শিক্ষক গড়ার কারিগর কে?

সাইফুল ইসলাম তালুকদার রনি
 | প্রকাশিত : ০৫ অক্টোবর ২০২২, ১২:২৫

আজ ৫ অক্টোবর, বিশ্ব শিক্ষক দিবস। উচ্চশিক্ষার জন্য শিক্ষকদের প্রস্তুত করতে ১৯৬৬ সালে এবং ১৯৯৪ সালে ইউনেস্কোর আয়োজনে দুটি বড় সম্মেলন হয়েছিল। সেই সম্মেলনের প্রস্তাবনা অনুযায়ী ১৯৯৫ সাল থেকে ইউনেস্কোর নেতৃত্বে, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এবং ইউনিসেফ, আন্তর্জাতিক শিক্ষা (ইআই) এর সহযোগিতায় সারা বিশ্বে ১০০টি দেশে শিক্ষক দিবস উদযাপন হতে যাচ্ছে।

শিক্ষকতা সমাজের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পেশা। সমাজের অন্য সকল পেশার দক্ষতা বৃদ্ধি করতে শিক্ষকতা পেশার বিকল্প নেই। ইউনেস্কো মনে করে, বিশ্ব শিক্ষক দিবস হলো এমন একটি দিবস যা শিক্ষকরা কীভাবে যুগের সঙ্গে এই পেশার পরিবর্তন হচ্ছে, আগামীর পরিবর্তনের সঙ্গে সহজে তাল মিলিয়ে নিতে এবং শিক্ষকদের জন্য চারপাশের যেমন দেশ ও জনসাধারণের যে সমর্থন প্রয়োজন তা ব্যক্ত করার জন্য একটি উদযাপন। ইউনেস্কো আরও মনে করে, এই দিবসের মাধ্যমে শিক্ষকদের অধিকার ও দায়িত্ব এবং তাদের প্রাথমিক প্রস্তুতি, পরবর্তী শিক্ষা, নিয়োগ, কর্মসংস্থান এবং শিক্ষণ ও শেখার শর্তেও মানদণ্ড নির্ধারণ করার একটি উপলক্ষ।

ইউনেস্কো প্রতি বছর এই দিবসটি উপলক্ষে একটি স্লোগান নির্ধারণ করে থাকে। এবারের বিশ্ব শিক্ষক দিবসের স্লোগান হলো, শিক্ষার পরিবর্তন শুরু হয় শিক্ষকদের মাধ্যমে। এর মানে শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন করতে হলে আগে শিক্ষকদের পরিবর্তন করতে হবে। সমাজে একটি প্রচলিত কথা রয়েছে, মানুষ গড়ার কারিগর হলো শিক্ষকরা। যাঁরা সমাজ ও দেশের আগামীর ভবিষ্যৎ গড়বেন তাঁদের গড়বে কে? শিক্ষক হলো সমাজের সবচেয়ে বিশ্বস্ত, সময়ের সকল জ্ঞান উৎপাদনকারী, সমাজে যেকোনো সমস্যার পরামর্শকারী এবং দেশের যেকোনো উন্নয়নের নীতি অংশীদার।

কিন্তু দুঃখের বিষয়, সম্প্রতি দৈনিক পত্রিকা পড়লে শিক্ষকদের ইতিবাচক দিকের চেয়ে নেতিবাচক দিকগুলো বেশি পড়তে হচ্ছে। চলতি বছরের জুন মাসে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১ হাজার ১০৮ জন শিক্ষক পাওয়া গেছে যারা জাল সনদে চাকরি করছেন বছরের পর বছর। গত ১০ বছরে ২৪ হাজার ১২৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে এই জাল সনদধারী শিক্ষক শনাক্ত হয়েছে। দেশে প্রায় দুই লক্ষাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। সবকটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সনদ যাচাই করলে জাল সনদধারী শিক্ষকের সংখ্যা কমবে না বরং বাড়বে। তাহলে এই শিক্ষকগণ শিক্ষার্থীদের কী শিক্ষা দেবেন? সমাজের আগামী প্রজন্ম গড়ার কারিগরদের যদি এই অবস্থা হয় তাহলে সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ কীভাবে বিনির্মাণ করা যাবে? আমরা পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারলাম যে, আমাদের দেশের স্বনামধন্য একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কিছু শিক্ষক ঘুষের মাধ্যমে চাকরি নিয়েছেন! কী একটা অবস্থা! যারা আলো দেবেন তারাই অন্ধকার পথ দিয়ে শিক্ষকতায় এসেছেন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আন্তঃবিভাগীয় মামলার কারণে অনেক নিয়োগ বন্ধ রয়েছে। দেশের অসংখ্য প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষকবিহীন চলছে। অধ্যক্ষ ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলছে তার সংখ্যাও নেহাত কম নয়। প্রত্যেক উপজেলায় অন্তত একটি কলেজকে সরকারি করার লক্ষ্যে ২০১৬ সালে জাতীয়করণে সম্মতিদান করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এখন পর্যন্ত ৩২৪টি কলেজকে জাতীয়করণ করার গেজেট জারি হয়েছে। তবে গত ৬ বছরে মাত্র ১০টি কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরি সরকারি হয়েছে। পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারলাম, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধ্যাপক বেশি, প্রভাষক কম! শিক্ষকরা প্রভাষক হয়েই চিন্তায় থাকেন কখন অধ্যাপক তকমা নেওয়া যায়। কারণ সুযোগ-সুবিধা আরাম-আয়েশ অধ্যাপনায় বেশি। সবাই পদোন্নতির পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লাস। শিক্ষকতা একটা আরাধনা। সময়ের শ্রেষ্ঠ তপস্যা শিক্ষকরা ভুলে যান। এই ভুলে যাওয়ার কারণ কম নয়। শিক্ষা বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে এবং নিজেও একটি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করার ফলে কয়েকটি কারণ তুলে ধরছি।

শিক্ষায় পর্যাপ্ত বিনিয়োগ নেই: আমাদের দেশে শিক্ষায় পর্যাপ্ত বিনিয়োগ নেই। যা আছে তারও সুষম বণ্টন হয় না। সুষ্ঠুভাবে ও দুর্নীতিমুক্তভাবে বরাদ্দকৃত অর্থও কাজে লাগালে শিক্ষকতার বেহাল দশা তৈরি হয় না। ভারতের নোবেল জয়ী শিক্ষাবিদ কৈলাশ সর্ত্যাথী বলেন, শিক্ষায় ১ ডলার বিনিয়োগ করলে আগামী ২০ বছরের মধ্যে ১৫ গুণ রিটার্ন পাওয়া সম্ভব। ফলে শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়িয়ে শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীদের আগ্রহ বাড়াতে হবে। আগ্রহী শিক্ষার্থীদের স্বচ্ছ ও যুগোপযোগী মূল্যায়নের মাধ্যমে এই পেশায় আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাতে হবে।

মানসম্মত প্রশিক্ষণের অভাব: পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশে শিক্ষক হওয়ার জন্য ব্যাচেলর ইন টিচিং ডিগ্রি বাধ্যতামূলক। তিনি যে র্পযায়রে, যে বিষয়ে শিক্ষকই হতে চান না কনে, তাঁর নিজস্ব বিষয়ে ডিগ্রির পাশাপাশি ব্যাচেলর ইন টিচিং ডিগ্রি থাকতেই হবে। অথচ আমাদের দেশের শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়নের সুযোগ তেমন নেই বললেই চলে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য সারাদেশে মাত্র ৬৭টি পিটিআই রয়েছে। এই পিটিআই শিক্ষক সংকট চরমে রয়েছে। গত ২০১৯ সালের পর থেকে পিটিআইগুলোতে নতুন করে কোনো প্রশিক্ষক নিয়োগই হচ্ছে না মামলা জটিলতায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের চারটি প্রতিষ্ঠানে রয়েছে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট। সেই ইনস্টিটিউটগুলোর মান ও স্বকীয়তা আরও বৃদ্ধি প্রয়োজন। ইনস্টিটিউটের শিক্ষকদের জাতীয় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নসহ নানান নীতিমালা তৈরিতে যথাযথ ব্যবহারে রাষ্ট্র উদাসীনতা পরিলক্ষিত হয়েছে। শিক্ষকতা আকর্ষণীয় পেশা নয়: বর্তমানে এখনো শিক্ষকতা বাংলাদেশে আকর্ষণীয় পেশা নয়। শিক্ষার্থীরা নিরুপায় হয়ে শিক্ষকতায় আসে। সবাই বিসিএস এডমিন বা পুলিশ ক্যাডার হতে চায়। ছোটবেলায় সবাই শিক্ষক হতে চাইলেও জীবনের বাস্তবতায় ভুলে যায়। স্বেচ্ছায় ও লক্ষ্য সামনে রেখে শিক্ষার্থীদের আসার সুযোগ নেই।

শিক্ষকদের পর্যাপ্ত স্বীকৃতি নেই: সরকারিভাবে শিক্ষকদের কাজের যে স্বীকৃতি তা পর্যাপ্ত নয়। দেশের একটি জাতীয় দৈনিক সেরা শিক্ষক সম্মাননা চালু করেছে। আলোকিত টিচার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠান শিক্ষকদের আইডিয়া চ্যালেঞ্জ নামে প্রতি বছর স্বীকৃতি দেওয়ার চেষ্টা করে। তবে এই ধরনের বেসরকারি উদ্যোগ আরও বাড়াতে হবে।

এই দিবস উপলক্ষে শিক্ষকদের জন্য কিছু দাবিও তুলে ধরা হলো। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপযুক্ত সংখ্যক যোগ্য ও প্রশিক্ষিত শিক্ষক থাকা উচিত। যারা সত্যিকারের শিক্ষ হতে চায় তাদের সুযোগ দেওয়া। কোনো উপায় না পেয়ে আমাদের দেশের চাকরিপ্রার্থীরা এই পেশায় আসে। ফলে কাঙ্ক্ষিত ফল লাভে ব্যর্থ হয় শিক্ষার্থীরা। শিক্ষকদের পেশা দক্ষতা বাড়ানোর জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ দিতে হবে। সমাজে নেতৃত্বদানেও শিক্ষকদের সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। মন্ত্রণালয়ে দুইজন মন্ত্রীই অশিক্ষক! সাধারণত এই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীদ্বয় শিক্ষক হলে দেশ আরও বেশি উপকৃত হতো বলে দৃঢ় বিশ্বাস। সমাজের প্রতিটি স্তরে শিক্ষকদের নেতৃত্বদানের সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। সামাজিক এবং নীতি সংলাপে অংশগ্রহণ করার সুযোগ দিতে হবে। সমাজের সৃষ্ট সমস্যা সমাধানেও শিক্ষকদের সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। শিক্ষকদের জন্য আলাদা বৃত্তি ও কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ দেশ বিদেশে ভ্রমণ ও প্রশিক্ষণের সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। বাংলাদেশে হাতেগোনা যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান শিক্ষকদের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে তাদের মধ্যে আলোকিত টিচার্স নামে একটি অত্যাধুনিক প্ল্যাটফর্ম রয়েছে। ২১ শতকের আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষক গঠনে প্রতিষ্ঠানটি নিরন্তর সংগ্রাম করেই যাচ্ছে। এ পর্যন্ত প্রায় আঠারো হাজার সরকারি-বেসরকারি শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির রয়েছে প্রায় ২২টি কোর্স যা সামাজিক, দক্ষ ও আধুনিক শিক্ষক তৈরিতে ভূমিকা রাখছে।

পরিশেষে নোবেল জয়ী মালালা ইউসুফ জাইয়ের চমৎকার উক্তি দিয়ে শেষ করছি। মালালা ইউসুফ জাই বলেছিলেন, একটি বই, একটি কলম, একটি শিশু এবং একজন শিক্ষক বিশ্বকে পরিবর্তন করতে পারে। সত্যিই তো তাই একজন শিক্ষক চাইলেই গোটা বিশ্বকে পরিবর্তন করে দিতে পারেন। তবে বিশ্ব পরিবর্তন করতে চাইলে শিক্ষক নিজেই পরিবর্তিত হতে হবে যুগ, সময় এবং বিশ্বের একধাপ আগেই। তবে সুন্দর, স্বনির্ভর ও আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণ করা যাবে।

লেখক: জনসংযোগ কর্মকর্তা, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ (আইইবি), সাবেক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মকর্তা, আলোকিত টিচার্স

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :