সংস্কৃতির আধিপত্যের কবলে হিরো আলম

জামসেদুল ইসলাম
  প্রকাশিত : ০২ আগস্ট ২০২২, ১৯:৩০
অ- অ+

মোতাহের হোসেন চৌধুরী ‘সংস্কৃতি কথা’ গ্রন্থে বলেন, ‘সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত কালচারের উদ্দেশ্য নয়- উপায়। উদ্দেশ্য নিজের ভেতরে একটা ইশ্বর বা আল্লা সৃষ্টি করা। কালচার্ড লোকেরা সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে অন্যায় আর নিষ্ঠুরতাকে; অন্যায় নিষ্ঠুরতাকে তো বটেই, ন্যায় নিষ্ঠুরতাকেও। মানুষকে ন্যায়সঙ্গতভাবে শাস্তি দিতেও তাদের বুক কাঁপে। তাই একটা ব্যক্তিগত জীবন-দর্শন বা স্বধর্ম্ম সৃষ্টি করা কালচারের উদ্দেশ্যে। ব্যক্তির ভেতরের ‘আমি’কে সুন্দর করে তোলাই তার কাজ।’

সংস্কৃতি মানুষের ধর্ম, জীবন-যাপন, দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তা-ভাবনার সম্মিলিত রূপ। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, শ্রেণী নির্বিশেষে সংস্কৃতির চর্চা বিভিন্নতর। কিন্তু এ সংস্কৃতি আবার অর্থ বা পুঁজির বিকাশের ফলে সংস্কৃতির মাঝে শ্রেণী বিভাজন তৈরী হয়েছে। যার ফলে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, ও নিম্নবিত্তের মাঝে সংস্কৃতির একটা বিরাট পার্থক্য তৈরী হয়েছে। ব্যক্তি তার ইচ্ছানুযায়ী সংস্কৃতি গ্রহণ ও বর্জন করতে পারে। এটা ব্যক্তির সম্পূর্ণ ব্যক্তিস্বাধীনতা। কোনো ব্যক্তি বা সমাজ বলপ্রয়োগের মাধ্যমে শ্রেণীর দোহাই দিয়ে বাধা দিতে পারে না। ব্যক্তি তার সৌন্দর্য্য ও বিকাশের চেষ্টা করে। সেটা কোন শ্রেণীর সংস্কৃতিকে গ্রহণ ও বর্জন করবে সেটা নিজস্ব সিদ্ধান্ত।

গ্রামসির দর্শনে ‘অর্থনীতিবাদের’ বিপরীতে ‘হেজেমনির’ উল্লেখ পাওয়া যায়। যেটা অর্থনৈতিক স্বার্থের চেয়ে বেশি কিছু অবস্থান করে। তার মধ্যে বিদ্যমান থাকে রাজনৈতিক স্বার্থও। অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিভিন্ন উসিলা তৈরী করে আধিপত্য বিস্তার করে শাসিত শ্রেণী। পুঁজিবাদী সমাজে বুর্জোয়াদেরকে দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। সেজন্য গ্রামসি বুর্জোয়াদের সাংস্কৃতিক কাঠামোর বিরুদ্ধে অবস্থান করার পরামর্শ দিয়েছিলেন।

যখন অর্থ ও বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রভাব একই সাথে পোক্ত হয় তখন ‘সংস্কৃতির আধিপত্যের’রূপ আরও ভয়াবহ হয়ে উঠে। সাংস্কৃতিক পার্থক্য তৈরী হয়। বুর্জোয়া ও অন্যান্য শ্রেণীর সাথে সাংস্কৃতিক ভারসাম্য বিরাজমান হয় না। রাষ্ট্রীয়ভাবে বুর্জোয়াদের পালিত সংস্কৃতির একটা বড় ধরণের প্রভাব পড়ে অন্যান্য শ্রেণীদের মধ্যেই। যার জন্য পুরো জনসমাজ রাষ্ট্রীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে না। গ্রামসি বলেছিলেন, নগররাষ্ট্রের অভিজাতদের পরিসর পেরিয়ে বৃহত্তর সমাজে কোনো চেতনা বা বিশ্বাস তৈরী করতে পারেনি।

সংস্কৃতি নিয়ে আধিপত্য বিস্তার করা এটা এক প্রকারের সাম্রাজ্যবাদ রাষ্ট্রের লক্ষণ। সঙ্গীত একটি সাংস্কৃতিক বিষয়। সঙ্গীত সর্বসাধারণের গাওয়ার স্বাধীনতা আছে। বাংলাদেশে সঙ্গীতাঙ্গনে কপিরাইট নিয়ে আইনিভাবে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। কপিরাইট থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বিভিন্ন শিল্পীরা। কিন্তু এ বিষয়টি নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এটার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক আইন গঠন করে বিষয়টি সম্পর্কে সুষ্ঠুভাবে সবাইকে আইনের আওতাভুক্ত করা জরুরি।

হিরো আলমের গান নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা, সমালোচনা, হাসি-তামাশা দেখা দিয়েছে। এটা একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে হতেই পারে। সেটা একান্ত তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত যদি ক্ষতিকর প্রভাব তৈরী না হয়। আইনগতভাবে অবৈধ হলে তার জন্য প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু সম্প্রতি পুলিশ হিরো আলমের নিকট থেকে মুছলেকা নিয়েছে যে তিনি রবীন্দ্র ও নজরুল সঙ্গীত গাইতে পারবেন না। এটা কোনোভাবে কাম্য নয়। বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি তার বিরুদ্ধে অবস্থান করছে। তার শ্রেণীগত, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান নিয়ে নিত্যনৈমিত্তিক নানা প্রশ্ন তৈরী হচ্ছে। তার এ কাজকর্ম একটা বিপুল সংখ্যক অনুসারীও রয়েছে। যারা তার কাজে অনুপ্রাণিত হচ্ছে। তাতে সংস্কৃতির কেমন অবক্ষয় হচ্ছে সেদিকে খুব একটা নজর যায় না। অথবা গেলেও তা কতটুকু বিস্তার লাভ করেছে। শুধু তাই নয় তার শারীরিক ও শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়েও বিভিন্ন রকমের প্রশ্ন তৈরী হয়েছে। বাংলাদেশের শিক্ষিতের হার এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। হিরো আলমের যারা অনুসারী তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা কেমন সে প্রশ্নও কোনোভাবে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। যার জন্য তাদের চিন্তা-ভাবনা, সাংস্কৃতিক উপাদান, সামাজিক অবস্থানের মাঝে বৈষম্য তৈরী করছে। নিজেদেরকে আলাদা সংস্কৃতি, ভাষা, শ্রেণী বলে দাবী করছে। এ শ্রেণীর মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যতা সমাজে যখন চূড়ায় পৌঁছায় তখন রাষ্ট্রে এমন রকমের কাজ হরহামেশা দেখা যায়।

‘কালচারাল হেজেমনি’ ও শ্রেণীগত কোনো আধিপত্যের কারণে হিরো আলমের প্রতি এমন আচরণ কোনোভাবে কাম্য নয়। রবীন্দ্র ও নজরুল সংগীত অনুরাগী হিরো আলমের গান গাওয়াকে তাদের আত্মমর্যাদায় ব্যাঘাত ঘটেছে বলে মনে করলেও এভাবে তাকে মুছলেকা নেওয়া একটা শ্রেণীগত সমস্যা।

লেখক: সাংবাদিক

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
নোয়াখালীতে বন্দুকসহ মাদক কারবারি আটক 
যেভাবে আওয়ামী লীগবিরোধী মুখ হয়ে ওঠেন আন্দালিব পার্থ
কলাবাগানে ৪০ কেজি গাঁজাসহ মাদক কারবারি গ্রেপ্তার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে দৃষ্টিনন্দন-পরিবেশবান্ধব বৈদ্যুতিক শাটল গাড়ির যাত্রা শুরু
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা