স্নায়ুযুদ্ধের নতুন মেরুকরণে আফগানিস্তান

তালহা রহমান
 | প্রকাশিত : ২৩ আগস্ট ২০২১, ২০:১১

বিশ্ব রাজনীতির এখন সবচেয়ে আলোচিত নাম আফগানিস্তান। মুসলিমপ্রধান এই দেশটি একটি স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র। রাষ্ট্রটি ইরান, পাকিস্তান, চীন, তাজাকিস্তান, তুর্কেমেনিস্তান ও আর্মেনিস্তানের মাঝে অবস্থিত। বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর কাছে ভৌগলিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটির রয়েছে অপিরিসীম গুরুত্ব। দেশটিতে তালেবানরা ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকেই তারা নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে।

তালেবান কিন্তু আফগানিস্তানে আগেও ছিল। ২০০১ সালে আমেরিকা সন্ত্রাসবাদের নামে দেশটিতে হামলা চালিয়ে তাদের পুতুল সরকার বসিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু বাস্তবে তালেবানকে কখনোই তারা নির্মূল করতে পারেনি অথবা করেনি।

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সেপ্টেম্বরের ভেতর তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তারপর হতেই দেশটিতে একধরনের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। হাজার হাজার মানুষ কাবুল বিমান বন্দরে ভিড় করছে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেওয়ার জন্য। চার্টার্ড বিমানে করে শতশত মানুষের আফগান ছাড়ার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। তারা মনে করেছে আফগানিস্তান তাদের জন্য এখন আর নিরাপদ নয়। কিন্তু আপাত দৃষ্টিতে আগের তালেবান আর বর্তমান তালেবানের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য মনে হচ্ছে। তালেবানরা প্রথমেই বলছে, তারা সকলকে ক্ষমা করে দেবে। কারও প্রতি কোনো ধরনের প্রতিশোধ নেবে না। নারীরা বাইরে কাজ করতে পারবে, একই সাথে পড়াশোনাও চালিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু সেটা একটা কাঠামোর ভেতর থেকে। তারা মিডিয়াকে তাদের বিরুদ্ধে কাজ করতে দেবে না বলে দিয়েছে।

আফগান রাষ্ট্রটিকে বিশ্বের অন্য কোনো দেশকে ব্যবহার করতে দেবে না, এটাও বলেছে। সে যাই হোক, একটা পরিবর্তন যে আসবে সেটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।

এখন দেখা যাক, বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলো তাদের নিয়ে কী ভাবছে?

আফগানিস্তানের প্রধান অ্যাক্টর হলো ভারত, পাকিস্তান, চীন, রাশিয়া ও ইরান। ইঙ্গ-মার্কিন সরকার যেখানে তাদের সৈন্যের পাশাপাশি নাগরিকদের সরিয়ে নিচ্ছে সেখানে চীন কিন্তু এখনো তাদের কাবুল দূতাবাস খোলা রেখেছে। চীনের এখন ভবিষ্যৎ বিশ্বের প্রধান পরাশক্তি।

ধারণা করা হয়, ২০৫০ সালে চীন যুক্তরাষ্ট্রকে অর্থনৈতিক দিক থেকে ছাড়িয়ে যাবে। চীন প্রধানত দুটি কারণে তালেবান সরকারকে তার সহায়তা দেবে। প্রথমত চীন আফগানিস্তানের অবকাঠামোগত উন্নয়নে যে বিনিয়োগ করেছে সে চাইবে আফগানিস্তানে যে সরকারই আসুক তাদের সুসম্পর্ক বজায় রাখতে। অন্যদিকে, চীন তার মুসলিম প্রধান উইঘুর প্রদেশে কোনোভাবেই কোনো ধরনের উগ্রবাদের উত্থানকে আশা করবে না। চীনের সাথে আফগানিস্তানের সীমান্ত ওই একটাই, যেটাকে আমরা জিনজিয়ান বলি। আর এখানকার অধিবাসীরা দীর্ঘদিন ধরেই স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করে আসছে। সুতরাং চীন কোনোভাবেই চাইবে না যে, তাদের সাথে তালেবানের কোনো ধরনের সখ্য হোক।

সর্বোপরি দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্য এশিয়ার প্রবেশপথ আফগানিস্তানকে যে কেউই নিয়ন্ত্রণ করতে চাইবে। সেক্ষেত্রে আমেরিকা চলে যাওয়ায় তাদের সে পথ আরও সুগম হয়েছে। আর এ ক্ষেত্রে তারা এশিয়ার আরেক পরাশক্তি ইরানকে পাশে পাবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

তালেবান ক্ষমতায় আসায় সুবিধাজনক জায়গায় রয়েছে পাকিস্তান। কারণ দুটি রাষ্ট্রই মুসলিমপ্রধান। অন্যদিকে তালেবান বরাবরই পাকিস্তানের আশীর্বাদপুষ্ট। ভারতের সাথে পাকিস্তান ও চীনের সীমান্তগত বিরোধদের জন্য উভয় দেশই আফগানিস্তানকে কাজে লাগাতে চাইবে, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর পাকিস্তান ও চীনের ঐতিহাসিক সম্পর্ক সবারই জানা। সুতরাং নতুন এই সমীকরণ যে ভারতের জন্য একটি উদ্বেগের কারণ সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

এদিকে চীন, রাশিয়া ও পাকিস্তান ইতিমধ্যে তালেবান সরকারকে সমর্থনের ব্যাপারে নীতিগত সমর্থন দিয়েছে। আর তাই যদি হয়, তাহলে ভূ-রাজনীতিতে ইঙ্গ-মার্কিন ও চীন-রাশিয়া-ইরান-পাকিস্তান স্নায়ুযুদ্ধ নতুন করে ডানা মেলবে কি না সেটা সময়ই বলে দেবে। কিন্তু একথা এখন বলাই যায় যে, মার্কিন সৈন্য বিদায় নেওয়ার পর দক্ষিণ এশিয়ার ও মধ্য এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের সূচনা ঘটবে।

আফগানিস্তানে যুগে যুগে অনেক ফিরিঙ্গিই এসেছে, কিন্তু আফগানরা বারবারই তাদের প্রতিহত করেছে। প্রতিবারই এইসব ফিরিঙ্গিরা তাদের নিজেদের স্বার্থের জন্যই কাবুলকে ব্যবহার করেছে। এবারও যারা তাদের পাশে রয়েছে তারাও কিন্তু তাদের নিজেদের স্বার্থে আফগানদের সাথে স্থিতিশীলতা চায়। আফগানরা কি পারবে এইবার তাদের সত্যিকার উন্নয়ন করতে? নাকি এবারও তারা ভূ-রাজনীতির হাব হিসাবে ব্যবহৃত হবে? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আরও বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

লেখক: কর্মকর্তা , বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :