিনিটেই অস্থির হয়ে পড়ি। অথচ তারা হয়তো ঘণ্টার পর ঘণ্টা এরকম অসংখ্য সেবাগ্রহীতাকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের সেবার মানের বেহাল দশা বা দুর্নীতিগুলোও আকাশ থেকে পড়ে না। তারাও একটা সার্বিক কাঠামোর অংশ যেই কাঠামোতে আমি-আপনি বসবাস করি। আমাদের ভিতর যারা অধিকতর ক্ষমতাধর, তারাই কেউ কেউ তাদের বাধ্য করি নিয়মের বাইরে যেতে, দুর্নীতি করতে। জাগিয়ে তুলি তাদের ভিতর লোভ আর নিয়ম ভাঙ্গার প্রবণতা। এরকম জরুরি সেবাদানকারী মানুষগুলোকে অসৎ বানানোর ক্ষেত্রে আমরা সেবাভোগী সাধারণ জনগণ আর উচ্চপদস্থ মানী ব্যক্তিরাই বেশি ভূমিকা রাখে। এত কিছুর মাঝেও তাদের সাধ্যের ভিতরের সেবাটুকু যখন তারা আমাদের দেয়, কতটা হাসি আর ধন্যবাদ জানাতে পারি আমরা তাদের?

মাসে এক-আধবার স্বাদ বদলের জন্য হয়তো কোনো রেস্তোরায় গেলেন, ওয়েটার এমন মুখ গোমড়া করে টেবিলে এসে জিজ্ঞেস করবে "কী খাবেন?” হয়তো খাবার ইচ্ছাটাই উবে যাবে। আমরাও কখনো কখনো তার প্রতি একটা শাসকসুলভ আচরণ দেখাই। নেই কোনো আন্তরিক সম্ভাষণ কিংবা হাসি বিনিময়। অথচ এই সুন্দর আচরণটুকুর জন্য কত খরচ হয় আমাদের? সব খানে কেমন একটা শত্রুসুলভ অবিশ্বাস, দূরত্ব। সকল পক্ষকেই শিখতে হবে এই সৌহার্দ্য বিনিময়। কিছু কিছু বিষয় আছে যেগুলো আমি আপনি শুরু করে সমাজে চালু করতে পারলেই তা সংস্কৃতিতে রূপ নেবে। এর জন্য বার্ষিক পরিকল্পনা খাতে কাড়ি কাড়ি বরাদ্দ প্রয়োজন হবে না। এর সুফলটা কতটা আনন্দদায়ক হতে পারে, এরকম সুন্দর অভিজ্ঞতা যাদের আছে সবাই সেটা জানেন।

পড়াশোনার সুবাদে দক্ষিণ কোরিয়া এবং যুক্তরাজ্যে থাকার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। দুই জায়গাতেই যখন ব্যাংক একাউন্ট খুলতে গিয়েছিলাম, কোরিয়াতে লেগেছিল মাত্র মিনিট পনেরো আর যুক্তরাজ্যে লেগেছিল প্রায় ২১ দিন। যুক্তরাজ্য এখনো কাগজ চালাচালিতে মনে হয় বিশ্বে সেরা। কিন্তু এই ২১ দিনে আমার ধৈর্য্য ও পকেটের পাউন্ড কমে এলেও এক মুহূর্তের জন্য ব্যাংক বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কর্মচারী-কর্মকর্তার আচরণে ব্যথিত হইনি, মনে হয়নি আমি তাদের খারাপ ব্যবহার বা অবহেলার শিকার।

এমনিতে ডিজিটাল ব্যাংকিং-এর জন্য ব্যাংকে মানুষ খুব কম যায় ওখানে। তাও একদিন একটা কাজে যেয়ে দেখি সামনে তিন-চার জনের লাইন। যখন আমি কাউন্টারে গেলাম, আমাকে হাসিমুখে আন্তরিক ধন্যবাদ জানানো হলো আমি ধৈর্য্য সহকারে অপেক্ষা করেছি সেজন্য। তারপর আমার কাজ শেষ করে আবার জানতে চাওয়া হলো আর কোনো সাহায্য উনি আমাকে করতে পারেন কিনা। যখন আমার সাথে সব কাজ শেষ কেবল তখনি পরের জনকে ডাকা হলো।

চার বছর যুক্তরাজ্যে থাকাকালীন প্রতিটা পেশাজীবী মানুষের কাছ থেকে এমনই হাসিমুখে সেবা পেয়েছি, কখনো মনে হয়নি আমি উন্নয়নশীল দেশ থেকে আসা সামান্য এক ছাত্র। ধন্যবাদ জানানোর সংস্কৃতি তাদের সমাজে সহজাত, প্রতিনিয়ত কত কত ধন্যবাদ যে দিয়েছি তার কোনো হিসাব নেই।

তাহলে আমরা কেন নিজ দেশের পেশাজীবী মানুষগুলোর প্রতি একটু সংবেদনশীল আচরণ করতে পারি না? বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের পর কিছু কিছু ভিডিওতে পুলিশ বা স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তির মানবাধিকার লংঘন করার মতো আচরণ দেখেছি রাস্তায়। কিন্তু এ কথাও সত্যি আমরা নাগরিকরাও ভদ্রতা, শিষ্ঠাচারের ধার ধারি না এবং এত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আমরা অনেকে আমলেই নিচ্ছি না। বাসায় ভালো লাগছে না বলে বেরিয়ে যাচ্ছি হাওয়া খেতে। অথচ সকাল থেকে রাত এই পুলিশ, বিজিবি, সেনাবাহিনীর সদস্যরা রাস্তায় আছেন আমাদের জন্যই! তারা তো সমস্ত স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে তাদের কাজটুকু করে চলেছেন, আর আমি-আপনি সামান্য বাসাতে থাকতে পারছি না। আমাদের অসহযোগিতায় তাদের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেলে একগাদা নীতিবাক্য তো এই আমরাই তাদের শুনিয়ে দেব। একই ভাবে নিরলস কাজ করে চলেছেন ব্যাংকার, মাঠ পর্যায়ের অনেক ত্যাগী জননেতা, সাধারণ স্বেচ্ছাসেবী মানুষ, সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। অথচ ফেসবুকে তাদের সুস্থ ও গঠনমূলক সমালোচনা বা পরামর্শ প্রদানের চেয়ে কটূক্তি আর ট্রল করাটাই আমাদের কাছে মুখ্য হয়ে উঠেছে।

পেশাগত দায়িত্ব পালন করা সিলেটের একজন মেধাবী চিকিৎসক এবং দুদকের একজন কর্মকর্তাকে আমরা ইতিমধ্যে হারিয়েছি। বেশ কয়েকজন ডাক্তার এবং স্বাস্থ্যকর্মী এরই ভিতর আক্রান্ত এবং অনেকেই কোয়ারেন্টাইনে। আমাদের তথ্য গোপনই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এর মূল কারণ। এছাড়া সরবরাহ করা ব্যক্তিগত নিরাপত্তা পোশাকের কার্যকারিতা নিয়ে তো প্রশ্ন রয়েছেই। আমরা কি একবারও ভাবছি এই ডাক্তাররা না থাকলে আমরা কি একজন ব্যাংকার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা শিক্ষকের কাছে রোগ নিয়ে হাজির হবো? আর কিছু না পারি অন্তত তাদের প্রাপ্য সম্মান জানাই, তাদের সাথে ভুল তথ্য দিয়ে প্রতারণা না করি। তাদেরকে মানসিকভাবে গুড়িয়ে না দিই। এই সময় তাদের মনোবল ঠিক রাখতে না পারলে তারা কিভাবে আমাদের সেবায় নিজেদের বিলিয়ে দেবে?

একই সাথে যেসব ব্যক্তি সারাদেশে নমুনা সংগ্রহ এবং পরীক্ষার সাথে যুক্ত তারাও অনেক সীমাবদ্ধতার ভিতর থেকে কাজ করে যাচ্ছেন জীবন বাজি রেখে।

আসুন আমরা দুর্যোগ মুহূর্তে এসব জরুরি সেবাদানকারী পেশাজীবীদের সাথে অধৈর্য্য ও অমানবিক হবার আগে একটিবার হলেও ভাবি। তাদের কাজকে সহজ করতে সাহায্য করি। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে কৃষক ও সকল শ্রমজী্বীর অসামান্য অবদানকে স্মরণ করি, মানুষ হিসাবে তাদের মর্যাদা নিশ্চিত করি। তাদের হাসিমুখে অভিবাদন দিই; কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা আর ধন্যবাদ জানাই অন্তরের গভীর থেকে।

লেখকঃ সহযোগী অধ্যাপক, বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।

ই-মেইলঃ [email protected]

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :