বাংলা ভাষা ও শিল্প-সাহিত্যে ফাগুনের রূপবন্দনা

আলী রেজা
 | প্রকাশিত : ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১১:৪৬

প্রকৃতি বা নিসর্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতির শুধু প্রধান উপাদানই নয়; সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ ও নান্দনিক করে তোলে প্রকৃতি তার নিজস্ব রূপমাধুরী দিয়ে। তাই সব দেশের সব কালের শিল্প, সাহিত্য ও সংষ্কৃতিতে দেখা যায় প্রকৃতির প্রাণপ্রাচুর্যময় উপস্থিতি ও রূপবন্দনা। ঋতুরূপে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত- সব ঋতুই আসে সাহিত্যে। আবার মাস হিসেবে আসে বৈশাখ থেকে চৈত্র পর্যন্ত সকল মাস। মাস হিসেবে ফাগুন সাহিত্যপ্রেমীদের সবচেয়ে বেশি আরাধ্য মাস। এ মাস প্রকৃতিপ্রেমী সকল মানুষকে আলোড়িত করে। ফাগুনের এই রূপের প্রভাব পরিহার করতে পারে না কোনো প্রকৃতিপ্রেমী কবি। নীরবতা ভাঙার এই ফাগুন আসে বসন্তের অর্ধাঙ্গিনী হয়ে। ফাগুন আর বসন্ত প্রকৃতিকে যেমন সাজায় তেমনি কবিমনকেও সাজিয়ে তোলে। তখন কবি নড়েচড়ে বসেন ফাগুন আর বসন্তের রূপ-বন্দনায়। ‘হে কবি, নীরব কেন- ফাগুন যে এসেছে ধরায়/ বসন্তে বরিয়া তুমি লবে নাকি তব বন্দনায়?’ কবি সুফিয়া কামালের এ প্রাণের আহ্বান সকল কবি ও কবিতাপ্রেমী নর-নারীর প্রাণের বাসনা, প্রাণের আবেগকেই তুলে ধরে।

শীতের শুষ্কতা ও জীর্ণতা শেষে প্রকৃতিতে ফাগুন আসে। ফাগুন আসে গাছে গাছে ফুলের সমারোহ, পাখির কণ্ঠে গান আর রাখালিয়া বাঁশির সুর নিয়ে। ফাগুন আমাদের সাংষ্কৃতিক সংগ্রামের স্মারক। এই ফাগুনে আমরা ভাষা পেয়েছি। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলন এই ফাগুনকে করে তুলেছে ইতিহাসের গৌরবময় অধ্যায়। পলাশ-শিমুল ফোটার এই ফাল্গুন আমাদের ভাষাপ্রেমকে সংগ্রামী করে তুলেছে। আমরা দলে দলে কারাবরণ করেছি। ‘আরেক ফাল্গুন’ উপন্যাসে জহির রায়হান বলে গেছেন ‘আসছে ফাল্গুনে আমরা দ্বিগুণ হবো।’ সেটা ছিল ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট। প্রকৃতিপ্রেমের প্রেক্ষাপটে প্রতিটি ফাগুনে আমরা মনের সঙ্গে মন মিলিয়ে দ্বিগুণ হয়ে উঠি।

ঋতুরাজ বসন্তের প্রথমার্ধ হলো ফাগুন। ফাগুনের সাথে আগুন শব্দটি মিলেছে সাহিত্য ও সংগীতে। গানের ভাষায় বলা হয়- ‘এই ফাগুনের বুকের ভেতর আগুন আছে।’ তবে এ আগুন পোড়ায় না। এ আগুন আলো হয়ে ভরিয়ে তোলে মন-প্রাণ। এ আগুন পলাশ-শিমুল-কৃষ্ণচূড়ার লাল রঙ। গাছে গাছে রক্তরঙ পলাশ আর শিমুল ফুলের সমারোহ ফাগুনেরই দান। ফাগুনের রঙ শুধু প্রকৃতিকে রাঙিয়ে তোলে না; প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের মনকেও রাঙিয়ে তোলে। তাই ফাগুন নিয়ে রচিত হয় কত কবিতা, কত গান! কোকিলের কুহুতান যেন প্রিয়মিলনের আহ্বান। ঝিরঝির বাতাসে পাতা ঝরার দৃশ্য আর শুকনো পাতার মর্মর ধ্বনি মনকে করে তোলে উদাস। অনুপম এই ফাগুনের আগুনলাগা বসন্তে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ শুনিয়েছেন বসন্তের গানÑ ‘আহা আজি এ বসন্তে/ এতো ফুল ফোটে/ এতো বাঁশি বাজে/ এতো পাখি গায়...।’

ফাগুনে প্রকৃতিতে বিচিত্র ফুলের সমারোহ ঘটে। আমের মুকুলের মৌ-মৌ গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে। ফুলে ফুলে মৌমাছিদের ভিড়। বসন্ত বাতাসে একাকার হয়ে যায় ফুলের গন্ধ আর পাখিদের গান। লোকসাহিত্য ও লোকসংগীতে প্রতিফলিত হয় সেই মাদকতাময় নিসর্গ আর মানবীয় প্রেমকথা- ‘বসন্ত বাতাসে সই গো, বসন্ত বাতাসে/ বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে/ সই গো বসন্ত বাতাসে।’ তাই বলা হয় বসন্তের প্রকৃতি প্রিয়মিলনের বার্তা বয়ে আনে। ফাগুনে প্রকৃতি আমাদের প্রাণের সঙ্গে প্রাণ আর মনের সঙ্গে মনকে মিলিয়ে দেয়। তখন আমরা প্রকৃতির সন্তান হয়ে যাই। প্রকৃতির মাঝে বিলিয়ে দেই নিজেকে। আমরা আত্মহারা হয়ে যাই। আমরা বাঁধনহারা হয়ে যাই। নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার এই সুখসুর অনাবিল প্রণয়বার্তা হয়ে ভেসে বেড়ায় ফাগুনের বাতাসে। আমরা গেয়ে উঠি- ‘ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান/ আমার আপনহারা প্রাণ আমার বাঁধনছেড়া প্রাণ...’ কিংবা ‘ফাগুনের-ই মোহনায়, মন মাতানো মহুয়ায়/ রঙ্গিনী বেহুর নেশা কোন আকাশে নিয়ে যায়...’ কিংবা ‘ফুলে ফুলে ডলে ডলে বহে কিবা মৃদু বায়/ তটিনী হিল্লোল তুলে কল্লোলে চলিয়া যায়।’ এই ফাগুনের গান আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির নিজস্ব সম্পদ।

আমাদের সাহিত্যে ফাগুন এসেছে নান্দনিক সৌন্দর্য নিয়ে। সাহিত্যের সকল শাখা ফাগুন তথা বসন্তের প্রভাবে হয়ে উঠেছে রঙিন। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক- সাহিত্যের সব মাধ্যমেই আছে বসন্তের সরব উপস্থিতি। বসন্ত যেন অতীতের সঙ্গে বর্তমান আর বর্তমানের সঙ্গে ভবিষ্যতের মেলবন্ধন। বর্তমানের কবি শতবর্ষ পরের কবিমনে স্থান করে নিতে শোনাতে চান বসন্তের গান। তাই কবি বলেন, ‘আমার বসন্তগান/ তোমার বসন্ত দিনে/ ধ্বনিত হোক ক্ষণ তরে।’ বাংলাসাহিত্যে অসংখ্য কবিতা ও গান রচিত হয়েছে ফাগুন ও বসন্তকে নিয়ে। শুধু গান ও কবিতা নয়; রচিত হয়েছে অনেক গল্প। ‘এক ফাগুনের গল্প’, ‘ফাগুনের ভালোবাসা’, ‘শেষ ফাগুনের গল্প’ কিংবা ‘মন ফাগুনের গল্প’ ইত্যাদি। ফাগুন নিয়ে আমাদের গল্পের শেষ নেই। বাংলা ভাষাভাষী গল্পপাঠকের মনের খোড়াক জোগায় ফাগুন। ফাগুন হয়ে ওঠে স্বপ্নগল্পের নির্মাতা।

শুধু গল্প নয়, ফাগুন নিয়ে বাংলা সাহিত্যে আছে অনেক উপন্যাস। ‘পৌষ ফাগুনের পালা’, ‘আরেক ফাল্গুন’, ‘ঢাকায় ফাগুন’, ‘ফাগুন বসন্তে’, ‘ঘাসেদের ফাগুন’, ‘ফাগুন হাওয়া’ প্রভৃতি উপন্যাসে মানব-মানবীর সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, প্রেম-প্রণয় মিশে গেছে ফাগুনের সাথে। গজেন্দ্রকুমার মিত্রের ‘পৌষ ফাগুনের পালা’ ও জহির রায়হানের ‘আরেক ফাল্গুন’ কালোত্তীর্ণ ও মানোত্তীর্ণ সাহিত্যকর্ম। মোশতাক আহমেদের ‘ফাগুন বসন্তে’ উপন্যাসটিও পাঠকের মন কেড়েছে। ফাগুন নিয়ে নির্মিত হয়েছে অনেক নাটক ও মেগা সিরিয়াল। ‘ফাগুনের প্রেম’, ‘মন ফাগুন’, ‘ফাগুনের মোহনা’, ‘ফাগুন বউ’, ‘কৃষ্ণচূড়ার দিন’ ও ‘ফাগুন রাতের গপ্পো’ দর্শকনন্দিত নাটক। দেখা যায় নাটক-সিনেমা, গল্প-উপন্যাস ও কবিতা-গান- সবখানেই ফাগুনের নান্দনিক উপস্থিতি। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির সকল শাখাকে সমৃদ্ধ ও সৌন্দর্যময় করেছে ফাগুন।

ফাগুন আর বসন্ত যখন হাত ধরাধরি করে প্রকৃতির কোলে নেমে আসে তখন তাদেরকে বরণ করে নিতে আমাদের সে কী ব্যস্ততা, সে কী ব্যাকুলতা! আমরা দুরন্ত ফাগুন গায়ে মেখে প্রিয়মিলনের অপেক্ষা করি। তখন অন্য কিছু নয়; শুধু মন ভরে প্রেয়সীকে খোঁজা। কবি তো বলেই ফেলেন- ‘শুধু আমাকে খুঁজো/ আমি তো দুরন্ত ফাগুন গোটা গায়ে মেখে/ তোমার জন্য বসে আছি (সুব্রত পাল)।’ ফাগুনের রঙ গায়ে মেখে আমরা ফাগুনের সঙ্গে মিশে যেতে চাই। মানুষ ও প্রকৃতির এমন মেলবন্ধন থেকেই সৃষ্টি হয় ফাগুনের নান্দনিক সাহিত্য।

বসন্ত যখন দরজায় কড়া নাড়ে তখন আমরা কুণ্ঠিত হয়ে তাকে যেন বিড়ম্বিত না করি- এ আহ্বান জানান স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ- ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে/ তব অবগুণ্ঠিত কুণ্ঠিত জীবনে/ কোরো না বিড়ম্বিত তারে।’ ফাগুনে প্রকৃতির পরিবর্তনের সাথে সাথে মানবপ্রকৃতির যে পরিবর্তন হয় তা অন্য কোনো সময় হয় না। এর কারণ মাঘের শীত ও শুষ্কতা আমাদের দারুণভাবে জড়োসড়ো করে দিয়ে যায়। সেই জড়োসড়ো অবস্থা থেকে ফাগুন আমাদের মুক্তি দেয়। ফাগুন এসে আমাদের মনোজগতকে বিকশিত করে, কুসুমিত করে। উষ্ণতা নিয়ে আমরা জেগে উঠি। মিশে যাই প্রকৃতির নতুন রূপ ও রঙের সাথে। নির্মিত হই নিসর্গের নতুন ছোঁয়ায়।

সাহিত্যের ভ্রুণ বেড়ে ওঠে ব্যক্তির মনোজগতে। ফলে যা কিছু ব্যক্তির মনোজগতকে আলোড়িত করে তাই হয়ে ওঠে সাহিত্যের উপাদান। নিসর্গের প্রেক্ষাপটে ঋতুরাজ বসন্ত আর বসন্তের প্রথমার্ধ ফাগুন ব্যক্তির মনোজগতকে সবচেয়ে বেশি আলোড়িত করে। ফলে ‘ফাগুন-বসন্ত’ কালপর্বটি গানে-কবিতায়, গল্প-উপন্যাসে জায়গা করে নেয় অনায়াসে। সাহিত্য ও সংস্কৃতির নন্দনতাত্ত্বিক দিকটিকে সমৃদ্ধ করে ফাগুন-বসন্ত। প্রকৃতির রূপে যখন নয়নে নেশা লাগে তখন সহজেই বোঝা যায়- বসন্ত এসে গেছে। হৃদয়ে তখন সুরের দোলা লাগে- ‘বাতাসে বহিছে প্রেম/ নয়নে লাগিলো নেশা/ কারা যে ডাকিলো পিছে/ বসন্ত এসে গেছে...।’ মানুষ ও প্রকৃতিকে একাকার করে দেওয়া এই বসন্ত, এই ফাগুন নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের আর এক নাম। আমি বেঁচে থাকি আর না থাকি, তুমি বেঁচে থাকো আর না থাকো ফাগুন থাকবেই, ফাগুন আসবেই। কবিতার ভাষায়- ‘তুমি বেঁচে থাকো আর না থাকো/ ফাগুন আসবেই এদেশে। রঙ যদি মুছে যায়, স্বপ্নেরা ঘুচে যায়/ ফাগুন আসবেই এদেশে।

আলী রেজা: কলেজ শিক্ষক, কলাম লেখক ও পিএইচডি গবেষক, ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :