ভূমিকম্প: দক্ষিণ এশিয়ার ঝুঁকি কতটা?

সাইখ আল তমাল, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ২২ মার্চ ২০২৩, ২৩:৩২

চলতি বছরের শুরুতেই দশকের সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প দেখেছে তুরস্ক-সিরিয়া। সরকারি হিসেব মতে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার এই ভূমিকম্পে দেশ দুটিতে প্রাণ হারিয়েছে ৫৭ হাজারের বেশি মানুষ। হাজার হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর আগে জাপানে ২০১১ সালের ৯ দশমিক ১ ভূমিকম্পে প্রাণ হারিয়েছে প্রায় ২০ হাজার। সম্প্রতি মার্চ মাসেই প্রতিবেশি ভারতে ৬ বার ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটেছে। গত মাসে বাংলাদেশের কক্সবাজারে ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। নেপাল, আফগানিস্তান, পাকিস্তানে কিছুদিন পরপর ভূমিকম্প দেখা দেয়। প্রশ্ন আসতে পারে, দক্ষিণ এশিয়ায় ভূমিকম্পের ঝুঁকি কতটা?

চলতি মাসের ২ তারিখ থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত ১৯ দিনে ৬ বার ভূমিকম্পের ঝাঁকুনিতে কেঁপে উঠেছে দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশ। এছাড়া ফেব্রুয়ারি মাসেও চারটি ভূমিকম্প আঘাত হানে এই অঞ্চলে। ঘনঘন কাঁপুনিতে ভারত, বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলে তৈরি হয়েছে ব্যাপক উদ্বেগ। ২১ মার্চ আঘাত হানা ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ভারত সংলগ্ন আফগানিস্তানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বাদাখশান প্রদেশের হিন্দুকুশ পর্বত। মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) বলছে, এই ভূমিকম্প ভূপৃষ্ঠের ১৮৭ কিলোমিটার গভীরে ছিল। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৬ দশমিক ৮।

তবে ভূমিকম্পটির উৎস আফগানিস্তান হলেও ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি ও কাশ্মীর, পাকিস্তানের ইসলামাদ, পেশোয়ার ও লাহোরসহ অনেক জায়গায় কম্পন টের পাওয়া গেছে। সবশেষ খবর পর্যন্ত ভূমিকম্পে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে প্রাণ হারিয়েছে ১৩ জন এবং আহত হয়েছে শতাধিক।

হিন্দুস্থান টাইসম জানিয়েছে, চলতি মাসের শুরুতেই একটি ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটে। ২ মার্চ ৪ মাত্রার ভূমিকম্পটির উৎস ছিল ভারত সংলগ্ন নেপালের পূর্বাঞ্চলে। যার গভীরতা ছিল ১০ কিলোমিটার। তার পরের দিনই ৪ দশমিক ১ মাত্রার আরেকটি ভূমিকম্প আঘাত হানে। এর উপকেন্দ্র ছিল ভারতের অরুণাচল প্রদেশ। ৭ মার্চ, তিনদিনের দিনের মাথায় ফের ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে ভারতের আন্দামান ও নিকোবার দীপ অঞ্চল। যার মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৯।

এখানেই শেষ নয়। ৮ মার্চ ৪ মাত্রার এবং ১২ মার্চ ৪ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠে যথাক্রমে পাকিস্তানে গিলগিট-বালিস্তান এবং মণিপুরের ওয়ানজিং অঞ্চল। ফেব্রুয়ারি মাসেও একাধিক ভূমিকম্প আঘাত হানে এই অঞ্চলে। ফেব্রুয়ারির ১২, ১৬, ২২ ও ২৪ তারিখে ৪ থেকে ৫ মাত্রার আরও চারটি ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটে। যেগুলোর উৎস ছিল ভারতের সিকিম, নেপালের পশ্চিমাঞ্চল, পাকিস্তানের ইসলামবাদ ও বাংলাদেশের ছাতক ও সিলেট। ঘটানাগুলো দক্ষিণ এশিয়ায় ভূমিকম্পের উদ্বেগ ক্রমশ বাড়িয়ে তুলছে।

সিঙ্গাপুরের আর্থ অবজারভেটরির মতে, অতীতে ভূমিকম্পের সম্মুখীন হওয়া প্রতিটি ত্রুটির জন্য ভবিষ্যতে ভূমিকম্প ঘটাতে পারে। এক্ষেত্রে প্লেটের সীমানা অবশ্যই ভূমিকম্প দ্বারা আঘাত করার সবচেয়ে সম্ভাবনাময় স্থান, তবে টেকটোনিক প্লেটের মধ্যেও ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটতে পারে।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, ইন্দো-অস্ট্রেলিয়ান এবং ইউরেশিয়ান প্লেটের (অর্থাৎ সুন্দা মেগাথ্রাস্ট) মধ্যবর্তী প্লেট সীমানা ভূমিকম্প (এবং সুনামি) দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি। বিজ্ঞানীরা সুন্দা মেগাথ্রাস্টের বিভাজন এবং এই সাবডাকশন জোনে ভূমিকম্পের প্রত্যাবর্তনের সময়গুলি অধ্যয়ন করেন যাতে তাদের প্রভাব যতটা সম্ভব প্রশমিত হয়।

আইএফআরসির মতে দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বের অন্যতম ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল। দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে ছয়টি- আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, ভুটান এবং বাংলাদেশ; সর্বাধিক ভূমিকম্পের দিক থেকে সক্রিয় হিমালয়ের মধ্যে অবস্থিত। এখানকার হিন্দুকুশ বেল্ট যা ইতিহাসে রেকর্ড করা সবচেয়ে খারাপ ভূমিকম্প দেখেছে।

২০১৫ সালে নেপালে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর বিশ্ব্যাংক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়, দুর্ভাগ্যবশত এটা শুধু নেপালের চ্যালেঞ্জ নয়। আফগানিস্তান থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত, দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ অংশ বিশ্বের সর্বোচ্চ ভূমিকম্পের দিক থেকে সক্রিয় অঞ্চলে অবস্থিত। আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত, নেপাল এবং ভুটানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হিমালয় বেল্ট জুড়ে ৬০ কোটির বেশি লোক ফল্ট-লাইন বরাবর বাস করে।

তিনটি টেকটোনিক প্লেটের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় ভূমিকম্পের হুমকি তৈরি হয়। ভারতীয় প্লেটটি বছরে প্রায় পাঁচ সেন্টিমিটার গতিতে উত্তর দিকে যাচ্ছে। এটি করতে গিয়ে এটি ইউরেশিয়ান প্লেটের সঙ্গে ধাক্কা খায়। এই সংঘর্ষের কারণে, হিমালয় পর্বতগুলি ওপরের দিকে যেতে বাধ্য হয় এবং প্রচুর পরিমাণে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়। এই প্রক্রিয়া লক্ষ লক্ষ বছর ধরে হয়ে আসছে।

গত ১০০ বছরে এই অঞ্চলে কিছু বড় ভূমিকম্প দেখা গেছে। এর মধ্যে ১৯৩৪ সালে বিহার-নেপাল, ১৯৪৫ মাকরান, ১৯৫০ সালে আসাম, ১৯৯৩ সালে লাতুর, ২০০১ সালে গুজরাট, ২০০২ সালে আফগানিস্তান, ২০০৫ সালে পাকিস্তান, ২০১৫ সালে নেপাল এবং সবশেষ ২০২২ সালে আফগানিস্তান যাতে ১ হাজারের অধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।

দক্ষিণ এশিয়ায় লক্ষ লক্ষ বছর ধরে ভূমিকম্প হতে পারে। কিন্তু আজ পার্থক্য হল যে ভূমিকম্প অঞ্চলে আরও বেশি সংখ্যক মানুষ বাস করছে। মানুষজন প্রায়শই দ্রুত বর্ধনশীল শহরগুলিতে ভিড় জমায়। উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ সিসমিক জোনে এই ক্রমবর্ধমান নগরায়নের বেশিরভাগই মেগা-সিটিগুলি থেকে শুরু করে মাধ্যমিক এবং তৃতীয় শহরগুলোর সবই অন্তর্ভুক্ত৷

পরবর্তী ভূমিকম্প কখন বা কোথায় হবে তা কেউ বলতে পারে না। কিন্তু আমরা যা জানি তা হল পরবর্তী প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে তাদের নাগরিকদের রক্ষা করার জন্য দেশগুলি অনেকগুলি ব্যবস্থা নিতে পারে৷ পরবর্তী বড় ভূমিকম্পকে ২১ শতকের দক্ষিণ এশিয়ার মেগা-বিপর্যয়ে পরিণত করার কোনো প্রয়োজন নেই।

সে ক্ষেত্রে দেশগুলো যেসব পদক্ষেপ নিতে পারে তার মধ্যে রয়েছে স্থিতিস্থাপক আবাসন নির্মাণ, বিল্ডিং কোড উন্নত করা এবং স্কুল, হাসপাতাল, সেতু, বাঁধ, প্রধান সড়ক অবকাঠামো, পাবলিক ভবন ইত্যাদির মতো গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো শক্তিশালী করা। দুর্যোগ প্রতিক্রিয়া প্রক্রিয়া শক্তিশালী করা এবং প্রথম প্রতিক্রিয়াকারীদের আরও ভাল অনুসন্ধান এবং উদ্ধার সরঞ্জাম এবং প্রশিক্ষণ প্রদান করা গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে রয়েছে অরক্ষিত ব্যক্তিদের খাদ্য হস্তান্তর করার জন্য এবং দুর্যোগের পরে অনিবার্যভাবে ছড়িয়ে পড়া রোগগুলি বন্ধ করার জন্য টিকা প্রদানের জন্য আন্তঃপরিকল্পনা এবং সিস্টেম স্থাপন করা।

প্রাথমিকভাবে মনে হতে পারে এসব ক্ষেত্রে মনে হয় অনেক টাকা খরচ হবে। কিন্তু এগুলোর উন্নয়ন না করলে আরও বেশি খরচ হতে পারে। এই খরচ জীবনের মর্মান্তিক ক্ষতির বাইরে চলে যায়। দুর্যোগের স্থিতিস্থাপকতায় বিনিয়োগ করার এখনই সময়। পরিবহন, জ্বালানি, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গ, আবাসন এবং জীবিকাসহ সমস্ত সেক্টরে এটি করা উচিত। দক্ষিণ এশিয়াকে এখনই পরবর্তী দুর্যোগের জন্য প্রস্তুত হতে হবে।

(ঢাকাটাইমস/২২মার্চ/এসএটি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

আন্তর্জাতিক বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

আন্তর্জাতিক এর সর্বশেষ

গাজায় আরও ৭১ ফিলিস্তিনির প্রাণহানি 

ফেসবুকে রোহিঙ্গাবিদ্বেষ ছড়ানোর নেপথ্যে ছিল মিয়ানমারের জান্তা: জাতিসংঘ

রাফাহতে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী: নেতানিয়াহু

নির্বাচন করার জন্য অর্থ নেই, সরে দাড়ালেন ভারতীয় অর্থমন্ত্রী

সিরিয়ার আলেপ্পোতে ইসরায়েলি হামলায় নিহত ৩৮

দ. আফ্রিকায় বাস খাদে পড়ে নিহত ৪৫, অলৌকিকভাবে বেঁচে গেল শিশু

দুই নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিকে গুলি করে হত্যার পর বালিচাপা দিলো ইসরায়েলি সেনারা 

গাজায় যুদ্ধাপরাধে জড়িতদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতে আইসিসির প্রতি আহ্বান

কলকাতা বিমানবন্দরে চলল গুলি, নিরাপত্তা কর্মীর মৃত্যু

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার আহ্বান জানিয়ে হুমকি পেলেন জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :