তিন মসজিদের মোড়

সাইমুম সোহরাব
  প্রকাশিত : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১১:৫৬| আপডেট : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১১:৫৮
অ- অ+

প্রতিদিনই ভোরে নিয়ম করে ঘুম থেকে জাগতে হয়। রাজ্যের আলস্য এসে আঞ্জাইয়া ধরে ভোরেই। সকাল সাতটা থেকে টানা পাঁচটা পর্যন্ত কাজ। এগারোটার দিকে পনেরো মিনিটের হালকা নাস্তাবিরতি। যা সিগারেট ধরাতে ধরাতেই শেষ! কোনোদিন একটা আধপাকা বাংলা কলার সাথে একটা কাঠগজা। কোনোদিন পোঁতানো একটা শুকো রুটির সাথে দলকঁচা সাগরকলা। কোনো কোনোদিন বছরব্যাপী একই সয়াবিনে ভাজা তেতো শিঙাড়া, সমুচা। সুবিধা হলো, ‘খিদা চিনে না হুদা’। সেদিন, মাসুদা বলছিল- ‘স্যার বাসার কতা মুনে হইলে ডর লাগে। যদি আপ্নেগো এহানে, রাস্তায়ও ঘুমাইতে পারতাম! একফোঁটা বাতাসও ঢুকে না। মশা গিজগিজ করে। একটা ছোট্ট রুমে চাইরজন থাকি। দিনের বেলায়ও লাইট জ্বালাইয়া রাখন লাগে।’ সৌরভ শুনেও, না শোনার ভান করে। কারটা শুনবে! হাজারে হাজার মাসুদা এখানে। সপ্তাহে একদিন ছুটি। ছুটিটা না হলেই বরং ভালো হতো। তিন-তিনটা মসজিদের মাঝখানে সৌরভের বাসা। একটা থেকে আরেকটার দূরত্ব বড়োজোর চারশ থেকে পাঁচশ হাত।

আড়াই বছরের মেয়ে সায়রা সারাক্ষণ কান্না করে। কোনো অসুখই ডাক্তার ধরতে পারছেন না। বৃদ্ধা অসুস্থ মা। প্রেসার ও অন্যান্য বার্ধক্য রোগাক্লিষ্ট। পাঞ্জেগানা নামাজি। সৌরভের শুক্রবারে খুব ঘুমাতে ইচ্ছে করে। সপ্তাহে একদিনই তো। হাড়গুড় ভেঙে আসে যেন ঘুমে। তানিয়াও চায় সৌরভ ঘুমাক। প্রতিটা মসজিদেরই চারটা-পাঁচটা করে হাই ভলিউমের লম্বা চোক্কা মাইক। চারদিক থেকে এমনভাবে আজান পড়ে, যেন ঘরের চাল পর্যন্ত উড়ে যাবে। মা কঁকিয়ে-কাঁকিয়ে ওঠেন। ফজরের নামাজ পড়েন। মা-ও খুব চান সৌরভের যেন ঘুম না ভাঙে। নামাজ শেষ হয়। এবতেদায়ির ছোটো ছোটো বাচ্চা তারস্বরে চিল্লিয়ে বিভিন্ন সুরা তেলাওয়াত করে। হিন্দি-উর্দু-বাংলা মিলিয়ে হামনাত গায়, এগারোটা-বারোটা পর্যন্ত। কিছু বোঝা যায়, কিছু কিছুই বোঝা যায় না। ধর্ম তো বোঝার না, মানার। জানার না, জানানোর। সোয়া বারোটা/সাড়ে বারোটায় আজান হয়। তিন মসজিদের মাঝে যাদের বাসা তারা জানে। সৌরভ জানে। দোকানদার রাফিজ জানে। মনু নাপিত জানে। শাওন বড়ুয়া জানে। সৌরভের পাঞ্জেগানা মা কাঁপে থত্থর করে। প্রেসার বাড়ে। নাকে মুখে রক্ত আসে। আল্লা আল্লা করেন। তানিয়া প্রেসারের ওষুধ দেন।

সূর্যদীঘল এ বাড়ির উত্তর পাশের ফ্ল্যাটে তাদের বাসা। গুমোট গরম। দক্ষিণের বাতাস তারা পায় না। সপ্তাহে একদিন হাড়িকুড়ি বোতল ডিব্বা ভরে রাখে ওয়াসার পানিতে। দুই দিনেই সে পানি শেষ হবার কথা! সেই পানিটুকু দিয়েই তানিয়া টেনেটুনে সপ্তাহ পার করে। লাইনের লবণপানি মুখে দেওয়া যায় না। তারপরেও পরিষ্কার নয়। নীলচে আর দুর্গন্ধময়। ইমাম সাব আসেন। উর্দু-হিন্দি-বাংলা-ইংরাজি মিলিয়ে গজল গান। আরেক মসজিদের ইমাম মসজিদে গান গাওয়া বেদাত বলেন। অন্য মসজিদের ইমাম তারস্বরে চিল্লিয়ে বলেন, আল্লা গো এমন শুক্রবার পেয়েও যারা মসজিদে আসলো না, তাদের তুমি ক্ষমা করো না। তিন মসজিদের ইমাম যখন একত্রে ওয়াজ ফরমান, তখন তা শুনতে কীসের মতো লাগে সৌরভ ভাবতে পারে না। সায়রা কাঁদে। তানিয়া কাঁদে। মা কাঁপে। তানিয়া সৌরভের পাজামা পাঞ্জাবি বের করে রাখে। বাথরুমে ঢুকে তার মাসুদার কথা মনে হয়।

মনে হয় সত্যিই তো, সাপ্তাহিক এই ছুটিটা বরং না থাকলেই ভালো হতো। সাধারণত দুইটা/আড়াইটার দিকে নামাজ শেষ হয়। মসজিদে মানুষ ধরে না। ছাদে, রাস্তায়, দোকানে, ফুটপাতে মুসল্লিদের ভিড়। এক শুক্রবার সৌরভ মাকে নিয়ে গেছিল ডাক্তারের কাছে। ফেরার সময় মুসল্লিদের ভিড়ে আর কারো কারো বাঁকা চোখের চাহনি ঠেলে ঢুকতে সাহস হয়নি। মা একটা ঘুণ্টি দোকানের সামনের আধভাঙা বেঞ্চিতে বসে আল্লা আল্লা করলেন আড়াই ঘণ্টা। কোনোদিন আমেরিকা/ডুবাই প্রবাসী কেউ একটা এসি/৫০ হাজার টাকা দান করেছেন তার মাগফেরাত কামনা করে মিলাদ। কোনোদিন মসজিদ কমিটির সহসভাপতি সাবের শালির ভাগ্নি মারা গেছেন তার মিলাদ। কোনোদিন শানে রসুলের দরুদ। বাসা চেঞ্জ করার কথা ভেবেছে সৌরভ। কিন্তু অফিসের কাছে এমন একদিনের-দেড়দিনের ওয়াসার পানি পাওয়া যায় এমন বাসা পাওয়া দুষ্করই। আড়াই রুমের এই বাসাটা খুব বেশি হলে সাত/আট হাজার টাকা ভাড়া হওয়াই আইনসংগত। আইনসংগত কথাটা ঠিক নয় বোধহয় ... ভাবে সৌরভ। আইন কই যে তার আবার সংগত! সেদিন পাশের বাসার মামুন ভাই বলছিলেন, তার মেয়েটার এসএসসি পরীক্ষা। রুহুল আমিন ভাই বলছিলেন, বাসায় তার আম্মা অসুস্থ। কাকে কী বলা যায়! কী এক গুমোট দমবন্ধ অবস্থা। ঈমাম সাব একজন হাফেজ। একজন কামেল। অন্যজন ফাজেল। কে কত জোরে, কত রকমের আজগুবি, ভয়ংকর আর অন্যধর্মের কুৎসা করা যায় তার প্রতিযোগিতা করে। হাফেজ সাব রমজানের সময় যেভাবে দ্রুত খতমে কুরআন হয়, ঠিক সেভাবে দ্রুত বাংলা ওয়াজও করেন। যখনই ঠেকে যান তখনই হিন্দি-উর্দুর গান তারস্বরে চিল্লিয়ে গেয়ে ওঠেন। আরও দূর থেকে আরও অনেক মসজিদের চিকন মিহি সুর ভেসে আসে।

সৌরভ সেদিন মাঝারি মসজিদের সামনে দিয়ে আসছেন। কীসের এক মিলাদ যেন হচ্ছে। কয়েকজন হাফেজ। কয়েকজন শিক্ষানবিশ হাফেজ। কয়েকজন এবতেদায়ির গুড়া পুলাইপান। তারস্বরে চিল্লাচ্ছেন। একজন হয়তো ক্লান্ত হয়ে ওই সময়ই বাইরে এসে একটু হাঁটাহাঁটি করছিলেন। সৌরভ অতিশয় বিনীত হয়ে, কথা যতটা নরম করা যায় তার চেয়েও নরম করে হাফেজ সাবকে লম্বা করে সালাম দিয়ে বললেন, হুজুর বাসায় মা অসুস্থ। অন্য বাসার অনেকের বাচ্চাদের পরীক্ষা, মাইকের সাউন্ড একটু কমিয়ে, অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যায় না? হাফেজ সাব বৈদেহিক কিছু অঙ্গভঙ্গি আর ভাবসাব দেখিয়ে বললেন, আপনাদের কর্ণকুহরে যতটা জোরে এসব ঢুকবে শয়তান ততটা জোরে এলাকা ছাড়া হবে। যাত্রাগান, পালাগান, বিয়েরগান, ডিসকোগান যখন হয়, তখন আপনাদের বাচ্চাদের পরীক্ষা, আম্মা-আব্বার অসুখ কোথায় যায়? সৌরভ মাথা ততোধিক নুইয়ে বাসায় চলে আসে; এরপর তার মনে হলো, মাইকের সাউন্ড আগের চাইতে এখন একটু বেশিই। বড়ো মসজিদের কামেল সাব আর ছোটো মসজিদের ফাজেল সাব তারাও বিভিন্ন মূল্যের মিলাদ পড়ান। তানিয়া, সায়রার কান্নাকাটির জন্যে একবার হুজুর দিয়ে মিলাদ পড়াতে চাইলে সৌরভ গিয়েছিল সব হুজুরের কাছেই। তারা কত টাকার মিলাদ পড়াবেন, তা কয়জনে পড়বে, কতটুকু সময় ধরে পড়াবেন- এসবের উপর খরচগুলোর যে পার্থক্য নির্ভর করে তা তাকে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলেছিলেন। অবশ্য সৌরভের আর সায়রার জন্য মিলাদ পড়ানো শেষ পর্যন্ত হয় নাই। সায়রা এখনও কাঁদে। আমরা সবাই তো কমবেশি কাঁদছিই, কাঁদুক না সায়রাও। গুমোট দমবন্ধ হয়ে আসা কান্নার প্লাবন হোক।

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
ওপারে কারফিউ, সুনামগঞ্জের ১২ কিলোমিটার সীমান্তে বিজিবির সতর্ক অবস্থান
খালিশপুরে শহীদ মিনারের জমি দখলের ভিডিও করায় সাংবাদিকদের ওপর হামলা
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের ঘোষণায় শাহবাগে ছাত্র-জনতার উল্লাস
৩০ কার্যদিবসের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশের সিদ্ধান্ত
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা