মায়া

গৌতম বিশ্বাস
 | প্রকাশিত : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৪:০১

হরিমতী যখন গোরু জোড়া বেচে দেওয়ার কথা বলেছিল তখন একপ্রকার যেন আঁতকে উঠেছিল ক্ষীরোদ।বলেছিল," কও কী? এ্যাদ্দিন যাগের পাল্যে পুষ্যে বড়ো করছি তাগের আমি বেচ্যে দেবো?"

উঠোন ঝাটাতে ঝাটাতে হরিমতী ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তাকিয়েছিল ক্ষীরোদের দিকে।বলেছিল," বেচপা না তো কী করবা?আর কী ওরা তুমারে কইরে খাওয়াতি পারবে?"

"এ তুমি ক্যামুন কথা কও গোপালের মা? কইরে খাওয়াতি পারবে না বল্যে বেচ্যে দেবো?এ্যাদ্দিন যে গায় গতরে খেট্যে আমাগের খাওয়ালো তার বুঝি কুনো দাম নাই?"

বলতে বলতে ঘাড়টাকে ঈষৎ তুলে আকাশের দিকে তাকিয়েছিল ক্ষীরোদ।আসন্ন সন্ধ্যার ইশারা নিয়ে চেয়ে থাকা আকাশ তখন নিজের গা থেকে মুছে নিচ্ছে দিনান্তের রোদ।আর সেইসঙ্গে একটা অস্পষ্টতাও ছড়িয়ে দিচ্ছে পৃথিবীর ওপর।কীসের এক ইশারা পেয়ে আশেপাশে ডাকতে শুরু করে দিয়েছে একটা দু'টো ঝিঁঝিঁপোকা।

অর্ধেক উঠোন ঝাটানো শেষ করে কোমরটাকে খানিক সোজা করে উঠে দাঁড়িয়েছিল হরিমতী," তুমারও তো বয়াস হইচে।তুমিই বা আর ওগের বসায়ে খাওয়াতি পারবা কদ্দিন?তাছাড়া দু'ডো গোরু বসায়ে খাওয়ানির সামত্থও কী আমাগের আছে?"

এমন যুক্তির কাছে বলার আর কিছু খুঁজে পায়নি ক্ষীরোদ।তবে সে রাতে ভেবেছিল অনেক।ওরা তো আর কেবল গোরু নয়,ক্ষীরোদের সন্তান।হ্যাঁ,গোপালের মতই আদর যত্ন দিয়ে বড়ো করেছে ওদের।মুখে তুলে খাইয়ে দিয়েছে।গায়ে,পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করেছে।একসঙ্গে খেত খোলায় কাদা,মাটি মেখেছে।কত কথাই না মনে পড়েছে ক্ষীরোদের।সেই যেদিন মেদের হাট থেকে ওদের কিনে এনেছিল তখন তো ওরা এই এ্যাত্তোটুকু।সবে দু'টো করে দাঁত গজিয়েছে দু'জনের।হালের জোয়াল কাঁধ ছোঁয়নি।ক্ষীরোদই নিজের হাতে হাল চালানো শিখিয়েছে ওদের।তারপর একটু গা সওয়া আর বুঝমান হলে নামিয়ে দিয়েছে চাষে।

হ্যাঁ,ওদের নিয়ে কতজনার জমিতে লাঙল বেচতে গেছে সে।সেই লাঙল বেচা টাকায় নিচিন্দিপুরের হাট থেকে কিনে এনেছে চাল,ডাল,তেল,নুন,আটা।আবার ওদেরই গায় খাটা টাকায় সবার গায়ে জামা কাপড় উঠেছে।গোপালের বইখাতা এসেছে।ক্ষীরোদ আর কতটুকু করেছে।ওরাই তো কাঁধে তুলে টেনে নিয়ে এসেছে সংসারটা।আজ সেই ওদেরই কিনা -

অনেক কিছুই ভাবতে হয়েছিল ক্ষীরোদের।তবে ভেবেটেবে শেষমেষ নিয়েই নিয়েছিল সিদ্ধান্তটা।না নিয়ে তো উপায়ও ছিল না।যা দিনকাল পড়েছে তাতে আজ আর গোরুর লাঙলে কেউ জমি চাষ দিতে চায় না।সবাই চায় ট্রাক্টর নয় তো পাওয়ারটিলার দিয়ে জমি চাষ দিতে। একদিন যারা একখানা লাঙলের জন্যে ক্ষীরোদের বাড়িতে গিয়ে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকতো আজকাল তারা তার দিকে তাকায় না পর্যন্ত। বরং ক্ষীরোদই তাদের অপেক্ষায় বসে থাকে।কিন্তু এভাবে আর কতদিন?

অগত্যা আজ এই গো হাটায় নিয়ে আসা ওদের।একদিন এই হাট থেকেই ওদের কিনে নিয়ে গিয়েছিল। সেদিন ওরা ছিল এই এ্যাত্তোটুকু।আর ক্ষীরোদের চোখ জুড়েও ছিল রাজ্যের স্বপ্ন।সংসারটাকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছিলো ওদের কাঁধে ভর দিয়েই।আর তা করেও ছিল অনেকখানি। এতদিন দু'মুঠো খেয়ে পরে বেঁচে থাকা তো সেই ওদের জন্যেই।

গো হাটার বড়ো শিরীষ চটকা গাছের নিচে বাঁশের খুঁটিতে ওদের বেঁধে রেখে আনমনে কী সব ভাবতে ভাবতে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল ক্ষীরোদ।সারা হাট জুড়ে এত হৈ চৈ,কোলাহল, গোরু-ছাগলের ডাকাডাকি - কিছুই বোধকরি কানে যাচ্ছিলো না তার।কেবল যখন এক ঢেলা কষ্ট বুকের ভেতর থেকে মাঝে মাঝে ঠেলা মারছিলো তখন ভেতরে আটকে থাকা দীর্ঘশ্বাসটা বেরিয়ে আসছিলো বুক ফুঁড়ে।

আচমকাই অচেনা কন্ঠস্বরে ঘোর টা কেটে গিয়েছিল ক্ষীরোদের।চমকে তাকিয়ে দেখেছিল সামনেই দু'জন মাঝ বয়সী মানুষ।এই মেদের হাটেই বার কয়েক ছাগল,হাঁস-মুরগি বেচতে এসে দেখেছে ক্ষীরোদ। কথাও হয়তো হয়েছে বার কয়।তবে ঠিক মনে পড়ে না।

ঈষৎ অবাক হয়েই একটু বেশি বয়সের মানুষটার দিকে তাকিয়ে সে জিজ্ঞেস করেছিল," কিছু কও নেকি?"

মানুষটা বলেছিল," হঃ,কই তো।তা তুমিই তো দেহি সাড়া দেও না।"

একটু বুঝি লজ্জা ই পেয়েছিল ক্ষীরোদ।বলেছিল," না,মানে - "

" বুঝি,বুঝি।পালা জিনিস বেচতি এলি সবারই এমন হয়।তা তোমাগের বাড়ি কোথা?"

দু'দুটো গোরু একা সামাল দেওয়া সম্ভব নয় বলে ছেলেকে সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছিল ক্ষীরোদ।তা সে উত্তর দেওয়ার আগেই গোপাল বলেছিল," ইজ্ঞে লক্ষ্মীপুর।তা তুমরা তো উদিকপানে যাও দেহি।"

মানুষটা আসলে ব্যাপারি।সঙ্গের জন তার সাগরেদ।ব্যাপারি মানুষটা কোমরের লুঙ্গিতে গুঁজে রাখা বিড়ির প্যাকেটটা বের করে নিজে একটা নিয়েছিল।সঙ্গের লোকটাকে একটা দিয়ে গোপালের দিকে প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিল," নেবা নেকি?"

বিড়ি গোপাল ভালোই খায়।তবে বাপের সামনে নয় মোটেই।তাই সে বলেছিল," না,না,ওসপ আমি খাই নে।"

ব্যাপারি এবার ক্ষীরোদকে বলেছিল," তুমি এট্টা নেও।"

মাথা নেড়েছিল ক্ষীরোদ।অন্য সময় হলে হয়তো নিত।কিন্তু তখন আর ইচ্ছে করছিলো না মোটেই।বুকের ভেতরে জমাট বেঁধে ওঠা কষ্টটা রক্তাক্ত করতে শুরু করে দিয়েছিল ততক্ষণে।

বিড়িতে আগুন ধরিয়ে আয়েশ করে বড়োসড়ো এক টান দিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে ফের জিজ্ঞেস করেছিল," বাড়ি য্যান কোন গাঁয়ে ক'লে?"

গোপাল বলেছিল," লক্ষ্মীপুর।"

" ও,হঃ,লক্ষ্মীপুর।আমরা তো সে গাঁয়ে কতই যাই গোরু-ছাগল কিনতি। হয়তো কত তোমাগের বাড়িও গিছি।"

" তা হতি পারে।"

" হতি পারে কি,নিঘ্ঘাত গিছি।"

বলতে বলতে একবার ঘাড় কাত করে আকাশের দিকে তাকিয়েছিল মানুষটা।না,ওখান থেকে ঠিক আকাশ দেখা যায় না।শিরীষ চটকার ডালপাতার আড়ালে ঢাকা পড়ে থাকা আকাশের সামান্যই ছেঁড়া ফাটা ছবি দেখা যায়।ক্ষণিক সেদিকে তাকিয়ে থেকে ফের চোখ নামিয়ে মানুষটা ক্ষীরোদকে জিজ্ঞেস করেছিল, " তা গোরু দু'ডো বেচতি চাও ক্যান?গায় গতরে অহনও তো যা আছে তাতে ভালো মতই চাষ বাস - "

আচমকাই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এসেছিল ক্ষীরোদের বুক চিরে," আর চাষ বাস।অহন আর কেউ গোরু দে চাষ করে না। সব্বাই টেক্টর দে চাষ দিতি চায়।অহন গোরু পোষা মানে বসায়ে বসায়ে খাওয়ানি।তা আমি কি আর ত্যামুন বড়োনোক বাবু যে ওগের বসায়ে বসায়ে খাওয়াবো।খড় বিচেলির যা দাম।তার ওপর নিজির আবার ত্যামুন জমি জিরেতও নাই যে সেখেনে - "

" বুঝছি খুড়ো।মানুষগুলোনের এই এক সমস্যা।ভালো জিনিসির দাম দিতি জানে না।সব্বাই খালি নতুন জিনিসির পেছু ছোটে।টেক্টার আর গোরুর লাঙল কী এক জিনিস?"

" তাই তো।"

" তাহলি বেচ্যেই দিবা এগের?"

" না দে উপায় কী?"

" তা দাম ক্যামুন চাচ্ছো?"

চোখ ঘুরিয়ে গোপালের দিকে তাকিয়েছিল ক্ষীরোদ।গোরু-ছাগলের দরদাম করা কোনওদিনই সে ঠিকঠাক পারে না।যখন একা ছিল বাধ্য হয়ে নিজেরই করতে হত। গোপাল বড়ো হওয়ার পর থেকে সংসারের যা কিছু বেচাকেনা - দরদাম গোপালই করে।

তা বাপের চোখের ইশারা টের পেয়ে গোপাল বলেছিল," চল্লিশ দিও।"

জোড়া চোখ কপালে তুলে ব্যাপারি বলেছিল," কও কী?চল্লিশ?এ গোরুর এত দাম হয় নেকি?"

একবার বাপের দিকে তাকিয়েছিলো গোপাল।পরক্ষণেই ব্যাপারির দিকে তাকিয়ে বলেছিল," তাহলি তুমিই কও কত দিবা।"

একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে কি সব হিসাব করে নিয়ে ব্যাপারি বলেছিল," পঁচিশ আর দুই - ওই সাতাশ নিও।"

মাথা নেড়েছিল গোপাল," না গো,এ দামে আমরা - "

" তাহলি?"

তারপর কথার পর কথা।দামের পর দাম।শেষে সাড়ে চৌত্রিশ হাজারে ঠিক হয়েছিল।আর পাঁচশো টাকা চেয়ে অনেক গাইগুই করেছিল গোপাল।ক্ষীরোদও বলেছিল," ওই পঁয়ত্রিশ পুরোয়ে দেও।"

মাথা ঝাঁকিয়ে ব্যাপারি বলেছিল," না গো,আর যদি এট্টা ট্যাকাও দাবি করো তো দিতি পরবো না।বরং যা দাম দিলাম তাতে না আমাগের লস হইয়ে যায়।"

গোপাল হাতে করে টাকা টা গুনে নিতে খুঁটো থেকে গোরুর দড়ি খুলে ব্যাপারির দিকে এগিয়ে দিতে দিতে ক্ষীরোদ বলেছিল," বড়ো আদরের জিনিস ওরা।এট্টু ভালো মানষের কাছে এগের - "

আর বলতে পারেনি ক্ষীরোদ।একরাশ কান্না আছাড় খেয়ে পড়েছিল তার দুই চোখে।বুকের ভেতর থেকে ঠেলে ওঠা একটা কষ্ট অস্থির করে দিয়েছিল হঠাৎ।

সে অবশ্য বেশ খানিকক্ষণ আগের কথা।সেই অস্থিরতা এখন আর অতটা নেই।তবে কষ্ট টা দ্বিগুন হয়ে চেপে বসেছে ক্ষীরোদের বুকে।বার বার কেবল মনে পড়ছে ওদের মুখ গুলো।চোখের সামনে ভেসে উঠছে ওদের সঙ্গে কাটানো কত টুকরো অতীত।ভেসে উঠছে ওদের নিস্পাপ দুটি চোখ।

এখন দুপুর।চৈত্রের দুপুর মানে গনগনে রোদে ভাজা হতে হতে নিজেই উনুন হয়ে যাওয়া আকাশ।এমন খোলা আকাশের নিচে এমন ভরদুপুরে পথ চলা বড়োই কষ্টের। বাগমারা গাঁয়ের শেষ মাথায় রাস্তাটা আধখানা চাঁদের বাঁক।বাঁকের মুখে বড়ো শিরীষ গাছটার নিচে খানিক ছায়া দেখে একটু জিরিয়ে নেওয়ার জন্যে বসেছিল ক্ষীরোদ।কতক্ষণ হয়ে গেল বসেই আছে।গোপাল বেশ ক'বার বলেছে," ইবার চলো,আর কতক্ষণ বস্যে থাকপা?"বাড়ি তো যাতি হবে।আর এতই যদি খারাপ লাগে তুমার,তাহলি বেচল্যে ক্যান?"

ক্ষীরোদ কোনও উত্তর দেয়নি।ঘাড় ঘুরিয়ে একবার গোপাল কে দেখেছে কেবল।তারপর ফের তাকিয়েছে দূরের আকাশটার দিকে।

কতক্ষণ হয়ে গেল এমনি করে আকাশের দিকে চেয়ে বসে আছে।বাড়ি ফেরার কোনও ইচ্ছেই যেন তার নেই।যা দেখে একটু যেন বিরক্তই হল গোপাল।সে জিজ্ঞেস করলো," কী হল,বাড়ি যাবা না?"

এতক্ষণে উত্তর দিল ক্ষীরোদ," হঃ,যাতি তো হবে।"

" তাহলি বস্যে আছো ক্যান?ওঠো।"

" শরীল যে আর চলে না রে বাপ।যাগের এত ভালোবাসতাম তাগেরই কিনা কয়ডা ট্যাকার জন্যি - "

" যা হবার তা তো হইয়েই গেছে।আর তো ওগের ফিইরে পাবা না।অহন - "

কথাটা শেষ হল না গোপালের।আচমকা দূরের রাস্তায় একটা হৈ চৈ শুনে ঘাড় ঘোরালো গোপাল।ঘুরে তাকালো ক্ষীরোদও।আর তখনই চোখে পড়লো দৃশ্যটা।যে রাস্তা ধরে হাট থেকে ফিরছিলো তারা সেই রাস্তা দিয়ে ছুটে আসছে দু'টো গোরু।তার পেছনে দু'জন মানুষ।দূর থেকেও গোরু দু'টোকে বেশ চিনতে পারলো ক্ষীরোদ।এদেরই তো খানিক আগে বেচে দিয়ে এলো সে।

শরীরটাকে সোজা করে উঠে পড়লো ক্ষীরোদ।গিয়ে দাঁড়ালো রাস্তার মাঝখানে।গোরু দু'টো ততক্ষণে ক্ষীরোদের একেবারে গা ঘেঁষে এসে দাঁড়িয়ে গেছে।আর মাথা ঘষতে শুরু করেছে তার গায়ে,পায়ে।নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলো না ক্ষীরোদ।ওদের গলা জড়িয়ে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললো সে।

হাঁপাতে হাঁপাতে এসে গোরুর দড়ি ধরে ফেললো ব্যাপারি।গোপাল বলল,' না ব্যাপারি, তুমার ট্যাকা তুমি নে যাও।এ গোরু আমরা বেচপো না।"

অবাক হয়ে গোপালের দিকে তাকালো ব্যাপারি," ক্যান?"

গোপাল বলল," দেহেও কী বুঝতি পারছো না?"

আর কথা বাড়ালো না ব্যাপারি।টাকাগুলো গুনে নিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলে গেল।

কান্নাটা তখনও থামেনি ক্ষীরোদের।যা দেখে চোখে জল চলে এলো গোপালেরও।গোরু দু'টোর দিকে তাকিয়ে তার মনে হল গোরু নয়,বাপ তাকেই আদর করছে।।

( সমাপ্ত)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :