শবে বরাত উদযাপন: বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের ইতিহাস

​​​​​​​ঢাকা টাইমস ডেস্ক
| আপডেট : ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০১:২২ | প্রকাশিত : ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২৩:১৫

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বেশ ঘটা কর শবে বরাত পালন করার রেওয়াজ আছে বহুকাল ধরে। তবে শবে বরাতের সময় যেসব আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হয় সেগুলো নিয়ে বিভিন্ন সময় নানা বিতর্ক দেখা যায়। শবে বরাত পালন করা উচিৎ কী না, ইসলাম ধর্মে শবে বরাতের কোনো তাৎপর্য আছে কী না, বা শবে বরাতের কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে কী নাএসব নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক-বিতর্ক চোখে পড়ে।

ধর্মীয়ভাবে শবে বরাতের তাৎপর্য কতটুকু আছে সে বিষয়টি লেখায় আলোকপাত করা হয়নি। এর মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে শবে বরাতের আচার-অনুষ্ঠানগুলো দক্ষিণ মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে কীভাবে কেন প্রচলন হয়েছিল।

সূত্রপাত কখন?

ইসলামের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করা ব্যক্তিদের মতে মুসলিমদের মধ্যে শবে বরাত পালনের প্রথা শুরু হয় ইসলাম ধর্মের উৎপত্তির সময় থেকেই।

নবী হযরত মুহাম্মদ শাবান মাসের ১৪ তারিখ যে সারা রাত নফল নামাজ পড়তেন কবরস্থান জিয়ারত করতেন, তা অনেক হাদিসেই বর্ণিত রয়েছে। পনের দিন পর রমজান মাস শুরুর প্রস্তুতি হিসেবে তিনি এই আচার পালন করতেন এবং তার অনুসারীদেরও পালন করতে বলতেন”, বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস সংস্কৃতি বিষয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ ইব্রাহিম।

তার মতে, নবী মুহাম্মদের সময়কাল এবং তার পরবর্তী সময়ে আরব থেকে ইসলাম প্রচারে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে যারা সফর করেছেন, তাদের মাধ্যমেই বিশ্বের বিভিন্ন এলাকার মানুষের মধ্যে শবে বরাত পালনের আনুষ্ঠানিকতার বিষয়টি ছড়িয়ে পড়ে। আর এই আনুষ্ঠানিকতাকে উৎসব হিসেবে বিবেচনা করা হতো বলে ধীরে ধীরে এই দিনে ভালো খাবার তৈরি খাবার বিতরণের মাধ্যমে আনন্দ ভাগ করে নেয়ার প্রথা তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন ইব্রাহিম।

উপমহাদেশে যেভাবে ছড়িয়েছে

ভারতীয় উপমহাদেশে শবে বরাত পালনের চল কবে থেকে শুরু হল সে বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। এই অঞ্চলে শবে বরাত পালন সংক্রান্ত সবচেয়ে পুরনো নথি পাওয়া যায় খাজা শামসুদ্দিন মিরার লেখায়। চীনের উইঘুর অঞ্চলের কাসগারে জন্ম নেয়া খাজা শামসুদ্দিন ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বর্তমান ভারতের উত্তর প্রদেশের মুরতাজাবাদে আসেন এবং সেখানেই থেকে যান।

ইরানের ইয়াজদ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্বের অধ্যাপক মোহসেন সাইদি মাদানি তার ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত গবেষণা ধর্মী বইইমপ্যাক্ট অব হিন্দু কালচার অন মুসলিমসবইয়েও উল্লেখ করেছেন যে দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ভারতীয় উপমহাদেশে শবে বরাতে হালুয়া-রুটি তৈরি বিতরণের প্রমাণ পাওয়া যায়।

খাজা শামসুদ্দিনের লেখার বরাত দিয়ে মোহসেন সাইদ মাদানি তার বইয়ে লিখেছেন: “দিল্লির সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের আমলে শবে বরাত যে জৌলুসপূর্ণভাবে আয়োজিত হত, তার প্রথম দলিল পাওয়া যায় শামসুদ্দিন মিরার লেখায়।

পরবর্তীতে অষ্টাদশ-উনবিংশ শতকে শাহ ইসমাইল শহিদ, শাহ ওয়ালিউল্লাহ আর মৌলভি সৈয়দ আহমেদ দেহলভীর লেখায় শবে বরাত পালনের বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায় বলে উঠে এসেছে মি. মাদানির লেখায়।

সেসময় হালুয়া-রুটি বিতরণের পাশাপাশি আতশবাজি পুড়ানো আলোকসজ্জার ব্যবস্থাও করা হত বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। পূর্বোক্ত লেখকদের বরাত দিয়ে তিনি উল্লেখ করেছেন যে শবে বরাতের আলোকসজ্জা আতশবাজি পুড়ানোর বিষয়টি হিন্দুদের দ্বীপাবলি উৎসব থেকে নেয়া হতে পারে।

তবে ইসলামিক ইতিহাসের অধ্যাপক মোহাম্মদ ইব্রাহিম মনে করেন উপমহাদেশে শবে বরাত পালনের চল অষ্টম শতক থেকেই শুরু হয়েছে, যখন থেকে ইসলাম প্রচারে মধ্য এশিয়া আরব থেকে উপমহাদেশে মুসলিম ধর্ম প্রচারকরা এসেছেন।

ত্রয়োদশ শতকে কুতুবুদ্দিন আইবেক, বখতিয়ার খিলজী দিল্লিতে সালতানাত প্রতিষ্ঠা করার পর উপমহাদেশে রাজনৈতিকভাবে ইসলাম ছড়িয়ে পরে। কিন্তু ৭১২ সালে মোহাম্মদ বিন কাসেম মুলতান আর সিন্ধ জয় করেন। সেটি ছিল উপমহাদেশে ইসলাম ছড়িয়ে যাওয়ার শুরু।"

"এছাড়া আরব, চীনা বণিকরা সাগরপথে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে এই অঞ্চলে এসেছেন। তাদের মাধ্যমেও উপমহাদেশে ইসলাম ছড়িয়েছে এবং ইসলামিক রীতি-রেওয়াজও মানুষের কাছে পরিচিত হয়েছে,” বলেন অধ্যাপক ইব্রাহিম।

আতশবাজি হালুয়া-রুটির প্রচলন

বাংলাদেশের, বিশেষ করে ঢাকার মানুষ শবে বরাত বলতে মানুষ বুঝতো এমন একটি দিনকে যেদিন সবার ঘরে ঘরে হালুয়া তৈরি করা হবে তা বিতরণ করা হবে আত্মীয়-স্বজন নিম্ন আয়ের মানুষের মাঝে। মসজিদে মসজিদে সারারাত জিকির করা বা নামাজ পড়ায় ব্যস্ত থাকবে পুরুষরা। আর সন্ধ্যার পর পোড়ানো হবে আতশবাজি। শবে বরাতে এই আতশবাজি পোড়ানো আলোকসজ্জা করার রীতি কয়েকশ বছরের পুরনো।

ভারতীয় ইতিহাসবিদ রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিদ্যাধর মহাজন তারহিস্টরি অব মিডিইভাল ইন্ডিয়ানামে বইয়ে লিখেছেন, দিল্লির সুলতানদের আমলে এবং মোঘল আমলে শবে বরাতের রাতে বাদশাহদের প্রাসাদ মসজিদ আলো দিয়ে সাজানো হত।

মোঘল আমলে শবে বরাত পালনের এই চিত্র উঠে এসেছে পার্বতী শর্মারজাহাঙ্গির: অ্যান ইনটিমেট পোর্ট্রেট অব গ্রেট মোঘলবইয়েও, যেখানে সম্রাট জাহাঙ্গিরের আমলে (১৬০৫-১৬২৭) শবে বরাত উদযাপনের সময় হালুয়া মিষ্টি জাতীয় খাবার বিতরণ আলোকসজ্জা করা হত বলে লিখেছেন তিনি।

১৮৮০ সালে প্রকাশিত বৃটিশ পাদ্রী এডওয়ার্ড সেলের লেখা বইফেইথস ইন ইসলামেউঠে আসে যে সেসময় আতশবাজির পেছনে বিপুল পরিমাণ খরচ করা হত। এডওয়ার্ড সেল ১৮৬৫ সাল থেকে তৎকালীন ভারতবর্ষের মাদ্রাজে পাদ্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

অন্যদিকে, হালুয়া তৈরি করে আত্মীয় স্বল্প আয়ের মানুষের মাঝে বিতরণ করার সাথে উৎসবের আনন্দ ভাগ করে নেয়ার সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে করেন ইসলামের ইতিহাস সংস্কৃতির অধ্যাপক মোহাম্মদ ইব্রাহিম। তিনি বলছিলেন, “আমরা জানি যে রাসুলুল্লাহ সা. মিষ্টি খুব পছন্দ করতেন। তার পছন্দের জিনিসকে উম্মতরা পছন্দ করবেন, সেটাও তাকে পছন্দ করার একটা ধরন। ফলে মিষ্টি হিসেবেই হালুয়া বানানোর প্রচলন শুরু, কারণ হালুয়া বানানোর উপকরণ এই অঞ্চলে রয়েছে।

আর আনন্দের ভাগ অন্যদের দেয়ার জন্য বিতরণের রেওয়াজ তৈরি হয়েছে। এর সাথে ধর্মীয় অনুভূতি আর সামাজিকতা রক্ষাদুটো বিষয়ই জড়িত রয়েছে।

বাংলাদেশে যেভাবে প্রচলন হলো

বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডে শবে বরাত পালনের সবচেয়ে পুরনো প্রমাণ পাওয়া যায় উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, প্রায় দেড়শো বছর আগে। সেসময় ঢাকার নবাবরা ঘটা করে শবে বরাত পালন করতেন বলে বলছিলেন ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন, যিনি বাংলাদেশের উৎসবের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেছেন বই লিখেছেন।

মুনতাসীর মামুন বলেন, সে সময়ে হিন্দুদের আধিপত্য থাকার কারণে সেটিকে মোকাবেলা জন্য ঢাকার নবাবরা শব--বরাতের জন্য অনেক বড় আয়োজন করতেন। এতে ঢাকার নবাবদের মুসলমান পরিচয় এবং আধিপত্য - দুটো বিষয় একসঙ্গে তুলে ধরার প্রয়াস দেখা যেত।

মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘নবাবরা যেহেতু মুসলিম ছিলেন এবং ঢাকাকে তারা নিয়ন্ত্রণ করতেন, সেজন্য উৎসবগুলোকে তারা গুরুত্ব দিতেন। এর মাধ্যমে নবাবদের আধিপত্য, মুসলমানদের আধিপত্য এবং ধর্ম পালন এই তিনটি বিষয় একসাথে প্রকাশ হতো।

১৯' শতকের শেষের দিকে ঢাকায় শবে বরাত পালন মুসলিম পরিচয় প্রকাশের বিষয় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। এমনটাই বলছেন অধ্যাপক মামুন। সেই ধারাবাহিকতায় শবে বরাত একটি বড় ধরনের উৎসবে পরিণত হয়েছে।

তবে মোহাম্মদ ইব্রাহিমের মতে আরো আগে থেকেই বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডে শবে বরাত পালন হয়ে আসছে। তিনি বলেন,আরব আর চীনা বণিকরা যখন সাগরপথে ব্যবসা করতে আসতো, তখন চট্টগ্রাম অঞ্চলে তাদের জাহাজ ভিড়তো। সেসময় তাদের অনেকেই এখানে থেকে যেতেন। তাদের মাধ্যমে ইসলামিক রীতি-রেওয়াজের সাথে সেখানকার মানুষের পরিচয় হয়েছিল।

মোহাম্মদ ইব্রাহিমের মতে ঢাকার নবাবরা জাঁকজমকের সাথে শবে বরাত পালন করলেও তারও কয়েকশোবছর আগে থেকেই বাংলাদেশ ভূ-খণ্ডের মানুষ এই রেওয়াজের সাথে পরিচিত ছিল। -বিবিসি

(ঢাকাটাইমস/২৫ফেব্রুয়ারি/কেএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

জাতীয় এর সর্বশেষ

উড়িষ্যা উপকূল অতিক্রম করেছে নিম্নচাপ, সমুদ্র বন্দরে সতর্ক সংকেত নেই

শিগগির সব বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, শিক্ষাক্রমে আপাতত পুরনো বই ও পরীক্ষা: শিক্ষা উপদেষ্টা

বন্যা মোকাবেলায় ক্যাম্পের সংখ্যা বাড়াল সশস্ত্র বাহিনী

৮ হাজার কোটি টাকার কেন্দ্রে বিদ্যুৎ নেই, এটাই উন্নয়নের বিভ্রান্তি: জ্বালানি উপদেষ্টা

উজানের দেশগুলোর কাছে বন্যা পূর্বাভাসের তথ্য চাওয়া হবে: পানিসম্পদ উপদেষ্টা

সিএমএইচগুলোতে চিকিৎসাধীন ছাত্রদের মধ্যে বাড়ি ফিরেছে ৬১০ জন

শিগগির সরকারের রূপরেখা প্রকাশ

পুলিশের লুট হওয়া আরও ৫৬৮ অস্ত্র উদ্ধার

জাতিসংঘে আইসিপিপিইডিতে প্রবেশাধিকারের দলিল জমা দিলো বাংলাদেশ

বন্যায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৫৯

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :