চরে ঘুরল অর্থনীতির চাকা

শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার অন্তর্গত নওপাড়া- চরআত্রা দুটি ইউনিয়ন ও সখিপুরের কাঁচিকাটা একটি ইউনিয়ন এবং জাজিরার কুন্ডেরচর একটি ইউনিয়নসহ চারটি ইউনিয়নের মানুষের বসবাস এই চরেই। নদী ভাঙার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিলো হাজার হাজার পরিবার। তবুও নদী ভাঙন যেন থামছিলই না।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শরীয়তপুর-২ আসনে একেএম এনামুল হক শামীম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং পানি সম্পদ উপমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। তার অক্লান্ত প্রচেষ্টায় সর্বপ্রথম নদী ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পায় নড়িয়া, সখিপুর, জাজিরা, চাঁদপুরের নদীর তীরবর্তী লাখ লাখ পরিবার।
নদীর তলদেশ দিয়ে (সাবমেরিন) কেবলে আসা বিদ্যুতে শরীয়তপুরের চরে কাচিকাটা, চরআত্রা ও নওপাড়া হঠাৎ করে বদলে গেছে। কৃষি, ব্যবসা বাণিজ্য আর কলকারখানায় এসেছে নতুন গতি।
শরীয়তপুরের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন পদ্মা-মেঘনাবেষ্টিত ছোট-বড় অসংখ্য চর। এসব চরে যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম নৌপথ। ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন এসব চরে এখন পৌঁছাতে শুরু করেছে বিদ্যুতের আলো।
মুন্সীগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালের ২২ এপ্রিল পদ্মার তলদেশ দিয়ে ১ কিলোমিটার পার হয়ে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যেমে তিনটি চরে বিদ্যুতায়নের কাজ শুরু হয়। নির্মাণ করা হয় ১০ এমভিএ ক্ষমতাসম্পন্ন উপকেন্দ্র। বিদ্যুতের খুঁটি ও সঞ্চালন লাইনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এবার নদীর উপর দিয়ে রিভার ক্রসিং টাওয়ার দিয়েও বিদ্যুৎ দেওয়া হয়েছে। যাতে করে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সেবা পান এই অঞ্চলের মানুষ।
দেওয়ান কান্দি গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, মাফিয়া বেগম রান্নার কাজ করছেন। থাকার ঘরটি বেশ ছোট। কাঁচামাটির ওপর নড়বড়ে টিনের ঘর। সেই ঘরে দেওয়া হয়েছে বিদ্যুতের সংযোগ।
রান্নাঘরে বসেই কথা হয় মাফিয়া বেগমের সঙ্গে। কথায় কথায় তিনি হিসাব দিতে থাকেন, কীভাবে খরচ বাঁচল তার।
তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘কিরিসত্যাল আংগাইলে কেরোসিন তেল দিয়ে বাতি জ্বাললে আগে একশো দ্যাশশো টাহা লাগদো। আর অহনে যেমন পঞ্চাশ শাইট টাহাই অইয়া যায়।’
তিনটি চরে ছোট-বড় মিলে রয়েছে ১০টি হাট-বাজার। বিদ্যুৎ পাওয়ায় বাজারগুলোও এখন বেশ জমজমাট। বেড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিধিও।
নওপাড়া বাজারের ব্যবসায়ী মজিবর খা ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমাগো বাজারে অন্তত ২০০ ব্যবসায়ী আছে। সবাই বিদ্যুৎ পাইছে। আগে সোলার জ্বালাইতাম। ঘরের মধ্যেই আলো ছিল। সন্ধ্যা হইলে মানুষ বেশিক্ষণ বাজারে থাকত না। এহন অনেক রাইত পর্যন্ত মানুষ বাজারে থাকে। আগে এই বাজারে ফ্রিজ ছিল না। এহন অনেক ব্যবসায়ী ফ্রিজ কেনছে। ফটোকপি মেশিন কম্পিউটারের দোহানও হইছে। সব দিক দিয়াই কেনা বেচা বাড়ছে। বিদ্যুৎ পাইয়া চরের ব্যবসায়ীরা লাভবান।’
নদী আর না ভাঙার কারণে এই চরের মানুষ এবার স্বপ্ন দেখে নতুন এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের। আধার পেরিয়ে আলো ফিরে পান তারা। নদীর তীরেই গড়ে উঠে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হওয়ায় স্বচ্ছলতা ফিরে তাদের সংসারে।
নদীর পার যেন এখন পর্যটক কেন্দ্রে রুপ নিয়েছে। দুপুর গড়িয়ে বিকাল হলেই দেখা যায় ভ্রমণপিপাসু হাজারো পর্যটকদের আনাগোনা। নদীর পাড়েই গড়ে উঠেছে বিভিন্ন খাবারের দোকান, বেকারি, রেস্টুরেন্ট। একদিকে নদীর পাড়ে দোকান চালিয়ে আয় উপার্জন ক্ষমতা যেভাবে বেড়েছে ঠিক তেমনি এদেশের মানুষের কর্মসংস্থানের ও ব্যবস্থা হয়েছে। অর্থনীতির চাকা ঘুরেছে এই চরে।
চরে আধুনিক সড়ক ব্যবস্থা হওয়ায় সহজেই অটোরিকশা, ইজিবাইক, মোটরসাইকেল দিয়ে যাতায়াত করতে পারায় সহজ হয়েছে যাতায়াত ব্যবস্থা।
মালামাল আনা নেওয়া করতে পাওয়া ট্রলি, ইঞ্জিন চালিত ভ্যান। এতে করে কর্মসংস্থান বেড়েছে এই চরে ঘুরেছে অর্থনীতির চাকা।
নদীবেষ্টিত হওয়ায় চরে কৃষি ও মাছ চাষের সম্ভাবনা রয়েছে। বর্ষায় পলি পড়ে উর্বর হয় এসব এলাকার জমি। তাই ফলনও হয় বাম্পার। এখনও বিদ্যুতের সুবিধা পেতে শুরু করেনি কৃষি খাত।
তবে এ বছর বোরো মৌসুমে ডিজেল চালিত ইঞ্জিনের ওপর পুরোপুরি নির্ভর করতে হবে না কৃষকদের। সেচকাজে তারা ব্যবহার করতে পারবেন বিদ্যুৎ শক্তিও। মৎস্য সংরক্ষণে কয়েকটি বরফকল গড়ে উঠলেও সেগুলোয় চড়া মূল্য দিয়ে সোলার শক্তি ব্যবহার করছেন ব্যবহাকারীরা।
কৃষক উজ্জ্বল শিকদার ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘কৃষিতে বিদ্যুৎ পাইয়া চরের কৃষি অনেক আউগ্যাইয়্যা গেছে। খরচ বেশি দেইখ্যা অনেক কৃষকই এই কাজ ছাইর্যা দিছে। হেরা অহন খেতি কাজ করে। যেই জমিতে এক ফলস হইত, অহন স্যানে দুই তিন ফসল চাষ করোন যায়। কোলেস্টরেল (কোল্ড স্টোরেজ) হইলে বেশি ফসল সেখানে রাহা যাইব। খ্যাতে পানি দিতে আর ত্যালের ওপর চাইয়্যা থাকতে হইব না।’
জয়বাংলা বাজারের সাব্বির বরফকলের মালিক শাহীন মোল্লা ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘সোলারের পাওয়ার হাউসের বিদ্যুতে ইউনিটে দিতাম, ৩০ টাহা আর পল্লী বিদ্যুতে লাগে ১২ টাহা। অর্ধেকেরও কম খরচ। প্রোডাকশনও বেশি করতে পারি। খরচ কইম্যা গেছে আর ব্যবসা বাড়ছে।’
নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছে বড় বড় ডকইয়ার্ড। এই চরের মানুষদের এখন আর দূর দূরান্ত থেকে ট্রলার, বলগেড কিনে আনতে হয় না। এখানেই উন্নত মেশিনারিজ দিয়ে ট্রলার, বলগেড তৈরি করা যায়। এখানে ও কর্মসংস্থানের বৃদ্ধি পেয়েছে।
ডকইয়ার্ড মালিক সুমন বেপারী ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘এই চরের সবকয়টি ট্রলার মালিকরা আমার এখান থেকে ট্রলার, বলগেড বানান। বিদ্যুৎ, বেরিবাধ হওয়ায় আমার আগের চেয়ে বেশি আয় হয়। মন্ত্রী এনামুল হক শামীম সাহেবকে ধন্যবাদ। তিনি এমপি মন্ত্রী হওয়ায় আমাদের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে।’
দীঘিরপাড় থেকে ট্রলার যোগে আসা হালিমা বেগম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ট্রলার থেকে নেমে আধা ঘণ্টা হাঁটতে হইতো আমাগো বাড়িতে যাইতে। এহন আর হাঁটতে হয় না। ট্রলার থেকে নেমেই অটোতে করে একেবারে বাড়ির ঘাটায় গিয়ে পৌছই। এই উন্নয়ন করেছে এনামুল হক শামীম। আমরা এদেশের মানুষ খুব খুশি।আমরা খুব ভালো আছি। আমরা আমাগো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য ও দোয়া করি। আমাগো মন্ত্রী শামীম সাহেবের জন্য ও দোয়া করি।’
অটো রিকশা চালক সাব্বির ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘বিদ্যুৎ পাইছি । আমি একটি অটো কিনছি। এটা রাতে চার্জ দেই। সারাদিন ভাড়ায় চালাই। আমার প্রতিদিন ২০০০ টাকা ইনকাম হয়। মাসে আমি খরচ বাদ দিয়া ৩০,০০০ টাকা ইনকাম করি। এসব কিছু আমাগো মন্ত্রী শামীম সাহেবের অবদান। আমরা কখনোই তার এই অবদান ভুলবো না।’
(ঢাকাটাইমস/০৩এপ্রিল/এসএ)

মন্তব্য করুন