সাংবাদিক ফাগুন হত্যাকাণ্ড, পিবিআই এবং বাবার ভাষ্য

কাকন রেজা
  প্রকাশিত : ১৩ জুন ২০২১, ০৮:২৭
অ- অ+

প্রতিটা একুশ তারিখ আমার জন্য একেকটা হাহাকারের দিন। একুশ মানে আমার ফাগুন হারানোর দিন। ফাগুন মানে, ইহসান ইবনে রেজা, ফাগুন রেজা, নিহত তরুণ সাংবাদিক। যে এসেছিলো অনেক কিছুই পাল্টে দিতে। চেয়েছিলো এক বিশুদ্ধ গণমাধ্যম। যেখানে স্তুতি ও স্তাবকতার বদলে থাকবে সত্যের সম্পূর্ণ বিস্তার। পারেনি, ফাগুনকে হত্যা করা হয়েছিলো।

মূলত ফাগুনকে নিয়ে আমি মাসের একুশ তারিখে লিখি। কিন্তু এবার আগেই লিখতে বসলাম একটা খবরকে ঘিরে। ফাগুন হত্যা মামলা এখন পুলিশ বিউরো অব ইনভেস্টিগেশন সংক্ষেপে যাকে বলা হয় পিবিআই সেই প্রতিষ্ঠানটির হাতে। ফাগুন চলে যাবার দু’বছর পুরো হয়েছে। কিন্তু হত্যার কারণ এখনো উদঘাটিত হয়নি। তবে পিবিআই মামলা হাতে পাওয়ার চার মাসের মধ্যে হত্যাকারীদের চিহ্নিত করতে পেরেছে। যে কিলার গ্রুপটা ফাগুনকে হত্যার সাথে জড়িত তাদের তিন জনকে হেফাজতে নিতে পেরেছে তারা।

সেই তিন জনের একজন ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিতে বলেছে যে, তারা পাঁচজন মিলে ল্যাপটপ এবং ফোনের জন্য ফাগুনকে হত্যা করেছে। স্বীকারোক্তির ধরণটা কমন। কিন্তু ঘটনা পরম্পরা সেই স্বীকারোক্তির সাথে মেলে না। সেই স্বীকারোক্তি অনুযায়ী কোকাকোলার সাথে ফাগুনকে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছিলো। তারপর সে সঙ্গতই নিস্তেজ হয়ে পড়ে। তখন তার ল্যাপটপ, ফোন আর পকেটে থাকা টাকা নেয়ার সময় বাধা দেয় ফাগুন। তখন তাকে আঘাত করে ট্রেন থেকে ফেলে দেয়া হয়। আর সে সময় ট্রেনের কামরায় লোকজন ছিলো না। এই হলো স্বীকারোক্তির মূল কথা।

এখন আসি ঘটনার বিশ্লেষণে, একজন তরুণ, তাও ঘুমের ওষুধের প্রভাবে অনেকটাই নিস্তেজ। সেখানে ৫ জন মানুষের সহজেই তার থেকে ল্যাপটপ, ফোন, টাকা কেড়ে নেয়া সম্ভব। হত্যা করার প্রয়োজন পড়ে না। একজন সতেজ তরুণের কাছ থেকেও হত্যা ছাড়াই ৫ জন মানুষ এসব কেড়ে নিতে পারে। সাধারণত ট্রেনে অজ্ঞান পার্টি বা মলম পার্টি হত্যার মতন রিস্ক নেয় না। আর ট্রেন থেকে কাউকে ফেলে দেয়ার রিস্ক নেয়া তো এক কথায় অসম্ভব। আর ফাগুন ফিরছিলো ঈদের আগে, তখন ট্রেনে ছিলো উপচানো ভীড়। সে সময় ট্রেনের কামরায় লোক থাকবে না, এটা একেবারেই অবিশ্বাস্য।

গত ১০ জুন জামালপুর পিবিআই এর প্রধান পুলিশ সুপার সালাহ উদ্দিন এক প্রেস ব্রিফিংয়ে উপস্থিত স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের ঘটনাটি জানিয়েছিলেন। তিনি তার দিক থেকে পরিষ্কার ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা ঘটনার লেজটা ধরেছি, আশা করছি মাথাটাও ধরতে পারবো।’ তিনি আরো যোগ করেছিলেন, ‘এই ঘটনার সাথে জড়িত সবাইকে ধরা গেলে বোঝা যাবে এর পেছনে কারা রয়েছে। যদি কেউ থাকে তাদেরও আমরা আইনের আওতায় আনবো।’ অর্থাৎ পিবিআই এর কর্মকর্তাদেরও ধারণায় রয়েছে এটা কোনো সাধারণ ছিনতাইয়ের ঘটনা নয়।

ফাগুনের কাছে থাকা ল্যাপটপ বিষয়ে বলি। ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে অভিযুক্ত খুনি বলছে, তাদের লিডারের কাছে ল্যাপটপ বিক্রির টাকার ভাগ চাইতে গেলে সেই লিডার বলেছে, ল্যাপটপে কিছু কাজ আছে। পরে ভাগ দেয়া হবে। কিন্তু তারা শেষ পর্যন্ত ল্যাপটপের টাকার ভাগ পায়নি। প্রশ্নটা এখানেই, ল্যাপটপে কী কাজ ছিলো। কেন অভিযুক্ত খুনিদের লিডার বললো, ল্যাপটপ বিক্রি করা যাবে না, কাজ আছে। তবে কী হত্যাকারীরা ভেবেছিলো ওই ল্যাপটপে বিশেষ কিছু রয়েছে? প্রশ্নটা ফেলে দেয়ার মত নয়। অবশ্য পিবিআই প্রশ্নটা মাথায় রেখেছে। এমন অসংখ্য প্রশ্ন আছে ফাগুনের হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে, যার সবটাই বলা যাবে না তদন্ত চলাকালে। তাই এ কটি প্রশ্নই রাখলাম। বলতে গেলে, আক্কেলমান্দ কে লিয়ে ইশারাই কাফি।

রেলওয়ে পুলিশের কাছে দেড় বছর তদন্তের ভার ছিলো। তারা এগুচ্ছিলো সঠিক পথেই, কিন্তু মাঝপথে হঠাৎ গতি রুদ্ধ হলো কেন, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। আরেকটা প্রশ্ন, ‘সাধারণ ছিনতাইকারী’দের একজন হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়েছে। এমন আলোচিত হত্যা মামলায় জামিন পাওয়া খুব সহজ নয়, সেই সহজ না হওয়া কাজটাকে সহজ করার পেছনে অর্থের জোগানই এলো কোথা থেকে। কেন একজন তরুণ সাংবাদিকের আলোচিত হত্যা মামলার আসামিকে রিমান্ডে পাওয়া যায় না, রিমান্ড মঞ্জুর হয় না, অন্য একটা চুরির মামলায় তাকে রিমান্ডে নিতে হয়, এটাও প্রশ্নের বাইরে নয়। চিন্তায় রাখতে হবে, আলোচিত খুনের মামলায় রিমান্ড পায়নি পিবিআই, অথচ একটি চুরির মামলায় পেয়েছে।

ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি প্রকাশ হওয়ার মূলে ছিলো এমন কতগুলো প্রশ্ন। সামান্য চোরদের জন্য কেন ঝানু উকিলেরা লড়েন, এই প্রশ্নের মুখেই প্রকাশিত হয়েছিলো ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির ইতিবৃত্ত। ফাগুনের মামলার ক্ষেত্রেও ‘সাধারণ ছিনতাইকারী’র পেছনে কারা জামিন এবং মামলা লড়ার ক্ষেত্রে উদারহস্ত হচ্ছে এটাও ভেবে দেখা দরকার। যে দেশে অপরাধ না করেও অনেকে জেল খেটেছেন। এখনো হয়তো এমন ঘটনা রয়েছে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে এই উদারহস্তরা কোথায় থাকেন! কেন একজন তরুণ প্রতিভাবান, প্রতিশ্রুতিশীল সাংবাদিকের হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত এবং যে অভিযোগ স্বীকৃত তাদের পেছনে টাকা ঢালছেন তারা, এমন কথা প্রশ্নের বাইরে থেকে গেলে, অনেক কিছুই উত্তরের বাইরে থেকে যাবে।

আমার নিজের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা অল্পদিনের নয়। আর বংশ পরম্পরার কারণে আমার এবং ফাগুনের সাংবাদিকতা অনেকটাই জেনেটিক। সুতরাং খুব ছেদো কথায় এই পরম্পরাকে ভোলানো সম্ভব নয়। আমার সাথে ফোনে কথা বলার সতেরো মিনিট পর ফাগুন আক্রান্ত হয়। তার ফোন সুইচড অফ হয়ে যায়। ফাগুন যখন আমার সাথে কথা বলছিলো, তখন ব্যাকগ্রাউন্ডে কোনো নয়েজ ছিলো না, যা ট্রেনে বা গাড়িতে থাকলে থাকে। একেবারে চুপচাপ ছিলো, যাকে বলে পিনপতন নিরবতা। ফাগুনকে ট্রেন থেকে ফেলে হত্যা করা হয়েছে, এটা আমাকে বিশ্বাস করানো সম্ভব নয়। যেহেতু আমি ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমটা জানি এবং এ ব্যাপারে অল্পবিস্তর পড়াশোনা আছে।

শেষে বলছি, বুকে পাথর বেঁধেছি অনেক আগেই। এখন বেঁচে আছি ফাগুন হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচার দেখার আশায়। আমি তদন্ত ও বিচারটা দেখতে চাই। কারণ এ দুটো বিষয় এ দেশে এ মুহূর্তে ভীষণ জরুরি। আমি চাইতে পারতাম যে খুনিদের ক্রসফায়ারে দেয়া হোক। আমি চাইনি, কারণ আমি বিচারে বিশ্বাস করি। কারণ বিচার হলো দীর্ঘকালীন দৃষ্টান্ত আর ক্রসফায়ার হলো স্বল্পকালীন ধামাকা। গোল্ড ফিস স্মৃতি যা মনে রাখে না। সে কারণেই আমি বিচারটা চাই। এ বিচার শুধু আমার এক ফাগুনের জন্য নয়। অসংখ্য তরুণ যারা গণমাধ্যমের মতন ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় আছেন তাদের সবাইকে আমি আমার ফাগুন ভাবি। আমার বিচারের দাবিটা তাদের নিরাপত্তার জন্যও।

লেখক : সাংবাদিক, কলাম লেখক ও নিহত সাংবাদিক ফাগুন রেজার বাবা।

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় আরও ১১৮ জন নিহত
মধুমতি নদীতে জেলেকে পিটিয়ে হত্যা, মামলার এজাহারনামীয় আসামি সানি গ্রেপ্তার
ভাঙ্গা সার্কেল অফিস ও ভাঙ্গা থানা পরিদর্শন করলেন ডিআইজি রেজাউল করিম মল্লিক
বাংলাদেশে জাপানের সহযোগিতা আরও বাড়াতে প্রধান উপদেষ্টার আহ্বান
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা