মা আমার কাছে ছিল একমাত্র চাঁদ দেখা কমিটি

সুজয় সরকার
  প্রকাশিত : ১৪ মে ২০২১, ১৩:১৯
অ- অ+

‘আজ ঈদ, মদীনার ঘরে ঘরে আনন্দ...’। ছোটবেলায় ঈদের সাথে প্রথম পরিচয় এর মাধ্যমেই। না, এর আগে যে ঈদ দেখিনি তেমনটা নয়; তবে সেগুলো ছিল স্রেফ 'সিন্নি'। ছোটবেলায় দেখেছি হালুয়া-রুটি সিন্নি, খিচুড়ি সিন্নি, গোস্ত সিন্নি। পরে জেনেছি সেগুলো ছিল শব-ই-বরাত, ঈদ-উল-ফিতর, ঈদ-উল-আযহা। ক্রমে আমরা বড় হয়েছি আর ছোট হয়েছে ঈদের আনন্দ; এমনকি দীর্ঘ 'ঈদ' হ্রস্ব হয়ে 'ইদ' হয়েছে। এমনকি আমাদের নদীতীরের আস্ত কাস্তের মতো চাঁদটাও এখন শুধু চাঁদ দেখা কমিটির ঘোষণায় এসে ঠেকেছে।

ছোটবেলায় যখন বিকেলে দৌঁড়ে নদীতীরে চাঁদ দেখতে যেতাম, মা মাঝে মাঝে বলতেন "চাঁদ আজ দেখতে পাবি না, কাল যাস"। মন মানতো না, সবাই যাবে দেখতে, আমি বসে থাকব সে কি করে হয়। দল বেঁধে গিয়ে ঠিকই হতাশ হয়ে ফিরে আসতাম। মা বলতেন, "কাল দেখবি চাঁদটা গতবার থেকে অনেক বড় উঠবে, খুঁজতে হবে না, এমনিই দেখতে পাবি"। পরের দিন ঠিক ঠিক তাই হতো।

খুব অবাক হয়ে যেতাম মা কিভাবে এতো আত্ববিশ্বাস নিয়ে বলে। মা পরে বুঝিয়ে দিতেন, "আমাবস্যার (অমাবস্যা) পরের দিনের তিথি কে বলে পিত্তিবাদ( প্রতিপদ), তার পরের দিন দুতে (দ্বিতীয়া)। দুতের মাঝামাঝি না হলে চাঁদ দেখা যায় না। কাল বিকেলে সবেমাত্র দুতে লেগেছিল, তাই চাঁদ দেখা যায় নাই।" বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগ পর্যন্ত বছরগুলোতে মা আমার কাছে ছিল একমাত্র চাঁদ দেখা কমিটি। মাঝে মাঝে মায়ের কমিটির স্বঘোষিত প্রেসসচিব হয়ে সমবয়সীদের বলে দিতাম, "কাল তো ঈদ হচ্ছে না, পরশু হবে"।

কাল বা পরশু নয়, মাত্র কয়েক ঘন্টা পরই ঈদ। তবু 'মদীনার ঘরে ঘরে' আনন্দের পরিবর্তে চাপা বিষন্নতা। গত বছর থেকে চেপে বসা এই বিষন্নতা আমাদের ছেড়ে যেতে চাইছেই না। কবে যে এই বিষন্নতার সংকোচ কাটিয়ে প্রাণ খুলে এক একটা উৎসবে সামিল হতে পারব।

তাই বলে আমরা কি থেমে আছি? মোটেও না। গত কয়েকদিনের শিমুলিয়া আর পাটুরিয়া ফেরি ঘাটের ভাইরাল বিষন্ন দৃশ্যগুলো, গত চব্বিশঘণ্টায় যমুনা সেতুতে এ যাবতকালের রেকর্ড বায়ান্ন হাজার গাড়ি পার হওয়া, অভ্যন্তরীণ বিমান রুটে অসম্ভব চাপ কোনভাবেই আমাদের থেমে যাওয়ার কথা বলে না। ভয় লাগে শুধু প্রতিবেশি দেশের বিশাল কুম্ভমেলা আর স্নানযাত্রা কিভাবে আজ শবযাত্রায় পরিণত হয়েছে সেই দৃশ্য দেখে।

"আপনি কি চান না মানুষগুলো বাড়িতে পরিবার পরিজনের সাথে ঈদ করুক?"

না রে, অবশ্যই চাই। অনুভূতির সাথে ছলচাতুরী চলে না। এখন পর্যন্ত একটা পূজা বাড়ির বাইরে করব ভাবলেই বুকের ভেতরটায় শীতের তিস্তার চর পরে যায়। অন্য সহকর্মীরা যেন ঈদে ছুটি পায় এই ভেবে বিগত বছর গুলোতে কর্মস্থলে ঈদ কাটালেও মনটা ছটফট করে বাড়ির সেই 'সিন্নি'র দিনগুলোতে ফিরে যেতে; প্রচন্ড হাহাকার লাগে ঈদের দিনগুলোতে বন্ধু-বান্ধবের সাথে হাটে-মাঠে-ঘাটে ঘুরতে না পারলে।

"তাই বলে আপনার ঈদ আর আমাদের ঈদ মিস করা কি এক?" আপনি হিন্দু মানুষ কি বুঝবেন?

হয়তো না। হয়তো বুঝব না। তবে যতদিন পর্যন্ত না আমরা একভাবে ভাবা শিখব ততোদিন চঞ্চল চৌধুরীদের কমেন্টবক্স বাজে ভাষায় ভরে উঠবে, পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার মুসলিম মন্ত্রীর নিয়োগে অভিনন্দনের বিনিময়ে কদর্যতা ছড়াবে ; ফিলিস্তিনের নিরাপরাধ নারী-শিশুরা মসজিদেও নিরাপত্তা পাবে না। ততোদিন হয়তো আমাদের একটা অংশ মাথার মধ্যে একরাশ গোবর থাকার ফলস্বরুপ গায়ে গোবর মেখে করোনা মুক্তির প্রার্থনায় হাজির হবে।

না, আমাদের প্রার্থনা হোক পবিত্রতার, জ্ঞান-চক্ষু উন্মেষের। আমাদের প্রার্থনা হোক এই অতিমারি মুক্ত পৃথিবীর। আমাদের প্রার্থনায় থাক এই বিষন্নতা মুক্ত আগামী ঈদের প্রত্যাশা। আমাদের প্রার্থনায় থাক ফিলিস্তিনের শান্তিকামী মানুষেরা। আমাদের প্রার্থনায় থাক সকল বর্বরতা নিপাত যাওয়ার। ঈদ মুবারক।

লেখক: সুজয় সরকার, পুলিশ কর্মকর্তা

ঢাকাটাইমস/১৪মে/এসকেএস

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
যারা পিআর নির্বাচন চাইছে তারা ‘চরের দল’: সালাহউদ্দিন
ইমন-হৃদয়ের অর্ধশতকে লড়াকু পুঁজি বাংলাদেশের
মালয়েশিয়ার অভিযোগে জঙ্গি সন্দেহে ঢাকায় গ্রেপ্তার তিনজন কারাগারে
পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী নেতাদের দমন-পীড়ন ছিল ইয়াজিদের সমতুল্য: তারেক রহমান
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা