পাঠ প্রতিক্রিয়া

বঙ্গবন্ধু: বিশ্বরাজনীতির আধ্যাত্মিক কিংবদন্তি

রুদ্র অহম
| আপডেট : ০৯ মে ২০২৩, ১৪:২৭ | প্রকাশিত : ০৯ মে ২০২৩, ১৩:৫১

বাংলাদেশ তৈরির লড়াইকে গোটা বিশ্বের কাছে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ আন্দোলন হিসেবে না দেখিয়ে, একটা ‘মুক্তিযুদ্ধ’ হিসেবে দেখানো—সামান্য কাজ ছিল না। এই কাজে বঙ্গবন্ধুর প্রধান মূলধন ছিল তাঁর স্বাভাবিক রাজনৈতিক অন্তর্দৃষ্টি। বঙ্গবন্ধুর সেই অন্তর্দৃষ্টি অনেক লেখক উপলব্ধি করতে না পারলেও কবি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার পিপিএম পেরেছেন।

তাই তো তিনি বঙ্গবন্ধুকে বিশ্ব রাজনীতির আধ্যাত্মিক কিংবদন্তি বলেছেন। ‘বঙ্গবন্ধু বিশ্বরাজনীতির আধ্যাত্মিক কিংবদন্তি’ নামে একটি বইও লিখেছেন। বইটি তিনি সমগ্র বাঙালি জাতি ও অনাগত প্রজন্মের সকল বাঙালির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেছেন।

লেখক তাঁর অন্তর্দৃষ্টিতে অনুধাবন করেছেন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অন্য রাজনীতিকের তুলনা চলে না। লেখকের অন্তর্দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধু বিশ্ব রাজনীতির আধ্যাত্মিক কিংবদন্তি। অন্যরা করতেন ‘আর্মচেয়ার পলিটিক্স’। বঙ্গবন্ধু মাঠেঘাটে ঘাম ঝরিয়ে রাজনীতি করা মানুষ। অন্য নেতারা মানুষের ‘ওপরে’ নিজেদের রাখতেন। বঙ্গবন্ধু মানুষের ‘মধ্যে’ মিশে গিয়ে, মানুষের আবেগের সঙ্গে নিজের আবেগকে ওতপ্রোত জড়িয়ে নিয়েছিলেন। এমন যাঁরা হন, তাঁরা কেবল নেতা নন, তাঁরা যেন রূপকথার নায়ক। তাঁরা রাজনীতির কিংবদন্তি। অন্য নেতারা দেশ তৈরি করেছেন রাজনীতির প্যাঁচ-পয়জার দিয়ে। আর বঙ্গবন্ধু রক্তকণিকা আর অশ্রুজল দিয়ে দেশ বানিয়ে তুলেছেন।

এমন উক্তি লেখকের আবেগের কথা নয়, আক্ষরিক ভাবে সত্যি কথা। সত্যিই তাঁর রাজনীতিতে মিশে আছে হাজার মানুষের চোখের জল, দেহের রক্ত। সেই দিক দিয়ে তাঁর সঙ্গে বরং তুলনা চলতে পারে হয়তো গ্যারিবল্ডির কিংবা নেলসন ম্যান্ডেলার। বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে তথ্য জানতে, বঙ্গবন্ধুকে সমর্থন করা থেকে সরিয়ে আনতে কত মানুষকে দিনের পর দিন অমানবিক শারীরিক অত্যাচার করা হয়েছে। আজকের এই হিংসা-অধ্যুষিত দিনেও পশ্চিমা শাসকদের নির্মম রাজনীতির কাহিনি শুনলে অসুস্থ লাগে।

এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার তাঁর লেখা ‘বঙ্গবন্ধু বিশ্বরাজনীতির আধ্যাত্মিক কিংবদন্তি’ বইতে লিখেছেন—‘বঙ্গবন্ধুকে তৎকালীন বিভিন্ন বিশ্বনেতারা তাদের চেয়েও অনেক বেশি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং প্রাজ্ঞ রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বিশ্বস্বীকৃতিতে তাদের চেয়ে তালিকার ঊর্ধ্বে থাকবেন উপলব্ধি করে হীনম্মন্যতায় ভুগেছিলেন।’

একটা দেশকে লড়াইয়ের জন্য তৈরি করা সহজ কথা নয়। পাকিস্তানের জন্মের পর যে অত্যন্ত জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয় পূর্ব পাকিস্তানে। এক হাতে তার জট ছাড়াতে ছাড়াতে, আর এক হাতে সেই জটিলতাকে মূলধন করে একটা বিস্ফোরক আন্দোলন তৈরি করার কাজটা সহজ ছিল না সেদিন। পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী রাজনীতিতে ধর্মের তাস খেলে বিষয়টি আরো জটিল করার চেষ্টা করছিল।

লেখক তাঁর বইতে লিখেছেন—‘ধুরন্ধর পাকিস্তানি ইন্টেলিজেন্ট তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের বিশেষ এক শ্রেণীর মানুষের ধর্মীয় অন্ধত্ব উপলব্ধি করে পাকিস্তানি শাসকদের যে গুরুত্বপূর্ণ শলাপরামর্শ দিয়েছিল, তার ভিত্তিতে চল্লিশের দশকের গোড়া থেকেই বিশেষ কায়দায় সেই শ্রেণীর মানুষের নানা ধরনের সুবিধা প্রদানের মধ্যে দিয়ে ধর্মীয় মোড়কে একটি শক্তিশালী করে তুলবার চেষ্টায় তারা সফল হয়েছিল।’

ধিকিধিকি ফুলকি ছড়িয়েই ছিল। আগুন জ্বলে উঠল ১৯৪৮ সালে, যখন পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা ও পূর্ব পাকিস্তানের কিছু মুসলিম লীগ নেতারা স্থির করলেন, দেশের রাষ্ট্রভাষা হবে—উর্দু। পূর্ব পাকিস্তান অনেক দূরে হলেও সেখানকারই জনসংখ্যা বেশি, তাঁদের ভাষা বাংলা, তবু উর্দু কেন?

আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্ররা সভা করে প্রতিবাদ শুরু করল। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চকে বাংলা ভাষা দিবস ঘোষণা করা হলো। জেলায় জেলায় ছাত্ররা বের হয়ে পড়ল। মুসলিম লীগের ছাত্ররা সভায় গোলমাল করার চেষ্টা করলে খুব মারপিট হয়, অনেকে জখমও হয়। এরপর বঙ্গবন্ধু ছাত্র সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন।

লেখক তাঁর ‘বঙ্গবন্ধু বিশ্বরাজনীতির আধ্যাত্মিক কিংবদন্তি' বইতে লিখেছেন—‘সার্বিক বিবেচনায় একজন জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে একটি দেশের জন্ম দেওয়ার চিন্তায় শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম যে সকল অসাধারণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম একটি সিদ্ধান্ত ছিল—১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি নিজ হাতে ছাত্রলীগের জন্ম দেওয়া। তিনি জানতেন তারুণ্যই সৃষ্টির প্রাণশক্তি। এক্ষেত্রে আরেকটি বিষয়কে প্রেক্ষাপট বিবেচনায় অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। আর, তা ছিল আমাদের মাতৃভাষা রক্ষার প্রয়োজনটি।’

লেখক তাঁর এই গ্রন্থে ৭ মার্চকে ‘অলৌকিক ৭ই মার্চ’ বলেছেন। লেখক বোঝাতে চেয়েছেন, বঙ্গবন্ধুর আর এক মূলধন—বাগ্মিতা। ৭ মার্চে ঢাকার সেই ঐতিহাসিক ভাষণ আধুনিককালের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতার মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে।

আবেগ-উদ্দীপিত বাক্য, সোজা-সোজা শব্দ যেন তীরের ফলার মতো গেঁথে যায় বিদ্রোহী বিক্ষুব্ধ দেশের কোণে কোণে—‘ভায়েরা আমার’ বলে সেই সম্বোধন, ‘এ বারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এ বারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’ সেই ডাক। ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা কিছু আছে আমি যদি হুকুম দেবার না-ও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে।’

অসংবদ্ধ বাক্যগঠন, স্থানিক ভাষা। কিন্তু এটাই পুর্ব বাংলার মানুষের প্রাণের ভাষা। সোজা গিয়ে তা মর্মস্থলে বিঁধবে, জানতেন বঙ্গবন্ধু। নিজেকে তিনি নামিয়ে আনতেন, ভাসিয়ে নিতেন মানুষের স্রোতে, তাঁদের ওপরে নিজেকে রাখতেন না। তাঁর বাগ্মিতা অপূর্ব, কিন্তু তাতে আনুষ্ঠানিকতা নেই। ‘আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না’—বাংলা ভাষায় এর তুল্য সংগ্রামী বার্তা আর আছে কি?

এটা লেখক তাঁর অন্তর্দৃষ্টিতে অনুধাবন করে বইতে লিখেছেন—‘যেন কোনো দৈব শক্তি বঙ্গবন্ধুর চেতনায় ভর করে এমন একটি ঐতিহাসিক চলচিত্রের দৃশ্যপট নিখুঁতভাবে মঞ্চস্থ করালেন।’

বঙ্গবন্ধুর শতবর্ষের পরে, বাংলাদেশের জন্মের পঞ্চাশ বছর পরে, কথাগুলো আবার আমাদের নতুন করে বুঝে নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন লেখক এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার পিপিএম।

[এটি বর্তমান লেখকের পাঠ প্রতিক্রিয়ার প্রথম কিস্তি। দ্বিতীয় কিস্তিতে লেখাটি সমাপ্ত হবে]

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :