ইন্টারনেটে উন্মুক্ত শিশুর তথ্য, বাড়াচ্ছে নিরাপত্তা ঝুঁকি

কাজী মুস্তাফিজ, ঢাকা টাইমস
  প্রকাশিত : ২৬ নভেম্বর ২০২৩, ০৮:০৮| আপডেট : ২৯ নভেম্বর ২০২৩, ২৩:৪১
অ- অ+

ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যেনতেন ব্যবহারে নিজের অজান্তেই শিশুদের ঝুঁকি বাড়াচ্ছেন অভিভাবকেরা। উন্মুক্তভাবে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়া শিশুদের বিভিন্ন মুহূর্তের ছবি ভবিষ্যতে কাল হতে পারে। প্রাইভেসি ঝুঁকি, আর্থিক কেলেঙ্কারি কিংবা আরও নানা ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা বাড়াচ্ছে এসব ‘খামখেয়ালিপনা’। এছাড়া দিনরাত ব্যবহারের ফলে স্মার্টফোনে আসক্তিও তৈরি হচ্ছে শিশুদের। দেশে গত ছয় বছরে শিশুদের সাইবার অপরাধের শিকার হওয়ার ঘটনা বেড়েছে ১৪০ শতাংশ, যা খুবই উদ্বেগজনক বলে জানাচ্ছেন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা।

সন্তানের প্রথম হাসি, প্রথম হাঁটতে পারা, স্কুলে যাওয়ার প্রথম দিনসহ দারুণ সব মুহূর্ত বন্ধুবান্ধব কিংবা পরিচিতজনদের দেখাতে চান অনেকেই। বিভিন্ন লেখালেখি, ছবি কিংবা ভিডিও প্রকাশের মাধ্যমে অনেক বাবা-মা সন্তানের ব্যক্তিগত সব তথ্য ছড়িয়ে দিচ্ছেন ইন্টারনেটে, যাতে শিশুদের ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার অধিকার বা প্রাইভেসি লঙ্ঘন হচ্ছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ঘিরে ২০১০ সাল থেকে ‘শেয়ারেন্টিং’ নামে একটি নতুন শব্দের ব্যবহার বেড়েছে। শেয়ারিং এবং প্যারেন্টিং শব্দ দুটি মিলিয়ে ‘শেয়ারেন্টিং’ বলা হয়। এটি মূলত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মা-বাবা কর্তৃক সন্তানের ছবিসহ বিভিন্ন তথ্য প্রচারের চর্চাকে বুঝায়, যা সন্তানের ভবিষ্যতকে ঝুঁকিপূর্ণ করতে ভূমিকা রাখছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

দেশে জনসচেতনতা তৈরিতে বেসরকারি উদ্যোগে কাজ করছে ‘সাইবার নিরাপত্তা সচেতনতাবিষয়ক জাতীয় কমিটি’। এই কমিটি সদস্য কম্পিউটার প্রকৌশলী মো. মুশফিকুর রহমান বলেন, অনেক বাবা-মা বিভিন্ন উপলক্ষকে কেন্দ্র করে শিশুদের বিভিন্ন মুহূর্তের ছবি-ভিডিও ইত্যাদি উন্মুক্তভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দিচ্ছেন। এসব কনটেন্টে অন্যদের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া, মন্তব্য পেয়ে আনন্দিত হচ্ছেন অভিভাবকরা। কিন্তু এগুলো উন্মুক্তভাবে ইন্টারনেটে দেওয়ার ফলে সাইবার দুর্বৃত্তরা অপব্যবহার করতে পারে।

ডিজিটাল অপহরণ: অনেকে সন্তানের ইউনিফর্ম পরা ছবি, পরিচয়পত্র ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দিয়ে সবাইকে জানাচ্ছেন আজ তার প্রথম বিদ্যালয়ে যাওয়ার দিন। এসব পোস্ট থেকে সন্তানের ব্যক্তিগত তথ্য, যেমন: শিশুর নাম, বাসার ঠিকানা, বয়স, বিদ্যালয়ের নাম-ঠিকানা ইত্যাদি সহজেই পাওয়া যায়। এসব তথ্য কাজে লাগিয়ে শিশুটিকে অপহরণের টার্গেট করতে পারে দুর্বৃত্তরা। বাবা-মায়েরা নিজেদের জীবনযাপন সম্পর্কেও অনেক তথ্য দেন। এসব দেখে তাদের আর্থসামাজিক অবস্থান সম্পর্কে সহজে জেনে নেওয়া সম্ভব। এতে দুর্বৃত্তরা কাকে নিশানা বানাবে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়।

প্রকৌশলী মুশফিকুর রহমান ঢাকা টাইমসকে বলেন, অনলাইনে পরিচয় চুরি ডিজিটাল অপহরণের ক্ষেত্রে বড় ঝুঁকি তৈরি করে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ফেসবুকে শিশুদের যেসব ছবি প্রকাশ হয় সেগুলোর ৪৫.২ শতাংশ পোস্টে শিশুদের নাম উল্লেখ থাকে। ইনস্টাগ্রামে ১৯ শতাংশ পোস্টে শিশুদের নাম ও জন্ম তারিখ দুটোই থাকে। এসব তথ্য ‘ডার্ক ওয়েব’ গেলে ডিজিটাল অপহরণের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করবে।

শিশুদের কনটেন্ট দিয়ে বিশ্বব্যাপী যৌন কারবার: অনলাইনে যেখানেই শিশুদের কনটেন্ট আছে, সেখানেই দুর্বৃত্তদের উপস্থিতি আছে। অনলাইনে শিশু নির্যাতনের ঘটনাগুলো তদন্তকারীদের ভাষ্য, অনলাইনে প্রকাশ করা শিশুদের লাখ লাখ ছবি পর্নোগ্রাফি ওয়েবসাইটে স্থান পায়। এসব ছবিকে প্রযুক্তির সহায়তায় সম্পাদনার মাধ্যমে পর্নোছবিতে রূপান্তর করা হয় এবং এগুলো অনলাইনেই চড়া দামে বিক্রির বাজার রয়েছে।

ইন্টারপোলের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক শিশু পর্নোগ্রাফি চক্রে সম্পৃক্ততার দায়ে ২০১৪ সালের ৯ জুন ঢাকার খিলগাঁওয়ে অভিযান চালিয়ে টি আই এম ফকরুজ্জামান ওরফে টিপু কিবরিয়াকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। পরে তার তিনজন সহযোগীও গ্রেপ্তার হয়।

সিআইডির মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহ আলম বলেন, মামলায় রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের পর টিপু ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানিয়েছেন- বিদেশি গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী পর্নোছবি বানিয়ে জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, সৌদি আরব ও যুক্তরাজ্যে পাঠাতেন। এর মধ্যে জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডের তিন ব্যক্তির একেকজনের কাছ থেকে প্রতি মাসে ৫০ হাজার করে দেড় লাখ টাকা পেতেন বলে জানান টিপু। কিন্তু টিপু কিবরিয়াকে নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে আদালত খালাস দিয়েছেন। মামলার ছয় বছর পর ২০২০ সালের নভেম্বরে মহানগর দায়রা জজ কে এম ইমরুল কায়েশ এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।

ভবিষ্যতে আরও যে ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা: শিশুদের নাম-পরিচয় ব্যবহার করে যেসব ছবি-ভিডিও পোস্ট করা হয় সেগুলোর সঙ্গে বাবা-মায়ের নামও উল্লেখ থাকে। অনেক সময় বাবা-মা ছাড়াও অন্যরা ছবি তুলে সেগুলো পোস্ট করে এবং বাবা-মায়ের নাম উল্লেখ করে কিংবা তাদের আইডির সঙ্গে ট্যাগ করা হয়। এতে শিশুর পরিবারের তথ্যও যুক্ত হয় ছবির সঙ্গে। এসব ছবি-ভিডিও কেউ অসৎ উদ্দেশে ব্যবহার করার পর দীর্ঘদিন তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে থাকতে পারে। অনৈতিক কোনো উদ্দেশ্যে কোনো শিশুর কনটেন্ট ব্যবহার হলে সেটি ক্ষতি ডেকে আনতে পারে ভবিষ্যতে। যেমন: শিশু পর্নোগ্রাফিতে কোনো শিশুর তথ্য ব্যবহার হলো। এই শিশু বড় হয়ে কর্মজীবনে পা রাখার সময় জানা গেল পুরোনো কোনো পর্নো ডাটাবেজে তার নাম, বাবা-মায়ের নামসহ উল্লেখ আছে। অর্থাৎ কর্মজীবনে জানা গেল এই মানুষটি শিশু বয়স থেকে পর্নোগ্রাফির মতো অনৈতিক কাজের সঙ্গে যুক্ত।

সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ সৈয়দ জাহিদ হোসেন ঢাকা টাইমসকে বলেন, যেকোনো বয়সি মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য খুবই মূল্যবান এবং বাংলাদেশে ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষার বিষয়টি নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। রাষ্ট্র কর্তৃক এই তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। ব্যক্তিগত তথ্যের অপব্যবহারের ফলে দীর্ঘমেয়াদে যে ভয়ংকর পরিণতি হতে পারে সেই সম্পর্কে মানুষ অত গভীরে ভাবে না। কিন্তু ক্ষতির শিকার হয়ে গেলে তখন আর তাৎক্ষণিকভাবে কিছু করার থাকে না। এজন্য মানুষের মধ্যে জনসচেতনতা তৈরির বিকল্প নেই। এই বিশেষজ্ঞ বলেন, অসচেতনতায় ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়া তথ্যগুলো আর্থিক কেলেঙ্কারিরও কারণ হতে পারে। যেমন: কেউ কোনো আর্থিক লেনদেন সম্পর্কিত তথ্যে কারও নাম, ঠিকানা, বাবা-মায়ের নামসহ অন্যান্য ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করতে পরে। পরবর্তীতে এ সম্পর্কিত কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়লে সেটির ক্ষতির শিকার হবেন যার তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে সেই ব্যক্তি।

ইন্টারনেটে ছড়ানো তথ্য পুরোপুরি মুছে না: দৈনন্দিন জীবনযাপনের নানা তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানানোর মাধ্যমে ব্যবহারকাররীরা মূলত অসংখ্য তথ্য তৈরি করছে। আর এসব তথ্যকেই বলা হচ্ছে প্রযুক্তির জ্বালানি। অর্থাৎ ব্যবহারকারীদের তৈরি করা তথ্যের মাধ্যমেই সক্রিয় আছে বিভিন্ন ওয়েব পোর্টাল। এ কারণে একদিকে ব্যক্তিগত তথ্য যেমন কারো জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে, অন্যদিকে অপরাধীর পদচিহ্ন শনাক্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তে।

ডিজিটাল ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ মেহেদী হাসান ঢাকা টাইমসকে বলেন, মূলত ইন্টারনেটে ‘ডিলিট’ বলতে কোনো শব্দ নেই। আমরা যখন কোনো তথ্য মুছে দেই, তখন এই তথ্যের একটি অংশ আমাদের সংশ্লিষ্ট জায়গা থেকে কেবল অদৃশ্য হয় এবং এর আরেকটি অংশ থেকে যায়। প্রযুক্তিগত জ্ঞান যার আছে সেই ব্যক্তি এই তথ্য পুনরুদ্ধার করে কাজে লাগাতে পারেন।

শিশুর স্মার্টফোন আসক্তির ভয়াবহ পরিণতির বাস্তব চিত্র: স্মার্টফোন আসক্তিতে জড়িয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে শিশুরা। শারীরিক খেলাধুলার পরিবর্তে সারাদিন স্মার্টফোনকে সঙ্গী করে নিচ্ছে তারা। শিশুদের এমন আসক্তি ঠেকাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে অভিভাবকদের। এমন ভয়াবহ পরিণতির কিছুs বাস্তব ঘটনা তুলে ধরা হলো এই প্রতিবেদনে-

ঘটনা ১: রাশেদ (ছদ্মনাম) বয়স ১৭ বছর। মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী। তার মা পেশায় গৃহিণী। রাশেদ দ্বিতীয় শ্রেণিতে থাকতেই বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর রাশেদকে হোস্টেলে পাঠানো হয়। তার একমাত্র কারণ সে মায়ের কোনো কথাই শোনে না। আস্তে আস্তে সে প্রতিদিন মায়ের থেকে ৫০-১০০ টাকা করে নেওয়া শুরু করে। একপর্যায়ে টাকা জমিয়ে একটা স্মার্টফোন ফোন কিনে। ফোনে বিভিন্ন খেলা, অশ্লীল ভিডিও দেখা শুরু করে। এরপর মায়ের কাছে আরও টাকা দাবি করে। একপর্যায়ে মাকে গালিগালাজ, মারধর করা শুরু করে। অপারগ হয়ে ছেলেকে প্রায় ছয় লাখ টাকা দেন। এই টাকা দিয়ে শিশুটি অনলাইনে জুয়া খেলায় বিনিয়োগ করে। রাশেদের উচ্ছৃঙ্খল আচরণের জন্য পরবর্তীতে তাকে হোস্টেল থেকে বরখাস্ত করে দেওয়া হয়। এরপর একটা মেসে থাকে। টাকা শেষ হওয়ার পর মেসে তার বন্ধুসহ একটা মেয়েকে নিয়ে আসে। মেয়েটার অশ্লীল ভিডিও করে তাকে ব্লাকমেইল করে এবং মেয়েটি থেকে টাকা নেয়। শেষমেশ মা অসহনীয় হয়ে রাশেদকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়। এত বেশি মোবাইল ফোনে আসক্ত হয়ে পড়ছে যে তার হিতাহিত কোনো জ্ঞান নেই। ছয় সপ্তাহ হাসপাতালে থাকার পর সুস্থ হয়। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো নিয়মিত ওষুধ চলে তার।

ঘটনা ২: ৮ম শ্রেণি পড়ুয়া আবীরের (১৭) মা স্মার্টফোন ব্যবহার করতো। মাঝে মাঝে মায়ের স্মার্টফোন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি পরে অভ্যাসে পরিণত হয়। দিনে ৭/৮ ঘণ্টা পর্যন্ত ফোনে কাটে তার। আসক্তিটা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে স্মার্টফোন হাত থেকে নিয়ে নিলে দেয়ালে মাথা ঠুকতো। অজ্ঞান হয়ে যেত, মুখে লালা বের হয়ে যেত, চোখ রক্তবর্ণ ধারণ করত। পরে তাকে কুমিল্লার একটি মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসা দিয়ে তাকে সুস্থ করে তোলা হয়।

ঘটনা ৩: সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী আকাশ (১৪) বাবা-মায়ের স্মার্টফোন নিয়ে মাঝেমধ্যে ভার্চুয়াল গেমস খেলতো। আসক্তি তৈরির একপর্যায়ে বাবা-মায়ের কাছে টাকা চেয়ে না পেলে বাসায় জিনিসপত্র ভাঙচুর শুরু করে। স্কুল যাওয়া বন্ধ করে দেয়। দুই-তিন দিন পরপর ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা দিতে হতো তাকে। টাকা দেওয়া বন্ধ হলেই আবার উগ্র আচরণ দেখা দেয়। একপর্যায়ে নেশা শুরু করে। পরবর্তীতে অবস্থা গুরুতর দেখে তাকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সেখানে প্রায় ছয় সপ্তাহ চিকিৎসার পর সুস্থ হয়েছে।

সাইবার অপরাধে শিশু ভুক্তভোগী বাড়ছে: চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী দেশে ইন্টারনেট গ্রাহক ১২ কোটি ৬১ লাখের বেশি। এর মধ্যে মুঠোফোনে ইন্টারনেট গ্রাহক ১১ কোটি ৪০ লাখের বেশি এবং ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের গ্রাহক ১ কোটি ২০ লাখের বেশি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) কর্তৃক বাংলাদেশের শিশুদের নিয়ে ২০২২ সালে ‘অনলাইনে শিশু নির্যাতন’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। এতে দেখা গেছে, গ্রামীণ এলাকার ১১ থেকে ১৭ বছর বয়সিদের প্রায় ৩৩ শতাংশ শিশুই ইন্টারনেট ব্যবহার করে। একই সঙ্গে তাদের মাঝে কমপক্ষে একটি, দুটি বা তিনটি সাইবার অপরাধের শিকার হওয়ার প্রবণতা ছিল যথাক্রমে ৫৯ শতাংশ, ৩৮ শতাংশ এবং ২৬ শতাংশ।

বিএসএমএমইউর চিকিৎসক মুহাম্মদ ইব্রাহীম ইবনে তৌহিদ বলেন, গ্রাম এলাকার ৪৬০ শিশুর ওপর এই গবেষণা পরিচালিত হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুরা বেশি শিকার হয় এমন বিভিন্ন ধরনের সাইবার অপরাধের মধ্যে ছিল উৎপীড়ন, উপহাস, গুজব কিংবা অপমান (৩৫ শতাংশ), অসৎ উদ্দেশ্যে বেনামে যোগাযোগ (২৯ শতাংশ), যৌন-নিপীড়নমূলক বার্তা কিংবা মন্তব্য (১১ শতাংশ) এবং যৌনতাপূর্ণ ছবি বা ভিডিও (১৭ শতাংশ)।

গবেষণার বরাত দিয়ে ডা. মুহাম্মদ ইব্রাহীম জানান, সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সরকারের নীতির কারণে ইন্টারনেট ব্যবহারের হার অনেক বেড়েছে। ইন্টারনেট সম্পর্কে কম জ্ঞান এবং সঠিকভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে না পারার কারণে অপরাধীরা ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ইমো এবং হোয়াটসঅ্যাপের মতো অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে শিশুদেরকে নির্যাতন করতে সক্ষম হয়।

সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত ‘বাংলাদেশে সাইবার অপরাধ প্রবণতা-২০২৩’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, দেশে সাইবার অপরাধে ভুক্তভোগীদের মধ্যে শিশুদের হার ক্রমেই বাড়ছে। গত ছয় বছরে শিশু ভুক্তভোগীর সংখ্যা ১০ শতাংশ থেকে বেড়ে প্রায় ১৪ শতাংশে পৌঁছেছে, যা উদ্বেগজনক। এসব অপরাধের মধ্যে বেশিরভাগই সাইবার বুলিং, যৌন হয়রানি বিষয়ক।

নীতিমালা এবং জনসচেতনতার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের: বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নত দেশগুলোতে নারী-শিশুর বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ‘অনলাইন নীতিমালা’ আছে। বাংলাদেশে এমন কিছু এখনও হয়নি। এছাড়া প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে অভিভাবকদেরও সচেতন হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। এসব বিষয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এবং অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা জরুরি।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের শিশু-কিশোর ও পারিবারিক মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, শিশুদের কল্পনাশক্তি, চিন্তাশক্তিও কমে যাচ্ছে। নগরে খেলার মাঠ, বেড়ানোর নিরাপদ জায়গার অভাবও এর কারণ। শিশুদেরকে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া এবং তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ হয় এমন খেলাধুলায় ব্যস্ত রাখা গেলে, প্রযুক্তি ও অনলাইনের প্রতি আসক্তি অনেকটাই কমানো সম্ভব।

হেলাল উদ্দিন বলেন, এই যুগে শিশুদের জন্য ইন্টারনেট শুধু জরুরি নয়, মহাজরুরি। এর মাধ্যমে শিশুরা বিশ্বনাগরিক হওয়ার লড়াইয়ে এক ধাপ এগিয়ে যাবে। ক্ষতিকর দিক এড়িয়ে শিশুদের ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ দিতে হবে। স্ক্রিনে ৪০ মিনিটের বেশি সময় কাটাতে দেওয়া যাবে না। ভালো ভালো সাইট দেখতে শিশুদের উৎসাহ দিতে হবে। এই বিশেষজ্ঞের মতে, ইন্টারনেট ব্যবহারে সন্তানদের চেয়ে দক্ষতায় পিছিয়ে অভিভাবকেরা। সেই সুযোগে সন্তানেরা মা-বাবাকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। এ জন্য অভিভাবকদের ইন্টারনেট ব্যবহার সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে হবে। বৈদ্যুতিক ডিভাইসের ‘প্যারেন্টাল গাইডেন্স’ (অভিভাবকদের নির্দেশনা) ব্যবহারবিধি শিখতে হবে। এতে শিশুর ব্যবহৃত ডিভাইস শতভাগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন অভিভাবক।

ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল কার্ডিফ ইন্টারন্যাশনালের প্রিন্সিপাল এ এম এম খাইরুল বাশার বলেন, বিশ্বব্যাপী বর্তমানে অনলাইন আসক্তিকে বলা হচ্ছে ‘ডিজিটাল কোকেন’। বাংলাদেশেও এখন বিষয়টি উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এজন্য স্কুল এবং অভিভাবক উভয়কেই ভূমিকা নিতে হবে।

সাইবার নিরাপত্তা সচেতনতা বিষয়ক জাতীয় কমিটির সদস্য প্রকৌশলী মুশফিকুর রহমান বলেন, উন্নত বিশ্বে ইন্টারনেট ব্যবহারে নারী-শিশুর বিষয়ে আলাদা নীতিমালা আছে। এই নীতিমালায় নারী-শিশুর বিষয়ে ইন্টারনেটে বিধিনিষেধগুলো সুনির্দিষ্টভাবে বলা থাকে। এর ফলে সুরক্ষার বিষয়ে দিকনির্দেশনা পান নাগরিকরা। বাংলাদেশে এটি এখনও হয়নি, সরকারিভাবে এটি করা এখন জরুরি। এক্ষেত্রে অংশীজনদের পরামর্শ নিতে পারেন সংশ্লিষ্টরা।

(ঢাকাটাইমস/২৬নভেম্বর/কেএম/এফএ)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
আ.লীগকে নিষিদ্ধের দাবিতে যমুনার সামনে রাতভর অবস্থানের পর সকালেও বিক্ষোভ
এলাকাবাসীর বিক্ষোভ-অবস্থানের মধ্যে অভিযানের সাড়ে ছয় ঘণ্টা পর গ্রেপ্তার সাবেক মেয়র আইভী
মানবিক করিডরের নামে কোনো কিছু জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে না, মির্জা ফখরুলের হুঁশিয়ারি 
জম্মু-কাশ্মীরে হামলার ভারতীয় প্রতিবেদন ‘ভুয়া এবং মিথ্যা’: পাকিস্তান
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা