রাজনীতিতে প্রত্যাখ্যানসংস্কৃতি কাম্য নয়

আলী রেজা
| আপডেট : ২৬ নভেম্বর ২০২৩, ১৫:২৫ | প্রকাশিত : ২৬ নভেম্বর ২০২৩, ১৪:৫১

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো তফসিল প্রত্যাখ্যান করেছে। শুধু তফসিল প্রত্যাখ্যান নয়; বিদ্যমান ব্যবস্থায় তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে বলেও মনে হচ্ছে না। তফসিল বাতিলের দাবিতে তারা কয়েক দফা হরতাল-অবরোধ পালন করেছে এবং এ কর্মসূচি চলমান রেখেছে। অন্যদিকে বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে তফসিল পুনর্বিন্যাস করার আশ্বাস দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এতে আওয়ামী লীগের কোনো আপত্তি নেই বলে জানিয়েছে দলটির সাধারণ সম্পাদক। ইতোমধ্যে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা তিনটি দল বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির নেতৃত্বে ‘যুক্তফ্রন্ট’ গঠন করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার ঘোষণা দিয়েছে। তার আগে বিএনপি থেকে বেরিয়ে আসা কিছু নেতাকর্মী ‘তৃনমূল বিএনপি’ নামে একটি দল গঠন করে আসন্ন নির্বাচনে তিন’শ আসনেই প্রার্থী দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। নির্বাচন কমিশনের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করার প্রতিশ্রুতি এবং নির্বাচন কমিশনের ওপর সরকারের কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ না করার আশ্বাস পেয়ে জাতীয় পার্টি এককভাবে তিনশ আসনে নির্বাচন করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বিএনপি তফসিল প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলনে নেমেছে। চলমান এ আন্দোলন যে বিএনপির জন্য কোনো সুফল বয়ে আনবে না, হরতাল-অবরোধের বেহাল দশা দেখে তা অনুমান করা যাচ্ছে। হরতাল-অবরোধে জনজীবন অনেকটাই স্বাভাবিক। অফিস-আদালত চলছে। সিএনজি-অটোরিকশা চলছে। ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও বাস মালিকরা বাস ছাড়া শুরু করেছে। বাংলাদেশে প্রত্যাখ্যানের রাজনীতি নতুন নয়। কিন্তু এর ফলাফল ভালো হতে দেখা যায়নি কখনো। অতীতে প্রত্যাখ্যানকারীরা দৃশ্যমান কোনো রাজনৈতিক সুফল তাদের ঘরে তুলতে পারেনি। একানব্বই পরবর্র্তী প্রতিটি নির্বাচনে পরাজিত পক্ষ নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে। কখনো স্থূল কারচুপি, কখনো সূক্ষ্ম কারচুপি, কখনো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা আবার কখনো রাতের ভোটের অভিযোগ তোলা হয়েছে। অভিযোগের সত্যতা থাক আর নাই থাক- নির্বাচন বাতিল হয়নি কখনো। বরং নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় জনগণের জানমালের ক্ষতি হয়েছে। তার মানে প্রত্যাখ্যান করে পরাজিত পক্ষের কোনো লাভ হয়নি। দেশের সাধারণ মানুষেরও কোনো লাভ হয়নি। দেখা যায়, প্রতি বছর সরকারের ঘোষিত বাজেট বিরোধী পক্ষ প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু কোনো লাভ হয় না। কিছুটা সংযোজন-বিয়োজনের মাধ্যমে বাজেট ঠিকই পাস হয়ে যায়। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তফসিল প্রত্যাখ্যান বিএনপির জন্য কোনো ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে বলে মনে হয় না। তফসিলের বিরুদ্ধে দফায় দফায় ডাকা হরতাল-অবরোধ সাধারণ মানুষ গ্রহণ করেনি। অতর্কিত হামলা, গাড়ি ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের মতো ধ্বংসাত্মক ও নৃশংস কর্মকাণ্ড মানুষ এখন পছন্দ করে না। চলমান হরতাল-অবরোধ সাধারণ মানুষ গ্রহণ না করলেও এর ফলে একদিকে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে অন্যদিকে রাজনৈতিক অঙ্গন ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠছে। দেশের স্বার্থে একটি রাজনৈতিক সমাধানের পথ খুঁজে বের করা জরুরি হলেও এ ব্যাপারে এগিয়ে আসছে না কোনো পক্ষ। বিএনপি নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অনড় অবস্থানে থাকলেও সরকার সেদিকে কর্ণপাত করছে না। এ পরিস্থিতিতে বিএনপিকে অতি সতর্কতার সঙ্গে করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। দেশের একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপিকে সর্বাগ্রে জনস্বার্থের কথাই চিন্তা করতে হবে। কারণ দলটি একাধিকবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল। ভবিষ্যতে আবার ক্ষমতায় আসবে- এটাই স্বাভাবিক। সারা দেশে বিএনপির অসংখ্য নির্বাচনমুখী নেতা-কর্মী আছে। তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চায়। দলীয় সমর্থকরা ভোট দিয়ে তাদের পছন্দের প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে চায়। নির্বাচন বর্জনের ঘোষণায় তারা হতাশ হয়। ইতোমধ্যে নির্বাচন বর্জনের সম্ভাবনার কথা চিন্তা করে বিএনপির অনেক জনপ্রিয় নেতা দল থেকে বেরিয়ে এসে স্বতন্ত্র নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিএনপি নিয়ন্ত্রিত জোটের বেশ কয়েকটি শরীকদল জোট থেকে বের হয়ে এসে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছে। এই বাস্তবতায় নির্বাচন বর্জন করা বিএনপির জন্য কতটা সঠিক হবে- তা গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে। ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি বড়ো ধরনের ভুল করেছিল বলে মনে করেন অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তাঁদের মতে, পাঁচ বছর দলটির কোনো প্রতিনিধি জাতীয় সংসদে না থাকার কারণে দলটির সাংগঠনিক শক্তি ও সক্ষমতা অনেক কমে গেছে। সাধারণ জনগণও তাই মনে করে। অথচ দেশে দলটির রয়েছে ব্যাপক জনসমর্থন। এই জনসমর্থনকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছে দলটি। গত এক দশকের রাজনীতি বিশ্লেষণ করে বলা যায় প্রত্যাখ্যানসংস্কৃতি রাজনীতিতে কোনো সুফল বয়ে আনেনি। তফসিল প্রত্যাখ্যান, আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান এবং সবশেষে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করলে বিএনপির কী লাভ হবে? উপস্থিত কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না। অতীতেও হয়নি। ভবিষ্যতে যে লাভ হবে সে সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করলে একটি রাজনৈতিক দল সবচেয়ে বেশি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ২০১৪ সালের নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করার ফলে দশম সংসদে বিএনপির কোনো প্রতিনিধি ছিল না। এতে দল হিসেবে বিএনপি যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। পরবর্তী প্রায় এক দশকে একদিকে দলটির সাংগঠনিক ভিত্তি দুর্বল হয়েছে অন্যদিকে আর্থিক সক্ষমতাও কমে গেছে। একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিএনপি যে সামান্য সংখ্যক আসন পেয়েছিল সেটি বিএনপির জন্য ছিল বেমানান। সে ফলাফল যে দলটির প্রকৃত অবস্থার প্রতিফলন নয় তা দেশের জনগণ বিশ্বাস করে। তারপরও পদত্যাগ না করে তারা সংসদে ছিল। এতে দলটি রাজনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছে। জাতীয় সংসদে দলটি জনগণের কথা বলতে পেরেছে। সরকারের ব্যর্থতার দিকগুলো তুলে ধরতে পেরেছে।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সংসদ অধিবেশনে বিএনপির সাংসদদের কথা শোনার জন্য দেশবাসী কান খাড়া করে রাখতো। কিন্তু নির্বাচন বর্জন করলে তারা সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতো। সুতরাং শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের কথাই ভাবতে হবে। নিজেদের স্বার্থেই বর্জন বা প্রত্যাখ্যানের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। গত পাঁচ বছরে বিএনপির সবচেয়ে বড়ো রাজনৈতিক সফলতা হলো তারা সংসদে জনগণের কথা বলতে পেরেছে। তাদের বক্তব্য গ্রহণ করা হলো নাকি হলো না- তার চেয়ে বড়ো বিষয় হলো জনগণ তাদের কথা শুনেছে। সংসদের বক্তব্য এখন লাইভ সম্প্রচারের মাধ্যমে মুহূর্তেই সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। দেশের মানুষ এসব বক্তব্য নিয়ে আলোচনা সমালোচনা করতে পারে। সংসদ সদস্যদের বক্তব্য এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়ে। সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার মাধ্যমে এখন একটি রাজনৈতিক দল সবচেয়ে বেশি জনসম্পৃক্ত থাকতে পারে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংসদে যাওয়ার একমাত্র উপায় হলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা। বিএনপি একটি জনসমর্থনপুষ্ট নির্বাচনমুখী দল। নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে দলটি অতীতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তারা অংশগ্রহণ করে ক্ষতি পুষিয়ে নেবে এবং জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করবে- এটাই সকলের কাম্য। সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছার জন্য উভয় পক্ষেরই চরমপন্থা পরিহার করতে হবে। সংকটকালে দেশের স্বার্থে দলীয় স্বার্থ ত্যাগ করা যেতেই পারে। কারণ দেশকে নিয়েই তো রাজনীতি। দেশের কল্যাণে, মানুষের কল্যাণে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুখী সমৃদ্ধ উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলকেই এগিয়ে আসতে হবে। স্ব-স্ব অবস্থান থেকে একটু নড়েচড়ে বসলেই যদি চলমান সংকট থেকে উত্তরণের একটি পথ খুঁজে পাওয়া যায় তাহলে একটু নড়েচড়ে বসতে দোষ কোথায়? পরস্পরের দিকে তাকাতে হবে। শর্তযুক্ত সংলাপ নয়, নিঃশর্তভাবে সংলাপে বসে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। বর্জন বা প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনো রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। হরতাল-অবরোধের মতো ধ্বংসাত্মক কোনো কর্মসূচি দিয়েও এখন দাবি আদায় করা সম্ভব নয়। যে কোনো চরমপন্থা পরিত্যাগ করে সরকার এগিয়ে আসুক, বিরোধীপক্ষ এগিয়ে আসুক, নির্বাচন কমিশন এগিয়ে আসুক- সবাই মিলে জনগণকে একটি অবাধ, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও উৎসবমুখর নির্বাচন উপহার দিক- এটাই এখন সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা।

আলী রেজা: পিএইচডি গবেষক, ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :