বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম ও আগামীর বাংলাদেশ

ড. আতিউর রহমান
 | প্রকাশিত : ১৫ আগস্ট ২০২২, ১৩:৪৭

১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তির ডাক দিয়েছিলেন। সেই মুক্তির পরিধি ছিল ব্যাপক। অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়াও বাঙালির রাজনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির জন্য সর্বব্যাপী সংগ্রামের ডাক তিনি সেদিন দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের মানুষ পঁচিশে মার্চের গণহত্যার প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতা ঘোষণা শোনামাত্র মুক্তিযুদ্ধে নেমে পড়েন। বিশেষ করে, অগুনতি তরুণ-তরুণী স্বাধীন দেশের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত ছিল। তাই স্বদেশের মুক্তির জন্য লাখ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানে বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্পর্শ করেন বাংলাদেশের মাটি। মাটি ও মানুষকে পুঁজি করে শুরু করেন অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের এক অবিস্মরণীয় অভিযাত্রা। যুদ্ধবিধ্বস্ত সেই বাংলাদেশকে তাঁর কুশলী নেতৃত্ব দিয়ে অচিরেই স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যেতে শুরু করেছিলেন। বৈরী প্রকৃতি ও কুটিল বৈশ্বিক কূটনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই তিনি আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ, শরণার্থীদের পুনর্বাসন, কৃষি ও শিল্পের আধুনিকায়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের পুনর্গঠন নিশ্চিত করে তিনি দ্রুতই বাংলাদেশকে উন্নয়নের মহাসড়কের দ্বারপ্রান্তে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন।

কিন্তু ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের কালরাত্রিতে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর থেমে যায় বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের সম্ভাবনাময় অভিযাত্রা। পুরো জাতি যে সমতাভিত্তিক সমাজের আকাক্সক্ষা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তাঁর অবর্তমানে দেশ চলতে শুরু করে ঠিক তার বিপরীত দিকে। অবশ্য বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ আবার সঠিক পথে ফিরেছে। বহু কষ্টে তিনি সারা পৃথিবীর সামনে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে হাজির করতে সক্ষম হয়েছেন। আমরা আশাবাদী যে ‘ডেমোগ্রাফিক’ ও ‘ডেনসিটি ডিভিডেন্ডে’র কল্যাণে বাংলাদেশের এই সাফল্যের ধারা আরও কয়েক দশক ধরে অব্যাহত থাকবে। আর এসব কারণেই বাংলাদেশের উন্নয়নের গল্পটি এতটা চমকপ্রদ। আর এর ভিত্তি গড়ে দিয়ে গেছেন বঙ্গবন্ধু। এই প্রেক্ষাপটেই বঙ্গবন্ধুর কল্যাণমুখী উন্নয়ন সংগ্রামের দর্শন ও অনুশীলনের কিছু দিক এখানে আলোচনা করতে চাই।

অর্থনীতি আর সংস্কৃতি যে পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে চলে, এটা বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই অনুধাবন করেছিলেন। ১৯৪৮ সাল থেকেই তিনি পূর্ববাংলার অর্থনীতির ভঙ্গুরদশা নিয়ে আলোচনা করছেন। তিনি সহজেই বুঝতে পারেন জমিদারি ব্যবস্থায় কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হবে না। ১৯৪৮ সালের ১৩ আগস্ট ইত্তেহাদ পত্রিকায় শেখ মুজিবের যে বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছিল, তাতেই বোঝা যায় যে তিনি পাকিস্তানের ‘আজাদী’কে কোন দৃষ্টিতে দেখতেন।

তাঁর ভাষায়, ‘১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট আমরা যে আজাদী লাভ করিয়াছি, সেটা যে গণ আজাদী নয়, তা গত একটি বছরে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হইয়াছে। “জাতীয় মন্ত্রিসভা” দীর্ঘ একটি বছরে জনগণের দুইশ বছরের পুঞ্জীভূত দুঃখ-দুর্দশা মোচনের কোনো চেষ্টা তো করেন নাই, বরঞ্চ সেই বোঝার উপর অসংখ্য শাকের আঁটি চাপাইয়াছেন। বুখা, বিবস্ত্র, জরাগ্রস্ত ও শত অভাবের ভারে ন্যুব্জ জনসাধারণের ভাত, কাপড়, ওষুধপত্র ও অন্যান্য নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যের কোনো ব্যবস্থা তাঁরা করেন নাই; বরঞ্চ পাট, তামাক সুপারী ইত্যাদির উপর নয়া ট্যাক্স বসাইয়া ও বিক্রয়-কর বৃদ্ধি করিয়া জনগণের দৈনন্দিন জীবন দুর্বিষহ করিয়া তুলিয়াছেন। বিনা খেসারতে জমিদারি বিলোপের ওয়াদা খেলাফ করিয়া তাঁরা জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগীদিগকে পঞ্চাশ-ষাট কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করিতেছেন। নতুন জরীপের নাম করিয়া তাঁরা জমিদারী প্রথার সম্পূর্ণ বিলোপ আট বছর স্থগিত রাখার ষড়যন্ত্র করিতেছেন।’ (‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’, শেখ হাসিনা (সম্পাদিত), ভলিউম-১, হাক্কানী পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা- ৪৪)

তা ছাড়া পুরো প্রদেশেজুড়ে খাদ্য, বস্ত্র ও শিক্ষার যে সংকট দেখা দিয়েছিল, তিনি তার বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ গড়ে তোলেন। পরবর্তী সময়ে প্রতিবাদের এই ধারা আরও তীক্ষè হয়। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান সরকারের ‘ফেডারেল কন্ট্রোল অব ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাক্ট’-এর ঘোর বিরোধী ছিলেন। কারণ, এর মাধ্যমে শিল্পখাতের পুরো নিয়ন্ত্রণ চলে যায় কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। এই বৈষম্য দূর করে পূর্ব বাংলার জনগণের ভাগ্য ফেরাতে বঙ্গবন্ধু দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন। তাই যখন তিনি প্রাদেশিক সরকারের শিল্পমন্ত্রী হন, তখন পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পক্ষেত্র উন্নয়নের লক্ষ্যে আপ্রাণ চেষ্টা করেন। রপ্তানি আয়ের যথোপযুক্ত অংশ যেন পূর্বাঞ্চলের (বাংলাদেশ) জন্যও যথাসাধ্য ব্যয় হয়, এ ব্যাপারে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে অক্লান্তভাবে বাদানুবাদ করতে থাকেন। এরই ফল ১৯৬৬ সালের ৬ দফা। ৬দফা মূলত ছিল ‘দুই অর্থনীতি তত্ত্ব’। অর্থনীতি সম্পর্কে কতটা সচেতন থাকলে তখনকার মেধাবী অর্থনীবিদদের এক করে তিনি এটাকে একটা আন্দোলনে রূপ দিয়েছিলেন, তা সহজেই বোঝা যায়। ছয়দফারই বহিঃপ্রকাশ উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান এবং ’৭০-এর নির্বাচন। একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায় এইসব আন্দোলন বিকশিত হয়েছে অর্থনীতিকে সামনে রেখেই। গরিব কৃষক-শ্রমিকদেরও তিনি বুঝিয়েছেন স্বাধীন না হলে এ দেশের অর্থনীতি কোনোদিন সমৃদ্ধির মুখ দেখবে না। পিছিয়ে পড়া এক জনগোষ্ঠী বিপুল ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে যে ’৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ী করল, তার পেছনে ছিল তাঁদের ভাগ্য পরিবর্তনের আশা।

মুক্তিযুদ্ধের পরপর দেশ যে একটা বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যে রয়েছে, তা বঙ্গবন্ধু নিশ্চিতভাবেই অনুধাবন করেছিলেন। কিন্তু পাশাপাশি অসংখ্য বাধা মোকাবিলা করে সাফল্য পাওয়ার যে সক্ষমতা এ দেশের জনগণের রয়েছে, সে সত্যটিও তিনি জানতেন। ১৯৭২ সালে প্রজাতন্ত্রের যে সংবিধান প্রস্তুত করা হয়, সেখানেও তাঁর অন্তর্ভুক্তিমূলক সমৃদ্ধির দর্শন প্রতিফলিত হয়। নিঃসন্দেহে তিনি সঠিক পথেই এগোচ্ছিলেন। স্বাধীনতার অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার অনেকটাই বাস্তবে রূপ দিতে পেরেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর বৈপ্লবিক নেতৃত্বের কল্যাণে যুদ্ধবিধ্বস্ত অবকাঠামো এবং সত্যিকার অর্থে কোনো নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান না থাকা সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতি দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। দেশের ভেতরে ও বাইরে বেশ কিছু প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে তখন খাদ্যশস্যের ভয়াবহ সংকট চলছিল। ওই সময়টায় আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও খাদ্যের সংকটের পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জও বঙ্গবন্ধুর সরকারকে মোকাবিলা করতে হয়েছিল। আর এগুলো মোকাবিলার জন্য তাঁর হাতে সম্পদও ছিল খুব সীমিত। অল্প দেশজ সম্পদ এবং কিছু আন্তর্জাতিক সহায়তা নিয়েই তিনি ধ্বংসস্তূপ থেকে দেশের অর্থনীতিকে তুলে আনতে পেরেছিলেন। তাঁর শক্তিশালী এবং অনুপ্রেরণাদায়ী নেতৃত্বের গুণে এ দেশের মানুষও নিজেদের লড়াই করার শক্তির ওপর আস্থাশীল হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু নিয়তির লিখন ছিল অন্য রকম। তাঁকে হারাবার পর প্রায় ৪৪ বছর পেরিয়ে গেছে। তবু আজও তিনি তাঁর কন্যাদের এবং আমাদেরকে চেতনার জায়গা থেকে সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছেন। নিরন্তর সাহস ও অনুপ্রেরণা দিচ্ছেন আমাদের বিস্ময়কর উন্নয়ন অভিযাত্রায়। কৃষির উন্নয়ন ছিল বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শনের অন্যতম প্রধান মনোযোগের জায়গা। তাঁর কন্যার শাসনামলেও দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে কৃষি খাতকে। বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির ধারা প্রতিবেশী দক্ষিণএশীয় দেশগুলোর তুলনায় বেগবান থেকেছে। এটা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই আমরা স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবেই একটি উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরিত হতে যাচ্ছি।

কৃষি ও শিল্প খাতের পারস্পরিক নির্ভরতারবিষয়ে সচেতন ছিলেন বঙ্গবন্ধু। যেমন সার অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণ। তাই বঙ্গবন্ধু সারা দেশে সারকারখানা স্থাপন ও সেগুলো চালু করাকে দিয়েছিলেন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। বঙ্গবন্ধু জানতেন যে শিল্পায়নের কোনো বিকল্প নেই। একদিকে শিল্পায়নের ফলে উৎপাদিত পণ্য দেশের ভেতরের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি রপ্তানি আয় নিশ্চিত করে, অন্যদিকে শিল্প খাতে বর্ধিষ্ণু জনশক্তির জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। তবে সম্ভবত সদ্য স্বাধীন দেশে শিল্পায়নই ছিল বঙ্গবন্ধুর সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, তখন বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল শূন্য, কোনো বিদেশি বিনিয়োগ ছিল না, ব্যাকওয়ার্ড ও ফরওয়ার্ড লিংকেজও ছিল সামান্য। সর্বোপরি খুব অল্প লোকেরই প্রয়োজনীয় উদ্যোক্তাসুলভ দক্ষতা ছিল।

আর সে কারণেই শুরুতেই রাষ্ট্রীয় খাতের প্রাধান্য দিয়ে অর্থনীতিকে চাঙা করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। তবে এ কথা মানতেই হবে যে বঙ্গবন্ধুর চিন্তাভাবনা সব সময়ই ছিল উদ্যোক্তাবান্ধব। তাই কীভাবে উদ্যোক্তাদের বিকাশের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা যায়, সেদিকে সব সময় মনোযোগ দিয়েছেন। আগেই যেমনটি উল্লেখ করেছি, এমনকি যখন প্রাদেশিক সরকারের শিল্পমন্ত্রী ছিলেন তখনো তিনি ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ করার উদ্যোগ নিয়েছেন। তবে স্বাধীনতা-পরবর্তী পরিস্থিতি ছিল পুরোপুরি ভিন্ন। সে সময় এ দেশে ব্যক্তিখাতের বিকাশের বাস্তবতা প্রায় ছিলনা বললেই চলে। সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশে তাই বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে শিল্প খাতের বিকাশের যথোপযুক্ত নীতি গ্রহণ করেছিলেন। সব পাকিস্তানি উদ্যোক্তা ও ব্যবস্থাপকেরা তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর টাকাপয়সা ও অন্যান্য উপকরণ সঙ্গে করে নিয়ে চলে যাওয়ায় স্বাধীনতার পরপর বঙ্গবন্ধু বড় বড় ব্যাংক ও বিমা প্রতিষ্ঠান, পাট ও চিনিকল এবং টেক্সটাইল কারখানা রাষ্ট্রীয়করণ করেছিলেন। এবং এর প্রাথমিক ফলাফল ছিল সত্যিই চমকপ্রদ।

প্রাথমিক পর্যায়ে সংগত কারণেই রাষ্ট্রায়ত্তকরণের মাধ্যমে শিল্প বিকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেও, বঙ্গবন্ধুর মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছিল ব্যক্তি খাতের বিকাশের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশের জাতীয় বাজেট প্রস্তাবনাগুলোর দিকে তাকালেই এর প্রমাণ মেলে। যেমন ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা ২৫ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩ কোটি টাকা করা হয়, এবং ব্যক্তিখাতের উদ্যোগে শিল্পকারখানা স্থাপনের সুযোগ রাখা হয়। এছাড়া বঙ্গবন্ধুর সরকারের আমলেই পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া ১৩৩টি কারখানা ব্যক্তিখাতে হস্তান্তর করা হয়েছিল। ফলে বোঝাই যাচ্ছে যে ‘ডিরেগুলেশন’-এর প্রথম পর্যায় শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর আমলেই।

এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে সুবিবেচনাভিত্তিক কৃষি ও শিল্প নীতির আলোকে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু অপশক্তি তাঁকে আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল এবং আমরা অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের পথ থেকে সরে এসেছিলাম। বহু বছর এবং বহু সংগ্রাম ও ত্যাগের পর আমরা তাঁর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়ন অভিযাত্রার পথে আবার ফিরে আসতে পেরেছি। এখন প্রধানমন্ত্রী সামনে থেকে আমাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং ওপর থেকে টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নীতির মূল সুর ঠিক করে দিচ্ছেন। তাঁর সহযোগী নেতৃত্ব এবং জনপ্রশাসনের জন্য চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এই মূল লক্ষ্যগুলোকে ছোট ছোট বাস্তবায়নযোগ্য পদক্ষেপে বিভক্ত করে সেগুলোর মানসম্পন্ন বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।এ জন্য আমাদের পদ্মা সেতু, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, বড় বড় পাওয়ার প্ল্যান্ট, গভীর সমুদ্রবন্দর, মেট্রোরেল, রেলওয়ের উন্নয়ন, নদীপথের উন্নয়ন এবং সর্বোপরি ই-কমার্স ও এফ-কমার্সের জন্য প্রয়োজনীয় ডিজিটাল অবকাঠামো প্রস্তুত করার মতো মেগা উদ্যোগগুলো সময়মতো বাস্তবায়ন করতে হবে। আমাদের শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে বিরাজমান বেকারত্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য দক্ষতা উন্নয়ন এবং ডিজিটাল উদ্যোক্তা তৈরির দিকেও বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। কৃষির সব উপখাতে যান্ত্রিকীকরণেও আমাদের বিশেষ উদ্যোগী হতে হবে। সর্বোপরি এসডিজিগুলো যথাসময়ে বাস্তবায়ন করার জন্য আমাদের কৃষি উৎপাদন দ্বিগুণ করতে হবে, দারিদ্র্য ও ক্ষুধা পুরোপুরি নির্মূল করতে হবে এবং একই সঙ্গে সৌরশক্তি, বায়ুশক্তিসহ সব ধরনের নবায়নযোগ্য শক্তি উৎসের যথাযথ প্রয়োগ ও প্রসারের দিকেও বিশেষ নজর দিতে হবে। এসডিজি লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নে সরকারের সঙ্গে সঙ্গে বেসরকারি খাত ও অলাভজনক সংস্থগুলোর সম্মিলিত ও সুসমন্বিত উদ্যোগ উৎসাহিত করতে হবে। চীনে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি এবং সাম্প্রতিক চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে যেসব বিনিয়োগকারী চীন থেকে সরে আসছেন তাদের বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে বিশেষভাবে উৎসাহিত করা অব্যাহত রাখতে হবে। পাশাপাশি ভারত, ভুটান, নেপাল ও বাংলাদেশ মিলে বিবিআইএন উপ-আঞ্চলিক অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক সহযোগিতা বাড়াতে কানেকটিভিটির সুযোগগুলো বাড়াতে হবে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমিয়ে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করাকে আরও সহজ করতে পারি, যাতে ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ সূচকে আমরা আরও উন্নতি করতে পারি। পাশাপাশি বহুকষ্টে গড়ে তোলা আমাদের সামাজিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে। বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহে গতি আনতে এবং ব্যাংক খাতের ঋণখেলাপি তারল্য সংকট ও পরিচালনা সমস্য সমাধানে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এই খাতসহ সর্বত্র নীতি-নৈতিকতার বিকাশে কোনো কার্পণ্য করা ঠিক হবে না।

আমরা ক্ষণে ক্ষণে এই স্বপ্নের মুখোমুখি হব এবং তার রূপায়ণে ব্রতী হব। তবে এ জন্য অবশ্যই সামাজিক-রাজনৈতিক এবং আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে। এই মহা স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব হবে কেবল অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করার মাধ্যমেই। বৈষম্যহীন অর্থনীতি ও সমাজ গড়ার যে স্বপ্নের বীজ বঙ্গবন্ধু আমাদের মনে বুনে গেছেন, আমরা তার প্রতি সদা অনুগত থাকব, সেই প্রতিজ্ঞাই করছি।

লেখক: বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :