আরাভ ইস্যু হাওয়া? দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া মুখ থুবড়ে পড়ল?
পুলিশ পরিদর্শক মামুন হত্যা মামলার আসামি দুবাইয়ে পলাতক আরাভ খানকে নিয়ে চার মাস আগে হঠাৎ দেশজুড়ে হইচই শুরু হয়। তবে সে ইস্যু এখন হাওয়া।
ইন্টারপোলের রেড নোটিস মাথায় নিয়েই দুবাই চড়িয়ে বেড়াচ্ছেন আরাভ। মানব পাচারের নতুন হাতিয়ার ট্রাভেল এজেন্সি খুলেছেন দুবাইয়ে। অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া ও রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের ভিসা করিয়ে দেওয়ার নিশ্চয়তা দিয়ে ভিডিও পোস্ট করছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
আরাভকে দেশে ফিরিয়ে এনে শাস্তির মুখোমুখি করতে চেষ্টা চলছে বলে বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হলেও দৃশ্যমান তৎপরতা নেই। সব মিলিয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে আরাভকে দেশে ফেরানোর প্রক্রিয়া। আদৌ আরাভকে ফেরানো যাবে কিনা- সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছে না পুলিশ সদর দপ্তরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি) ডেস্ক।
আরাভকে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করার বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশ প্রধানসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হলেও ইস্যুটি চাপা পড়ে যাওয়ায় নানা প্রশ্ন উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আরাভের পেছনে থাকা রাঘববোয়ালরা ইস্যুটি কি ধামাচাপা দিয়ে দিলো? তাহলে আরাভের বিচার কি হচ্ছে না? পুলিশ খুন করেও ক্ষমতাধরদের ছত্রছায়ায় থাকার ফলে আরাভ কি বেঁচে গেলেন?
তবে পুলিশের একটি সূত্র বলছে, দুবাই পুলিশ আরাভকে এখনও নজরে রেখেছে। ইন্টারপোলের রেডনোটিস জারির পর থেকে আরাভ দুবাই ছাড়তে পারেনি। এখনো দুবাই পুলিশ আরাভকে দুবাইত্যাগ করতে দিচ্ছে না।
আরাভ ইস্যুতে নতুন কোনো তথ্য নেই বলে জানিয়েছেন পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) মনজুর রহমান। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমরা দুবাই পুলিশ ও ইন্টারপোলসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। চেষ্টা চলছে আরাভকে ফেরানোর।’
আরাভের বিষয়ে দুবাইয়ে বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেলের কার্যালয়ে পুলিশ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যোগাযোগ রাখছে বলে জানান এনসিবি ডেস্কের একজন কর্মকর্তা।
পুলিশ সদর দপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, আরাভ ভারতীয় পাসপোর্টে দুবাই অবস্থান করছে- সেটি আগে বাতিল করতে হবে। সে বিষয়ে ভারতের সঙ্গে কান্ট্রি টু কান্ট্রি (দেশের সঙ্গে দেশের) যোগাযোগ চলছে। যোগাযোগ আছে দুবাইয়ের সঙ্গেও।
ওই কর্মকর্তা বলেন, আরাভকে দ্রুত ফেরানোর আরেকটি বাধা হচ্ছে দুবাইয়ের আইন। ওই দেশে কোনো অপরাধ না করলে অন্য দেশের অপরাধের জন্য কাউকে সাজা দেওয়া হয় না। এমনকি অন্য দেশ থেকে দুর্নীতি ও পাচারের অর্থ ওই দেশে বিনিয়োগ করা নিয়েও কোনো প্রশ্ন করে না দেশটি। তবে অস্ত্র মামলায় আরাভের ১০ বছরের কারাদণ্ড হওয়ার কাগজপত্র পাঠানো হয়েছে দুবাইয়ে। জট খুলে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ইন্টারপোল রেডনোটিশ জারি করলেও আরাভকে দেশে ফিরিয়ে আনা নিয়ে বেশকিছু অনিশ্চয়তাও রয়েছে। ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি থাকার পর সেই অপরাধীকে সংশ্লিষ্ট দেশে ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি অপরাধী অবস্থান করা দেশের নীতির ওপর নির্ভর করে।
এদিকে ভারতীয় পাসপোর্ট নিয়ে দুবাইয়ে অবস্থান করা আরাভকে দুবাই পুলিশ ফেরত দেবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইন্টারপোল নিজে কাউকে গ্রেপ্তার করে না। সদস্য রাষ্ট্রের পুলিশকে অনুরোধ জানায় ওই অপরাধীকে যেন আইনের আওতায় নেওয়া হয়। তখন ওই দেশের পুলিশ তাদের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়। সেক্ষেত্রে আরাভ খানকে দেশে ফেরানো নির্ভর করছে বাংলাদেশ, ভারত ও দুবাই সরকারের মধ্যকার সম্পর্ক বা বোঝাপড়ার ওপর। তাকে দেশে ফেরাতে ভারতীয় পাসপোর্ট বাতিল করতে হবে। কেননা তিনি দুবাই অবস্থান করছেন ভারতীয় পাসপোর্টে। এরপর দুবাই সরকার আরাভ খানকে বাংলাদেশের কাছে দিতে রাজি হলে তাকে সেখানে গ্রেপ্তার করতে হবে। এরপর বাংলাদেশের দূতাবাস থেকে ইস্যু করা ট্রাভেল পাসের মাধ্যমে দেশে ফেরানো যাবে এই অপরাধীকে।
আরাভ খানকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পলাতক যে কোনো আসামিকে কূটনৈতিক ও পুশব্যাকের (কোনো দেশ নিজেদের উদ্যোগেই যদি ফেরত পাঠায়) মাধ্যমে দেশে ফেরত আনা যায়। কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় বহিঃসমর্পণ চুক্তি না থাকলেও অপরাধীকে ফেরানো যায়। তবে চুক্তি থাকলে দুই দেশের মধ্যে এক ধরনের বাধ্যবাধকতা থাকে। এতে অপরাধীকে ফিরিয়ে আনা তুলনামূলক সহজ। চুক্তি না থাকলে অপরাধী ফিরিয়ে আনার বিষয়টি দুই দেশের পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে। যেহেতু চুক্তি নেই সেক্ষেত্রে আরাভ খানকে ফিরিয়ে আনাও সম্পর্কের ওপর নির্ভর করছে। তবে প্রথম বাধা দুবাইয়ের বর্তমান নীতি। উদার বাণিজ্যনীতির কারণে দুবাই বিভিন্ন দেশের ধনীদের স্বর্গরাজ্য। এছাড়া অন্য কেনো দেশে করা অপরাধের জন্য দুবাই কাউকে অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করে না।
এ বিষয়ে পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোখলেসুর রহমান বলেন, ‘ইন্টারপোল যদি খবর পায় যে অভিযুক্ত কোন দেশে অবস্থান করছে, ইন্টারপোল সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারে।’ ইন্টারপোল সহযোগিতা করলে রবিউল ইসলামকেও ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি।
সম্প্রতি দুবাইয়ে নিজের স্বর্ণের দোকান আরাভ জুয়েলার্স উদ্বোধন ঘিরে আলোচনায় আসে পুলিশ পরিদর্শক মামুন হত্যা মামলার পলাতক আসামি আরাভ খানের নাম। গত ২৩ মার্চ বাংলাদেশি অপরাধী হিসেবে ইন্টারপোলের মোস্ট ওয়ান্টেডের তালিকায় রবিউল ইসলাম রবিউলের নাম যুক্ত হয়েছে।
২০১৮ সালের ৮ জুলাই বনানীতে আরাভের অফিসে পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক মামুন ইমরান খানকে হত্যা করা হয়। পরে তার মরদেহ পুড়িয়ে দেয় তারা। এ ঘটনায় পুলিশের করা মামলায় আসামি করা হয় আরাভ খান ওরফে রবিউল ওরফে হৃদয়কে। যিনি এখন শত কোটি টাকার মালিক। তার অর্থের উৎস নিয়ে আছে ধোঁয়াশা।
(ঢাকাটাইমস/০৭আগস্ট/আরআর/কেএম)