'বঙ্গবন্ধু বিশ্বরাজনীতির আধ্যাত্মিক কিংবদন্তি': প্রকাশকের কথা

জহির বাবু
| আপডেট : ২১ জুন ২০২৩, ২১:৩৫ | প্রকাশিত : ২১ জুন ২০২৩, ২১:২৬

'কবিঘর প্রকাশ' আমাদের নবীন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান (২০১৯)। এখানে গান, কবিতা, নাটক আর গল্প বলার আড্ডা বসে প্রতিদিন। আমাদের গল্প জুড়ে থাকে মা, মাটি, দেশ আর চলমান পরিস্থিতির কথা। আমরা আনন্দিত হই সৃষ্টিসুখের উচ্ছ্বাসে। আমাদের এই নিয়মিত আড্ডায় অন্যতম এক সাথী জাহাঙ্গীর আলম সরকার। সাদা মনের সাহসী সুন্দর মানুষ, আমার প্রিয়জন, বন্ধু এবং একজন পুলিশ কর্মকর্তাও বটে।

আমাদের সম্পর্কের পেছনের একটা গল্প আছে।

সময়টা ২০১৩, আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৭১ এর খুনিদের বিচারকার্য চলছে। আমি নাটকের মানুষ, দেশাত্মবোধে গদগদ। যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে আমার একটা লেখা সেদিন জাহাঙ্গীর সরকারের কন্ঠে গান হয়ে ছড়িয়ে গিয়েছিল সর্বত্র।

"আজও কেঁদে যায় পদ্মা, মেঘনা, বুড়িগঙ্গা নদী

বুড়িমা আজও পথ চেয়ে বসে-

ছেলেটা তাহার মা মা বলে

ফিরিয়া আসিতো যদি"

রাজারবাগ পুলিশ লাইন হাসপাতালের কেবিনে আমাদের প্রথম পরিচয়। তখন তিনি কোমরের ব্যথায় শয্যাশায়ী,তবু হারমোনিয়াম নিয়ে বহুকষ্টে বিছানায় উঠে বসলেন। গানের কথাটা পেয়েই গুনগুন করে গাইতে শুরু করলেন, যেন এমন কিছুর জন্যই অপেক্ষা ছিলেন তিনি।

বললাম, এই গান করবেন? কেউ তো করতে চাচ্ছে না।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারতো সবাই চায়, কিন্তু এই কথার গান করার সাহস মনে হয় কেউ পাচ্ছে না। তিনি বললেন-

এই গানটাই তো দরকার এই সময়ে। এই গান আমি করব।

আশ্বস্ত হলাম। দেখলাম অদ্ভুত ইতিবাচক, সাহসী, সৃষ্টিশীল একজন মানুষকে, যার মন প্রাণ জুড়ে শুধুই মা-মাটি-দেশ আর বঙ্গবন্ধু। এ যেন আপাদমস্তক আমার গল্পের নায়ক। আমাদের গানটা শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চে ঝড় তুলেছিল।

এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার একাধারে একজন সংগীতশিল্পী, গীতিকার, সুরকার ও কলামিস্ট। আমাদের আড্ডা সারাদিন। গান লিখা হচ্ছে, সুর হয়ে যাচ্ছে কবিতা হচ্ছে। গলা ছেড়ে গান করছেন শিল্পী। আমাদের আড্ডায় এবার যুক্ত হলো আলো ঝলমলে আরেক গুণীজনের, ভাতৃপ্রতিম তরুণ কবি ও গীতিকার সঞ্জয় রায়। সঞ্জয়ের প্রেরণায় জাহাঙ্গীর সরকার এবার হয়ে উঠলেন পুরোমাত্রায় কবি, লেখক ও প্রাবন্ধিক।

বড়াল নদীর অববাহিকায় যে উর্বর পলিমাটি ছড়িয়ে আছে, সে উর্বরতায় ভরপুর প্রিয় লেখকের মন-প্রাণ আর সৃজনশীলতা। পারিবারিক পরম্পরায় তাঁর সহজাত ভাবনা জুড়ে দেশাত্মবোধ, মনন শুদ্ধতায় পরিপূর্ণ, আত্মশুদ্ধ আলোকিত সরলপ্রাণ এক মানুষ। বঙ্গবন্ধুকে তাই আবিষ্কার করে নিলেন সেই আধ্যাত্ম আলোয়। বিশ্ব রাজনীতির প্রবাদপুরুষ বঙ্গবন্ধু। প্রিয় লেখকের ভাষ্যে "বিশ্বরাজনীতির আধ্যাত্বিক কিংবদন্তি"।

এতদিনে লেখকের পাঁচটি গ্রন্থ আমাদের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত হয়েছে, এরই ধারাবাহিকতায় এবার অন্য রকম আয়োজন। নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি আমরা। কাগজ কলমের কোনো ব্যবহার ছাড়াই স্মার্টফোনে শুধু মুখে বলে বলে ১৬৩ পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপি শেষ করে আমাদের সবাইকে চমকে দিলেন। মুগ্ধ হলাম বিষয়বস্তু আর নামকরণ দেখে। এইতো চাই, একেবারে অন্যরকম ভাবনা। আমার ভালো লাগল।

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সারাবিশ্বে লেখালেখি আর গবেষণার অন্ত নেই। কিন্তু জাহাঙ্গীর সরকারের মতে আমাদের দেখা বঙ্গবন্ধুর চেয়ে অদেখা বঙ্গবন্ধুর বিস্তৃতি অনেক বেশি। সত্যি তাই, গ্রন্থে বাইশটি পৃথক পর্ব জুড়ে লেখক অনুসন্ধান করে গেছেন বঙ্গবন্ধুর মহাজাগতিক অবস্থান। নানা উপমা দিয়ে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন বঙ্গবন্ধু সত্যিই এক আধ্যাত্মপ্রাণ অতিমানবীয় চরিত্র, বিশ্বরাজনীতির প্রবাদপুরুষ, সময়ের শ্রেষ্ঠ সন্তান।

লেখকের কথায়- 'অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনস্তাত্ত্বিক গবেষক'। ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হওয়া পাকিস্তানকে মাত্র ২৪ বছরে উপমহাদেশের প্রথম সর্বব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদর্শে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম দিলেন তিনি। পূর্ববাংলার যে বাঙালি মিছিল করেছিল- 'লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান' বলে, সে বাঙালিই অস্ত্র উঁচিয়ে বলেছিল- 'তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা'।

এত দ্রুত সমগ্র জাতির মনস্তত্ত্বের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী সঞ্চালন সম্ভবত বিশ্বনেতাদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুই করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সে বিবেচনায়, নিঃসন্দেহে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বসেরা অনন্য এক মনস্তাত্ত্বিক গবেষক।

বইয়ের একটা অধ্যায়ের শিরোনামে লিখলেন- 'বঙ্গবন্ধুর অতিমানবীয় কিছু রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ' এবং একটা উপমায় বললেন- 'স্বাধীনতার স্বপ্নকে সার্বজনীন করতে এবং স্বাধীনতা অর্জনের স্থির লক্ষ্যকে নিশ্চিত করে বিজয় অর্জনে আওয়ামী লীগকে সাম্প্রদায়িক বলয় থেকে ১৯৫৫ সালে বের করে এনে জাত-পাত, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলের অংশগ্রহণের নিমিত্তে যে অসাম্প্রদায়িক প্ল্যাটফর্ম করেছিলেন বঙ্গবন্ধু, তা নিঃসন্দেহে ছিল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আরেকটি সময়োপযোগী জাদুকরী সিদ্ধান্ত।'

প্রিয় লেখক সরল সাধারণ চোখে বঙ্গবন্ধুর কিছু অসাধারন ছায়াচিত্র উন্মোচন করেছেন অসামান্য এক দক্ষতায়। একান্ত আলাপচারিতায় লেখকের কাছে একদিন প্রশ্ন করেছিলাম, এত বড় মানুষকে নিয়ে এত্ত বড় বই, কিছুই তো পড়লেন না! কীভাবে সম্ভব?

উত্তরে তিনি বলেছিলেন- "বঙ্গবন্ধুর অন্তরাত্মায় নিজেকে প্রতিস্থাপন করা অথবা বঙ্গবন্ধুকে নিজের অন্তরাত্মায় প্রতিস্থাপিত করা সম্ভব হলে দৃশ্যমান আত্মা অদৃশ্যে পরিভ্রমণ করে, কিংবা সাধনার দ্বারা অদৃশ্য আত্মাকে নিজের আত্মায় একান্ত করে নিতে পারলে তখনই কেবল নিগুঢ় অজানাকে জানা সম্ভব।"

শিহরিত হলাম আমি! তিনি কোথায় পেলেন এই সূত্র?

সত্যিই তাই, এই অসাধ্য সাধনে অবশ্যই আত্মার সম্পর্কস্থাপন জরুরি।

গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুকে একজন 'ঐশ্বরিক স্বপ্নদ্রষ্টা' বলেছেন তিনি। উল্লেখ করেছেন- 'ইতিহাসবেত্তারা যথাযথভাবে বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নিয়ে নিরপেক্ষ গবেষণা করলে এই পর্যন্ত সমস্ত বিশ্বনেতাদের চূড়ান্ত তালিকার শীর্ষে মহাকালের মহাবীর বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামটি সুশোভিত হবে, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, আনোয়ার সাদাত, কামাল আতাতুর্ক, ফিদেল কাস্ত্রো প্রমুখ স্বনামধন্য বিশ্বনেতারা ইতিহাসের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র বঙ্গবন্ধুকে চিনতে পেরে যথাযথ সন্মানের সঙ্গে বন্ধুস্বীকৃতির সম্পর্কে আলিঙ্গন করেছিলেন......ধিক্ সেই সব তথাকথিত নেতাদের, যারা তখন সভ্যতার বিকাশের নামে নিজেদের স্বার্থ ও ক্ষমতার লোভে সেই উদীয়মান স্কলার, রাজনৈতিক দর্শনের কবি বঙ্গবন্ধুকে বিশ্ব সভ্যতা বিকাশের যাত্রাপথে আলিঙ্গন না করে বরং তাঁর মৃত্যুকে আশু কামনা করে তা নিশ্চিত করেছিল।'

অলৌকিক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বঙ্গবন্ধু জানতেন আশির দশকেই রেড আর্মি ক্ষমতা হারাবে। পৃথিবীর রাজনৈতিক ক্ষমতা ভারসাম্য হারিয়ে পশ্চিমে ঝুঁকে পড়বে। তার আগেই দেশকে মুক্ত করতে হবে পাকিস্তানের কবল থেকে। প্রকৃতই এই উপলব্ধি কেবলমাত্র একজন স্বপ্নবাজ মহাপুরুষ ও ঐশ্বরিক স্বপ্নদ্রষ্টার পক্ষেই সম্ভব।

চাহিদার সাপেক্ষে গ্রন্থটির দ্বিতীয় মুদ্রণ হচ্ছে। পাশাপাশি ইংরেজী ভাষায় অনুবাদিত হতে চলেছে বৈশ্বিক প্রয়োজনে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আধ্যাত্বিক আলোর বিচ্ছুরণ প্রিয় লেখকের উপর বিচ্ছুরিত হয়েছে নিশ্চিত। মহাবিশ্ব থেকে প্রিয়জনকে খুঁজে নেবার মতো মহাকান্ড ঘটিয়েছেন প্রিয় লেখক। জাতির পিতার প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালবাসায় মুগ্ধ আমি। 'বঙ্গবন্ধু: বিশ্ব রাজনীতির আধ্যাত্বিক কিংবদন্তি' -বইখানা বঙ্গবন্ধুর উচ্চতাকে অন্যমাত্রায় জানতে ও ভাবতে শেখাবে পাঠককে, এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস। নিরন্তর শুভকামনা রইল।

জহির বাবু, প্রকাশক, কবিঘর প্রকাশ, বড় মগবাজার, ঢাকা।

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :