কিশোর লিটু কখনো হকার কখনো যোদ্ধা

আলম রায়হান
| আপডেট : ০৭ মে ২০২২, ২০:৩০ | প্রকাশিত : ০৭ মে ২০২২, ১২:৩৪

১৯৭১ সালে লিটু কর্মকারের বয়স ১২-১৩ বছর। কিশোর বয়সেই লিটু কর্মকার পাক হানাদার বাহিনীর নিষ্ঠুরতা দেখেছেন। দেখেছেন পাক বাহিনী নতুন বাজারের রাস্তা দিয়ে কতটা সতর্কতার সঙ্গে এগিয়েছে। বাবাকে ধরে নিতে দেখেছেন, যার খোঁজ আর কোনো দিন পাওয়া যায়নি। আবার মুক্তিকামী মানুষের সাহসও দেখেছেন লিটু কর্মকার।

প্রসঙ্গক্রমে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেন লিটু কর্মকার। বরিশাল দখলের দিন বিকেলে মড়কখোলা এলাকায় মানুষ জটলা করে উত্তর দিকে আগুন জ্বলতে দেখছিল। সাড়ে তিনটার দিকে দক্ষিণ দিক থেকে ওয়াপদার একটি জিপ এসে ব্রিজের ওপর থামে। চালক ও তার পাশে একজন। দুজনের সঙ্গেই রাইফেল। গামছায় মোড়ানো ছিল বাড়তি গুলি। তারা আগুনের উৎসের দিকে যেতে চাইলো। এই জিপে উঠে পড়লো দুরন্ত কিশোর লিটু কর্মকার ও তার সমবয়সী বন্ধু অনিমেশ। জিপটি কয়েক কিলোমিটার সামনে যাবার পর হঠাৎ পাক বাহিনী হামলা চালায়। এরা ধান ক্ষেতে লুকিয়ে ছিল। প্রথম দফার ব্রাশফায়ারে ড্রাইভারের পাশে থাকা ব্যক্তিটি গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যায়। অবস্থা বেগতিক দেখে চালক দ্রæত পিছনের দিকে জিপ চালাতে শুরু করেন অবিশ্বাস্য গতিতে। প্রায় দুই কিলোমিটার ব্যাকে আবহাওয়া অফিসের সামনে এসে ড্রাইভার পাক আর্মির প্রতি গুলিবর্ষণের জন্য উদ্ধত হয়। কিন্তু অনুনয়- বিনয় করে তাকে নিবৃত্ত করে কিশোর অনিমেশ। তার বাসায় ফেরে সন্ধ্যা নাগাদ। রাত আটটার দিকে লিটু কর্মকার ও তার অপর দুই ভাই ঘরের সঙ্গে লাগোয়া দোকানের চালায় শুয়ে দেখেছে নতুন বাজারের রাস্তা দিয়ে নিচু হয়ে পাক বাহিনীর সতর্ক অনুপ্রবেশ।

বরিশাল দখল করার একদিন পর ২৭ এপ্রিল লিটু কর্মকারের বাবা উপেন্দ্র কর্মকারকে পাক বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। এরপর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। অনেকেই তাকে পালিয়ে যেতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি নিজের মাটি ছেড়ে যেতে চাননি। বলেছিলেন, আমি রাজনীতির ধারেকাছে নেই। আমাকে কেন মারবে! হয়তো তিনি ধারণা করতে পারেননি পাক বাহিনীর লক্ষ্য হচ্ছে গণহত্যা। যে কারণে তিনি কারও সাবধান বাণী আমলে নেননি। এমনকি কানে তোলেননি সন্তানদের কথাও। লিটু কর্মকার জানালেন, বিভিন্ন স্থানে লাশ পড়ে থাকার কথা বাবাকে জানিয়েছিলাম। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। বরং বলেছিলেন, ভয় পেলে তোরা যা, আমি যাবো না! আসলে তিনি নিজের মাটি ছাড়তে চাননি। দেশের মাটির প্রতি তার এই মমতার মূল্য দিতে হয়েছে পাক বাহিনীর হাতে প্রাণ দিয়ে।

লিটু কর্মকার জানান, ২৭ এপ্রিল সকাল ৮টার দিকে নতুন বাজার এলাকায় মিলেটারি এসে দোকানপাটের ঝাঁপ খোলায়। বিভিন্ন জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। অনেকের লুঙ্গি খুলে পরীক্ষা করে। পাকিস্তানি পতাকা উড়িয়ে নির্ভয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে বলে। এ সময় উপেন্দ্র কর্মকারকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ওইদিনই বেলা সোয়া তিনটার দিকে পাক বাহিনী এসে তাকে চোখ বেঁধে নিয়ে যায়। সঙ্গে ছিল স্থানীয় সহযোগীরা। এরপর উপেন্দ্র কর্মকারের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।

শুধু তাই নয়, উপেন্দ্র কর্মকারের তিন ছেলেকেও হত্যা করার জন্য এসেছিল পাক বাহিনী। ভাগ্যক্রমে পিছন দিয়ে তারা পালিয়ে বেঁচেছেন। তিনজনের মধ্যে তখন কেবল যতিন কর্মকার ১৮ বছরের সদ্য যুবক এবং বাকি দুজন কিশোর। রবিন কর্মকারের বয়স ১৪-১৫ বছর, আর সবচেয়ে ছোট লিটু কর্মকারের বয়স ১২-১৩ বছর। এদিকে তাদের বড় ভাই ২০-২২ বছরের সচিন কর্মকার আগেই মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন বেগের সঙ্গে।

বাবাকে পাক আর্মি ধরে নেওয়া প্রসঙ্গে লিটু কর্মকার বলেন, দুপুর বেলা কিছু ভাঙ্গার শব্দ পেয়ে তিনি দোতলা থেকে নিচে নামেন। দেখলেন পাক আর্মি ঝাঁপ ভাঙ্গার চেষ্টা করছে। তিনি দ্রæত উপরে গিয়ে তার বাবাকে বিষয়টি জানান। তার মা অমঙ্গলের আশঙ্কা করে ছেলেদের দ্রæত পালিয়ে যেতে বলেন। মায়ের আদেশে যতিন ও লিটু দোতলা দিয়ে লাফিয়ে পড়ে বাড়ির পিছন দিয়ে পালিয়ে যায়। এদিকে পালাবার সুযোগ না পেয়ে রবিন ঘরের ভিতরই লুকিয়ে ছিল মোড়ানো শীতলপাটির মধ্যে। সে দেখেছে তার বাবা উপেন্দ্র কর্মকারকে ধরে নেওয়ার দৃশ্য।

পরদিন ২৮ এপ্রিল তিন ভাই যতিন, রবিন ও লিটু দেশ ত্যাগের উদ্দেশে ঘর ছাড়েন। তাদের ভরসা ছিল পাক আর্মিদের লুট করা ব্যবসায়িক সিন্দুকে পড়ে থাকা খুচরা পয়সা। তিন ভাই পকেটে যতটা সম্ভব এই খুচরা পয়সা নিয়ে অজানার পথে পা বাড়ালেন। সন্ধ্যায় তারা কীর্তিপাশা পৌঁছান। দুই দিন পর কুড়িয়ানায় পৌঁছে বড় ভাই ক্যাপ্টেন সচিনের সাক্ষাৎ পান। সেখানে ক্যাপ্টেন বেগের ক্যাম্প ছিল। তারা পৌঁছানোর ২০-২৫ দিন পরে বড় রকমের ঘটনা ঘটে।

শতাদশ কাঠিতে লঞ্চে করে পাক আর্মি এসে হিন্দুদের ঘরবাড়িতে আগুন দেয়। এ সময় একদল গ্রামবাসী ডাবসহ নানান খাবার দিয়ে হানাদারদের আপ্যায়ন করতে থাকে। হানাদার বাহিনী এক ধরনের পিকনিক মুডে ছিল। সেখানে মুক্তিবাহিনী হামলা করতে পারে তা বিবেচনা করেনি। কিন্তু যা তাদের বিবেচনায় ছিল না, তাই ঘটলো। ক্যাপ্টেন বেগের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী হঠাৎ পাক বাহিনীর ওপর হামলা চালায়। অতর্কিত এ হামলায় কিছু বুঝে উঠতে পারার আগেই ৪ পাক সেনা ঘটনাস্থলে নিহত হয়। বাকিরা মেশিন গানের গুলির কাভারেজে লঞ্চে উঠে দ্রুত পালিয় যায়।

সেনাবাহিনীর লোক হিসেবে এর প্রতিক্রিয়া জানতেন ক্যাপ্টেন বেগ। লিটু কর্মকারের বর্ণনা মতে, ক্যাপ্টেন বেগ সবাইকে ডেকে অনিবার্য পাল্টা আক্রমণের কথা জানালেন। তিনি আরও বললেন, সেই আক্রমণ মোকাবিলা করার সক্ষমতা মুক্তিযোদ্ধাদের নেই। তিনি প্রত্যেককে ৫০ টাকা করে দিয়ে এলাকা ছাড়তে বললেন। সে সময় ওই ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ছিল ২২ জন। এর মধ্যে দুজন নারী যোদ্ধাও ছিলেন। তারা হচ্ছেন বিথি হালদার ও শিশির কনা মল্লিক। মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রগুলো মাটিতে পুঁতে রাখা হলো। লিটু কর্মকারের ভাষ্য মতে, ক্যাপ্টেন বেগের আশঙ্কাই সত্য হলো। প্রতিশোধ হিসেবে পাক বাহিনীর প্রায় সাতশ থেকে সাড়ে সাতশ সদস্যের একটি দল কুড়িয়ানায় দিনভর ব্যাপক গণহত্যা চালায়। সেদিন প্রায় ৮ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এ সময় পেয়ারা গাছগুলো কেটে ফেলা হয়। চারদিকে কেবল মানুষের লাশ আর কাটা গাছে একাকার হয়ে গিয়েছিল পুরো এলাকা।

কুড়িয়ানা ছেড়ে ছড়িয়ে পড়ার সময় কেউ ধরেছেন ভারতের পথ। কেউ ফিরে গেছেন নিজ এলাকায়। যারা ফিরে এসেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন ভুলু, সাত্তার বাবুল, আলতাফ, মালেক, সাইদুর রহমান টিটু প্রমুখ। এদের মধ্যে এ এম জি কবীর ভুলু অস্ত্রসহ পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। সে সময় শান্তি কমিটির নেতা রব উকিলের মুহুরি ছিলেন ভুলুর বাবা। এই সূত্রে তিনি প্রাণে বেঁচে যান। এছাড়া এনএসএফের নেতা হিসেবেও এম জি কবীর ভুলু কিছুটা আনুক‚ল্য পেয়েছেন বলে ধারণা করা হয়। এরপরও তাতে নজরদারির মধ্যে থাকতে হয়েছে। এদিকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে মোস্তাক হোসেন সেন্টু বাকেরগঞ্জ যুদ্ধে শহীদ হন। টিপু যোগ দিয়েছিলেন মেজর জিয়ার দলে। তিনি শহীদ হন পারেরহাটের সম্মুখযুদ্ধে।

এদিকে চার ভাই সচিন, যতিন, রবিন ও লিটু ভারতের পথ ধরেন। সচিন আবার যুদ্ধে নিয়োজিত হন। ৯ আগস্ট কমিশনপ্রাপ্ত হবার পর ক্যাপ্টেন সচিন টিম পরিচালনা শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধে যতিন কর্মকার প্রধানত মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে অস্ত্র সরবরাহের কাজ করেছেন। গোলপাতার নিচে লুকিয়ে নৌকায় করে তিনি ক্যাম্পে ক্যাম্পে অস্ত্র পৌঁছে দিতেন। আবার ফেরার পথে মুক্তিযুদ্ধে আগ্রহী যুবকদের নিয়ে যেতেন ভারতে। আর কিশোর রবিন ও লিটু ছিলেন কখনো হকার, আবার কখনো যোদ্ধা। বয়সের সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে তারা গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করতেন। এ সময় লিটু কর্মকার কখনো টুপি পরে বাদাম বিক্রি করেছেন। কখনো আবার নাগরা জুতা পরে হাঁটতেন। যেন শিশু মাওলানা! কিশোর বলে তাদেরকে সম্মুখযুদ্ধে নেওয়া হতো না। তবু তারা পালিয়ে যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে লিটু কর্মকার রণাঙ্গনের মুখপত্র বিপ্লবী বাংলাদেশের সঙ্গে জড়িয়ে যান। প্রধানত ট্রেনে পত্রিকা বিক্রি করতেন। এভাবে চলে যেতেন বহু দূর। কোনো কোনো দিন তাদের ফেরা হতো না। বিপ্লবী বাংলাদেশ বিক্রি করার সুবাদে তাদের বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে। অনুভব করেছেন মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ভারতের সাধারণ মানুষ কতটা সহানুভ‚তিশীল। শুধু তাই নয়, এই পত্রিকা বিক্রির সুবাদেই লিটু কর্মকার মুক্তিযুদ্ধের অনেক ঘটনা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেয়েছেন। পেয়েছেন ৮নং সেক্টর কমান্ডার মঞ্জুরের মমতার পরশ। একবার একত্রে রাতের খাবার খাওয়ার কথা তিনি আজও আবেগের সঙ্গে স্মরণ করেন। শুধু তাই নয়, পরদিন সকালে তিনি যখন ফিরে আসেন তখন ৮নং সেক্টর কমান্ডার মঞ্জুর তাকে একশ টাকা দিয়েছিলেন। সেই সময়ের বাস্তবতায় একশ টাকার মূল্য ছিল অনেক। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা জেনারেল মঞ্জুর আর এক মুক্তিযোদ্ধা প্রেসিডেন্ট জিয়া হত্যার দায় নিয়ে রহস্যজনকভাবে নিহত হয়েছেন ১৯৮১ সালে। জেনারেল মঞ্জুর হত্যা মামলার বিচারাধীন প্রধান আসামী থাকাকালে স্বাভাবিক মৃত্যু বরণ করেছেন তৎকালীন সেনা প্রধান এবং অঘটন ঘটন পটিয়শী জেনারেল এইচ এম এরশাদ।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :