দ্রব্যমূল্যের থাবা শাবিপ্রবির ডাইনিং-ক্যান্টিনে, বিপাকে শিক্ষার্থীরা
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে পাল্টে গেছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন খাবারের রুটিন। বেড়েছে হলের ডাইনিং ও ক্যান্টিনের খাবারের দাম।
এর ফলে ডাইনিং ও ক্যান্টিনের পরিচালকরা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ইচ্ছেমতো খাবারের মূল্য রাখছেন। এসব নিয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে একাধিকবার অভিযোগ দেওয়া হলেও কোনো সমাধান হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেদের জন্য রয়েছে শাহপরাণ হল, বঙ্গবন্ধু হল ও সৈয়দ মুজতবা আলী হল। মেয়েদের জন্য রয়েছে প্রথম ছাত্রী হল, ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল, বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হল।
এসব হলে থাকেন প্রায় সাড়ে তিন হাজার শিক্ষার্থী। তারা নিয়মিত হলের ডাইনিং ও ক্যান্টিনে খাচ্ছেন। কিন্তু বর্তমানে হলের খাবারের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেকেই রান্না করে খাচ্ছেন, কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন কোনো মেসে মিল চালাচ্ছেন।
জানা গেছে, ছাত্রীদের তিন হলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খাবারের মূল্য রাখা হচ্ছে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে। এ হলের ডাইনিংয়ে (ভাত+ডাল+ নরমাল বা ছোটো মাছ/মুরগি/ডিম) ৪২ টাকা, (ভাত+ডাল+নরমাল মাছ) ৪৭ টাকা, (ভাত+ডাল+বড় মাছ) ৬৭ টাকা, আখনি ৪০ টাকা, খিচুড়ি ১৫ টাকা, ডিম ভাজি ১৮/২০ টাকা, সবজি ১০ টাকা ও ভর্তা ৭ টাকা মূল্যে পাওয়া যাচ্ছে।
অন্যদিকে বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের ডাইনিংয়ে (ভাত+ডাল+নরমাল মাছ/মুরগি) ৪৮ টাকা, (ভাত+ডাল+স্পেশাল মাছ/মুরগি) ৫৩ টাকা, খিচুড়ি ২০ টাকা, ডাল ১০ টাকা, ডিম ১৮ টাকা, রুটি ৫ টাকা ও চা ১০ টাকায় পাওয়া যায়। এছাড়া প্রথম ছাত্রী হলের ডাইনিংয়ে সর্বনিম্ন ২৫ টাকায় খাবার পাওয়া যায় বলে জানিয়েছেন ছাত্রীরা। ফলে অধিকাংশ ছাত্রী প্রথম ছাত্রী হলের ডাইনিংয়ে খাবার খেতে আসেন বলে জানা গেছে।
এদিকে ছাত্রদের তিনটি হলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খাবারের মূল্য রাখা হচ্ছে সৈয়দ মুজতবা আলী হলে। এ হলে (ভাত+মুরগি) ৫০ টাকা, (ভাত + রুই মাছ) ৪৫ টাকা, (ভাত +পাবদা/লাছু মাছ) ৩৫ টাকা, (ভাত +মুড়ি ঘোন্ট) ৩০ টাকা, ভাজি ১০ টাকা, খিচুড়ি ১৫ টাকা, ডিম ভাজি ২০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে।
অন্যদিকে শাহপরান ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের ডাইনিংয়ে (ভাত+নরমাল মাছ/মুরগি/মুড়িখন্ড) ২৫ টাকা, (ভাত +স্পেশাল মাছ) ৪০ টাকা, (ভাত+মুরগি) ৬০ টাকা, (ভাত + ডিম) ৩০ টাকা, খিচুড়ি ১০ টাকা, ডিম ভাজি ১৫ টাকা, ঘন ডাল ৫ টাকা মূল্যে পাওয়া যাচ্ছে।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খাবারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে মাত্র দুইবেলা খেয়ে দিন পার করছেন অনেকেই।
সৈয়দ মুজতবা আলী হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ফাহিম (ছদ্মনাম) বলেন, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনের ছয় মাস পার হয়েছে। পারিবারিক আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে প্রথম থেকেই হলের গণরুমে উঠি। পাশাপাশি একটি টিউশন করাই। এ টাকা দিয়ে একাডেমিক খরচের পাশাপাশি দৈনন্দিন খাবার খেতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একই হলের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ক্লাস না থাকলে সকালে ঘুম থেকে দেরি করে ওঠা হয়। যাতে সকাল বেলার মিলরেট বেঁচে যায়। শুধু দুইবেলাতেই দিনাতিপাত। তাছাড়া আমাদের হলে (সৈয়দ মুজতবা আলী) ডাইনিং ও ক্যান্টিনে অন্য হলের তুলনায় খাবারের দাম বেশি। এটি আমাদের আরও বেশি ভোগাচ্ছে।
বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের একাধিক ছাত্রী বলেন, হলের ডাইনিং ও ক্যান্টিন দুটির অবস্থাই নাজুক। খাবারের মান খুবই খারাপ। প্রতিদিন একই ধরনের খাবার, বাজারের সবচেয়ে সস্তা মাছগুলা মনে হয় এখানে আনা হয়। এছাড়া অপরিষ্কার খাবার পরিবেশন করার অভিযোগ রয়েছে সিরাজুন্নোসা ও প্রথম ছাত্রী হলের ডাইনিং ও ক্যান্টিনের পরিচালকের বিরুদ্ধে।
ছাত্রীরা বলেন, নিম্নমানের খাবারের কারণে হলের খাবারে প্রতিনিয়ত পোঁকা পাওয়া যায়। এছাড়া খাবার তৈরি থেকে পরিবেশন পুরো প্রক্রিয়াতে যথাযথ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অনুসরণ করা হয় না।
আরও এক বছর আগেও সিলেটের এই শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে সাশ্রয়মূল্যে খাবার পাওয়া যেত। একবেলায় ২০ টাকায় ভাত, ডাল, ভর্তা, যেকোনো একটি সবজি কিনে খুব আয়েশে খাওয়া যেত। এই ৭ থেকে ৮ মাস ধরে দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধিতে তা চিন্তাই করা যায় না। এখন প্রতিবেলায় কমপক্ষে-৫৫/৬০ টাকার প্রয়োজন হয়।
বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. চন্দ্রানী নাগ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘সব অভিযোগ শুধু সাংবাদিকদের কাছেই যায়। এখন পর্যন্ত কেউ আমার কাছে অভিযোগ করেননি। এটা নিয়ে আমি শুক্রবার আবার বসবো।’
সৈয়দ মুজতবা আলী হলের প্রভোস্ট ড. মো. আবু সায়েদ আরেফিন খান বলেন, ‘হল অফিস থেকে একটা দাম নির্ধারণ করে দিলে তা বেশিদিন মানা সম্ভব হয় না। কারণ দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ডাইনিং কর্তৃপক্ষকে দাম পরিবর্তন করতে হয়। এছাড়া হলগুলোতে প্রায় ২০ হাজার টাকা ভুর্তকি দেয়া হয়। শিক্ষার্থীদের কথা ভেবে আমরা সামনে ডাইনিং স্টাফদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে নিয়োগ দেব। এটা শেখ ফজিলাতুন্নেছা হলে বাস্তবায়ন হয়েছে। সেখানে পাঁচজন ডাইনিং স্টাফ নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তখন খাবারের দাম আরও কিছু কমানো সম্ভব হবে।’
খাবারের পুষ্টি নিয়ে ফুড ইঞ্জিনিয়ার অ্যান্ড টি টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মোজাম্মেল হক বলেন, ‘যখন নিম্নমানের ও নিয়মিত একই ধরনের খাবার দেওয়া হয়, সেক্ষেত্রে তো শিক্ষার্থীদের পুষ্টির যথাযথ চাহিদা পূরণ হবে না। তখন এটা তাদের শারীরিক, মানসিক ও একাডেমিক পড়াশোনায় প্রভাব পড়ে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মেধাবী। মেধার যোগ্যতা দিয়ে তারা এখানে এসেছে। তাই এসব প্রতিকূলতা শিক্ষার্থীরা কাটিয়ে উঠতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমান দ্রব্যমূল্যের কারণে এসব প্রতিকূলতা শিক্ষার্থীরা মানতে বাধ্য। তবে ভালো খাবার পেলে শিক্ষার্থীরা যে ভালো ক্যারিয়ার গড়তে পারে, সে উদাহরণ আমাদের শিক্ষার্থীরা দিয়ে যাচ্ছে। কারণ তারা যখন বাইরে যায়, তখন ভালো মানের খাবার পাচ্ছে। যার ফলে তারা ভালো ক্যারিয়ারও গড়তে পারছে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেশ ও নির্দেশনা পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. রাশেদ তালুকদার ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে আমরা হলগুলোতে সর্বনিম্ন মূল্যের খাবার রেখেছি। পাশাপাশি তারা আরও ভালো মানের খাবার খেতে চাইলে বেশি টাকা দিয়ে খেতে পারবে। আমরা এই সুযোগটাও রেখেছি। হলগুলোর যথাযথ ব্যবস্থাপনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এককালীন ভর্তুকি দিয়ে থাকি। তাছাড়া হতদরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা একটা ফান্ড রয়েছে। যা শিক্ষার্থীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে দেয়া হয়ে থাকে।’
উল্লেখ্য, ১২ নভেম্বর থেকে খাবারের দাম কমানো ও মানবৃদ্ধি নিয়ে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. চন্দ্রানী নাগ বরাবর একাধিক অভিযোগ দিয়েছেন হলটির আবাসিক ছাত্রীরা। এ নিয়ে একটি অভিযোগপত্র এই প্রতিবেদকের হাতেও এসেছে।’
(ঢাকাটাইমস/০১ডিসেম্বর/জেডএম/এজে)