রমজান সমাগত: দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করুন

পবিত্র রমজান মাস আসতে আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকি। এরই মধ্যে রোজাসংশ্লিষ্ট অপরিহার্য পণ্য চিনি, খেজুর, তেল, ছোলা ও বিভিন্ন ধরনের দেশি-বিদেশি ফলসহ প্রায় সকল ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আরেক দফা বেড়ে গিয়েছে। চিনি, খেজুর ও তেলসহ বেশ কয়েকটি পণ্যে সরকারের তরফ থেকে আমদানি শুল্ক হ্রাস করা হলেও এর কোনো সুফল বাজারে পড়ছে না। নিম্ন আয়ের সাধারণ ক্রেতাদের এখন একেবারেই ত্রাহি-ত্রাহি অবস্থা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই বিষয়টি এখন দেশের সর্বত্র, সর্বশ্রেণির মানুষের মধ্যেই বিশেষ আলোচনার বিষয়। বছরের নির্দিষ্ট সময়ে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হলেও এখন কোনো নিয়মেরই ধার ধারছেন ব্যবসায়ীরা। তারা রমজানকে কেন্দ্র করে সবকিছুর দাম নতুন করে বাড়িয়েছে। বছরের নির্দিষ্ট সময়ে কিছু পণ্যের দাম বাড়তে পারে কিন্তু তা রমজানের আগে কেন? আমরা এটা সহজেই মেনে নেই যে- নানা কারণেই কোনো পণ্যের দাম পাঁচ বছর আগে যা ছিল পাঁচ পরে তা নাও থাকতে পারে; এটা কিছু বাড়বে। কেননা, পণ্যের উৎপাদন, সংরক্ষণ, বিপণন এবং ভোক্তাসাধারণের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে যেকোনো পণ্যের দাম যৌক্তিকভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে এবং এই বৃদ্ধি পাওয়া একটা স্বাভাবিক ব্যাপার বলেই সবাই ধরে নেয়। এছাড়া, আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টিও মানুষ মেনে নেয়। কিন্তু কোনো একটি নিত্যপণ্যের মূল্য যখন হঠাৎ করে দ্বিগুণ কিংবা দ্বিগুণেরও বেশি হয় তখন এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি মানুষ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে না। মেনে নিতে পারে না দুটি কারণে। একটি কারণ হলো আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের ব্যবধান বেড়ে যাওয়ার ফলে মানুষ বেকায়দায় পড়ে। আর একটি কারণ হলো এ ধরনের হঠাৎ মূল্যবৃদ্ধির পেছনে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি থাকে।
কিছুদিন যাবৎ দেশের বাজারে মাঝে মাঝেই ডিম, চিনি, আলু, পেঁয়াজের মতো নিত্যপণ্যের মূল্য অস্বাভাবিক গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সরকার এই হঠাৎ বেড়ে যাওয়া দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থও হচ্ছে। যখন কোনোকিছুর দাম কমে তখন তা ধীরে ধীরে কমে। কিন্তু যখন পণ্যের দাম বাড়ে তখন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে।
আমদানিকারকরা আমদানি বন্ধের অজুহাতে কিংবা সরবরাহকারীরা কৃত্রিম সংকট তৈরির মাধ্যমে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে বলে সাধারণ মানুষের ধারণা। অধিকতর অনুসন্ধানের ফলে এ ধারণার সত্যতাও খুঁজে পাওয়া যায়। এখানেই ব্যবসায়ের মধ্যে নৈতিকতার প্রশ্নটি চলে আসে। একজন ব্যবসায়ী, উৎপাদনকারী বা আমদানিকারী, পাইকারি ব্যবসায়ী বা খুচরা ব্যবসায়ী- তিনি যে পর্যায়ের ব্যবসায়ীই হোন না কেন- তার পক্ষে ক্রয়মূল্যের উপর কত পারসেন্ট লাভ করা উচিত- এটা একটা নৈতিক প্রশ্ন।
শুধু দেশীয় বাণিজ্য নয়, বৈদেশিক বাণিজ্য বা আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রেও নৈতিকতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কের মূলে থাকে উভয় দেশের স্বার্থ। এ স্বার্থ বিঘ্নিত হলে বাণিজ্যিক সম্পর্ক দীর্ঘদিন টিকে থাকে না। নির্দিষ্ট কোনো পণ্য উৎপাদনে এগিয়ে থাকা দেশগুলো ঐ পণ্য উৎপাদনে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোকে বিশেষ ছাড় দিয়ে সে পণ্য রপ্তানি করে। এতে বাণিজ্যিক সম্পর্কে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এ ভারসাম্য রক্ষা হওয়া খুবই জরুরি। প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে এ ধরনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক থাকা দু’দেশের জন্যই মঙ্গলজনক।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এ ধরনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। ভারত বাংলাদেশের একটি বৃহৎ প্রতিবেশী রাষ্ট্র এবং পরীক্ষিত বন্ধু। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাঙালি জাতির মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অকুণ্ঠ সমর্থন ও প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ছিল বলেই মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতির বিজয় ত্বরান্বিত হয়েছিল।
ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্যিক সম্পর্কের বিষয়ে নানা ধরনের বিশ্লেষণ আছে। অনেকে মনে করেন বাংলাদেশ ভারতের একটি বৃহৎ বাজার এবং বাংলাদেশের সঙ্গে তারা তাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক চলমান রেখেছে নিজেদের স্বার্থেই। ভিন্ন মত হলো ভারত বাংলাদেশে পণ্য রপ্তানি না করলে বাংলাদেশের বাজারে পণ্যসংকট, বিশেষ করে ভোগ্যপণ্যের সংকট দেখা দেবে এবং বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হবে। দ্বিতীয় মতটি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, অন্যের লাভের কথা চিন্তা না করে নিজের ক্ষতির কথা আগে চিন্তা করতে হয়। অতীতে বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে, ভারত কখনো কোনো নির্দিষ্ট পণ্যের রপ্তানি বন্ধ করে দিলে বাংলাদেশের বাজারে সে পণ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। দেশের বাজারে অসাধু ব্যবসায়ীরা সে সুযোগ নিয়ে অবশিষ্ট পণ্য লাগামহীন মূল্যে বিক্রি করেছে। এ ধরনের উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার সব সময়ই ব্যর্থ হয়েছে। কিছুদিন আগে ডিম নিয়ে এ ধরনের অস্থির পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল।
গত কয়েক বছরে মাঝে মাঝেই পেঁয়াজের বাজার অস্থির হয়েছে। কিছুদিন আগে ভারত সরকার পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছিল। ঘোষণা অনুযায়ী পেঁয়াজ আসা বন্ধ হতে বেশ কিছুদিন সময় লাগে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে ঘোষণার দিনেই বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দিল। দেশের প্রতিটি বাজারে এর প্রভাব পড়ল। পরের দিন বাজারে গিয়ে ক্রেতারা দেখল পেঁয়াজের দাম প্রায় দ্বিগুণ। কোথাও কোথাও দ্বিগুণের বেশি। বাস্তবতা হলো এসব ক্ষেত্রে সরকার ব্যবস্থা নিতে নিতেই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট বাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। এই হলো বাংলাদেশে ব্যবসায় নৈতিকতা।
ভারত যদি কখনো তার নিজের দেশের কথা চিন্তা করে কোনো পণ্যের রপ্তানি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয় তবে সেটা ভারত সরকারের পক্ষে অন্যায় সিদ্ধান্ত বলা যায় না। প্রতিটি দেশ সর্বাগ্রে নিজের দেশের কথা চিন্তা করবে- এটাই স্বাভাবিক। দেশের সরকারকেও সবার আগে নিজের দেশ ও মানুষের কথা ভাবতে হবে। বাজারে নতুন পেঁয়াজ আসা শুরু করেছে। ভারতের বাজারেও নতুন পেঁয়াজ আসা শুরু করেছে। ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত আমাদের দেশে ত্বরিত প্রভাব পড়ে- এটা প্রমাণিত। অনেক সময় রপ্তানি বন্ধের পেছনে কোনো রাজনৈতিক কারণও প্রচ্ছন্নভাবে থাকতে পারে। কিছুদিন আগে ক্রিকেট নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের খুনসুটি হয়েছে। ভারতের পরাজয়ে বাংলাদেশের এক শ্রেণির দর্শকের উল্লাস সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ভারত এ বিষয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। ক্রিকেটের মাঠ থেকে বিষয়টি রাজনীতির মাঠেও গড়িয়েছে। রাজনীতিকদের মুখেও শোনা গেছে আমাদের খেয়ে, আমাদের পরে আমাদের পরাজয়ে উল্লাস করা মেনে নেওয়া যায় না। এ ধরনের কথা নিঃসন্দেহে সংবেদনশীল এবং দু’দেশের বন্ধুপ্রতীম সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে অস্বস্তিকর।
এক সময় এই দেশের বেশিরভাগ মানুষ কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত ছিল। নিজে ফসল উৎপাদন করে ভোগ করতেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের জন্য অন্যের দ্বারস্থ হতেন না কৃষক সমাজ। বাপ-চাচাদের কাছে শুনেছি তারা নাকি লবণ আর কেরোসিন তেল ছাড়া আর কিছুই কিনতেন না। এখন সময় পাল্টে গেছে। ভূমিপুত্ররা এখন নাগরিক হয়েছে। নগরে নানা কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নগদ অর্থ উপার্জন করছে। নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য কিনতে নগদ অর্থ নিয়ে বাজারে যাচ্ছে।
বাজার মানেই ব্যবসায়ীদের কারবার। চাহিদা অনুযায়ী ব্যবসায়ীরা এক জায়গার পণ্য আরেক জায়গায় নিয়ে যায়। প্রয়োজনে বিদেশ থেকে আমদানি করে। ব্যবসায় আছে নানা স্তর। আমদানিকারক ও উৎপাদনকারীরা এক স্তরের ব্যবসায়ী। পাইকারি বিক্রেতারা আর এক স্তরের। খুচরা বিক্রেতারা প্রান্তিক পর্যায়ের ব্যবসায়ী। এই ব্যবসায়ীদের সঙ্গেই ভোক্তাদের কায়-কারবার। যিনি ভোক্তা তিনি উৎপাদন করেন না। তবে সবশেষে তাকেই মেটাতে হয় উৎপাদনকারী, পাইকারি ব্যবসায়ী ও খুচরা ব্যবসায়ীদের লাভের অংশ। এ লাভ দিয়েও ভোক্তাদের স্বস্তি নাই।
দ্রব্যমূল্য প্রায়ই লাগামহীন হয়ে যায়। খুচরা ব্যসায়ীরা পাইকারি ব্যবসায়ীদের এবং পাইকারি ব্যবসায়ীরা আমদানিকারক বা সরবরাহকারীদের দোহাই দিয়ে দ্রব্যমূল্যকে লাগামহীন করে রাখে। অসাধু ব্যবসায়ীদের এ কারসাজি আইনগতভাবে যেমন দণ্ডনীয় তেমনি নৈতিক দিক থেকেও নিন্দনীয়। দেশে ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য আছে সরকারি প্রতিষ্ঠান ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।’ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন প্রয়োগ করে বাজার মনিটরিং করা এ অধিদপ্তরের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। প্রতিষ্ঠানটি এ দায়িত্ব পালন করছে নাÑ একথা বলা যাবে না। মাঝে মাঝেই দেখা যায়, এ অধিদপ্তরের লোকেরা বাজার মনিটরিং করছে। অসাধু ব্যবসায়ীদের ধরে বিভিন্ন অংকের টাকা জরিমানা করছে। জরিমানার টাকার পরিমাণ অনেক সময় এতই কম হয় যে, তাদের একদিনের লাভও তার চেয়ে অনেক বেশি। ফলে ব্যবসায়ীরা একই অপরাধ বার বার করতেও দ্বিধাবোধ করে না। তাই ভোক্তা অধিকার আইন সংশোধন হওয়া প্রয়োজন। তবে আইনের চেয়ে যে বিষয়টি অধিক কার্যকর হতে পারে তাহলো নেতিক শিক্ষা।
প্রতিটি বাজারে খুচরা ব্যবসায়ীদের নিয়ে কাউন্সিলিং হতে পারে। পাইকারি ব্যবসায়ীদের নিয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এ কাজটি করতে পারে। উৎপাদনকারী ও আমদানিকারকদের কাউন্সিলিং করার জন্য থাকতে পারে উচ্চ পর্যায়ের কোনো কমিটি বা পরিষদ। এ প্রক্রিয়ায় সর্বস্তরের ব্যবসায়ীদের নৈতিকভাবে শক্তিশালী করে তুলতে পারলে তাদের মধ্যে সিন্ডিকেট করে অস্বাভাবিকভাবে নিত্যপণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা কমবে বলে আশা করা যায়। পবিত্র রমজান মাস আসার আগেই রোজাসংশ্লিষ্ট নিত্যপণ্যগুলোর দাম সহনীয় পর্যায়ে আনতে সরকার যেন ত্বরিত ব্যবস্থা নেয়- এটাই দেশবাসী প্রত্যাশা করে। শুধু সহজভাবে বাজার মনিটরিং, কিছু-কিছু ক্ষেত্রে সামান্য জরিমানা- নামকাওয়াস্তে এসব লোক দেখানো পদক্ষেপ গ্রহণ করলে বাজারে তার কোনো সুফল দেখা যাবে না। এর জন্য সরকারকে কঠোর হতে হবে; আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে এবং দৃশ্যমান করতে হবে সরকারের যথাযথ আন্তরিকতা।আলী রেজা: কলেজ শিক্ষক এবং পিএইচডি গবেষক, ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য করুন