প্রথমবার মন্ত্রিপরিষদের সাবেক সচিবরা অংশ নিচ্ছেন
মন্ত্রিপরিষদে ৩৫০ প্রস্তাব, আজ শুরু ডিসি সম্মেলন

মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে রাষ্ট্রের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সমন্বয় ও মাঠের বাস্তবতা অনুধাবনের লক্ষ্যে প্রতিবছর হয়ে থাকে ডিসি সম্মেলন। রবিবার থেকে শুরু হচ্ছে এ বছরের ডিসি সম্মেলন, যা চলবে চার দিন।
ডিসি সম্মেলনে মাঠ পর্যায়ের কাজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে প্রয়োজনীয় পরামর্শ, সুপারিশ ও দাবি উপস্থাপন করেন জেলা প্রশাসকরা। টানা বৈঠক আলোচনায় প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা আসে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। সম্মেলনে কথা বলেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ অন্য দায়িত্বশীলরা। এছাড়া এবারই প্রথম ডিসি সম্মেলনে আমন্ত্রণ পাচ্ছেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিবরা।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শাপলা হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিসি সম্মেলন-২০২৪-এর উদ্বোধন করবেন এবং ভাষণ দেবেন। তবে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবার ডিসি সম্মেলনে থাকছেন না। সম্মেলন শুরুর আগেই তিনি স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাত ও যুক্তরাজ্য সফরে যাবেন।
গত বছর এই সম্মেলন তিন দিন হলেও এবার ৩ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত চার দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এবারের সম্মেলনে ৫৬টি মন্ত্রণালয়, বিভাগ, কার্যালয় ও সংস্থা সম্পর্কে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে প্রায় ৩৫০টি প্রস্তাব জমা দিয়েছেন জেলা প্রশাসকগণ। গত বছর এই প্রস্তাবের সংখ্যা ছিল ২৪৫টি। ফলে গত বছরের চেয়ে এবার একশর বেশি প্রস্তাব করেছেন ডিসিরা। প্রতিবছর বেশির ভাগ প্রস্তাব থাকে ডিসি ও ইউএনওদের ক্ষমতা বা দায়িত্বের পরিধি বাড়ানো ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিসংক্রান্ত। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি।
এবারের ডিসি সম্মেলনে প্রথমবারের মতো সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিবরা তাদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরবেন ও পরামর্শ দেবেন। এ জন্য সম্মেলনের প্রথম দিন রবিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় ‘উন্নয়নে মাঠ প্রশাসন’ শীর্ষক এক আলোচনাসভার আয়োজন করা হয়েছে। আলোচনাসভায় সভাপতিত্ব করবেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন। আলোচক হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিবরা।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন শনিবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, মোট ৫৬টি মন্ত্রণালয়/বিভাগ/সংস্থার মন্ত্রী/উপদেষ্টা/প্রতিমন্ত্রী/সিনিয়র সচিব/সচিবরা সম্মেলনে অংশ নেবেন। চার দিনে স্পিকার, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে জেলা প্রশাসকগণ সৌজন্য সাক্ষাৎ ও নির্দেশনা গ্রহণ ও মতবিনিময় করবেন।
এ ছাড়া প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ ও সামরিক-বেসামরিক সমন্বয়বিষয়ক অধিবেশন সংযুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি উদ্বোধন অনুষ্ঠান, একটি স্পিকারের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ ও মতবিনিময় এবং একটি প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ ও নির্দেশনা গ্রহণ এবং অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা দুটি।
গত বছর তিন দিন সম্মেলন হয়েছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, আসলে তিন দিনে সকল আলোচনা সম্ভব হয় না, সেজন্য এবার চার দিনব্যাপী সম্মেলন হবে। এই চার দিনে প্রধান বিচারপতি ও স্পিকারের সঙ্গে অধিবেশন থাকবে। তবে রাষ্ট্রপতি দেশে না থাকায় তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে না। প্রতিবছর জেলা প্রশাসকদের কাছ থেকে প্রস্তাব চাওয়া হয়। এবারও প্রস্তাব আসছে। সব মিলিয়ে সম্মেলনে এবার ৩৫৬টি আলোচ্য বিষয় থাকছে।
এর মধ্যে জনসেবা বৃদ্ধি, জনদুর্ভোগ হ্রাস করা, রাস্তাঘাট ও ব্রিজ নির্মাণ, পর্যটনের বিকাশ, আইন-কানুন বা বিধিমালা সংশোধন, জনস্বার্থ সংরক্ষণের বিষয়গুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করা হয়েছে। বেশিসংখ্যক প্রস্তাব ২২টি এসেছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ থেকে।
প্রধান আলোচ্য বিষয়ে থাকছে, ভূমি ব্যবস্থাপনা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যক্রম জোরদারকরণ; দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম; স্থানীয় পর্যায়ে কর্ম-সৃজন ও দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি বাস্তবায়ন; সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচি বাস্তবায়ন; তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার এবং ই-গভর্ন্যান্স; শিক্ষার মান উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ; স্বাস্থ্যসেবা ও পরিবার কল্যাণ; পরিবেশ সংরক্ষণ ও দূষণরোধ; ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন ও উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও সমন্বয়।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন বলেন, ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং নতুন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। এরই মধ্যে ইশতেহার বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যারা মাঠপর্যায়ে কাজ করবেন তাদের দিকনির্দেশনা দেওয়া হবে জেলা প্রশাসক সম্মেলনে।
গত বছরের সম্মেলনের সিদ্ধান্ত ও বাস্তবায়নের তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, 'গত বছর সম্মেলন জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হয়। এবার নির্বাচন থাকায় মার্চে হচ্ছে। গত বছর মোট ২১২টি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর মধ্যে ১৩০টি বাস্তবায়ন, বাস্তবায়নাধীন ৮২টি। শতকরা হিসাবে বাস্তবায়ন ৬২ শতাংশ।'
এতে মন্ত্রিপরিষদ সন্তুষ্ট উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'বাস্তবায়নের এখনো চার বছর বাকি। অতএব বাস্তবায়নে অসন্তুষ্ট হওয়ার কারণ দেখছি না।'
বাস্তবে মাঠপর্যায়ের বাস্তবায়নের হার কম; এটা নজরদারি করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হবে কি না এমন প্রশ্নে মাহবুব হোসেন বলেন, 'আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখব। তবে অনেক জেলা প্রশাসক নিজ উদ্যোগে বাস্তবায়ন করছেন।'
এবারের ডিসি সম্মেলনে প্রায় সাড়ে তিনশর বেশি প্রস্তাব এসেছে। এসব প্রস্তাব নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। এরপর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মাঠ প্রশাসন সম্পৃক্ত বিষয়াদি নিয়ে মুক্ত আলোচনা হবে ডিসি ও বিভাগীয় কমিশনারদের। প্রথম কার্য অধিবেশন হবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সম্পর্কে। অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কার্য অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে। এবারের ডিসি সম্মেলনে মোট ৩০টি অধিবেশন রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম দিন রয়েছে সাতটি, দ্বিতীয় দিন ৯টি, তৃতীয় দিন সাতটি ও চতুর্থ দিন সাতটি। প্রথম দিন স্বাস্থ্যসেবা, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা, কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগ এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা, সমাজকল্যাণ, যুব ও ক্রীড়া, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে তিনটি অধিবেশন হবে। একইভাবে অন্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসবেন ডিসি-বিভাগীয় কমিশনাররা। এ সময় প্রতি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মন্ত্রী, উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রী, সচিব এবং অধিদপ্তর ও সংস্থার প্রধানরা উপস্থিত থাকবেন।
সম্মেলনে প্রতিটি জেলার আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, আইনশৃঙ্খলা, সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা আলোচনায় উঠে আসবে। ধারণা করা হচ্ছে জিআই পণ্য ব্র্যান্ডিং করা, বৈধ পথে প্রবাসীদের রেমিটেন্স প্রবাহ বৃদ্ধি, সারাদেশের ইকোনমিক জোন প্রকল্পে অগ্রগতি নিয়ে বিশেষ আলোচনা হতে পারে। সম্মেলনের শেষদিন ফিডব্যাক অধিবেশন ও সম্মেলনের মূল্যায়ন বিষয়ে একটি অধিবেশন হবে। এই দুই অধিবেশনে ডিসিরা সম্মেলনে কী পেলেন এবং মাঠে গিয়ে কী কাজ করবেন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন ও নির্দেশনা উঠে আসবে।
প্রতিবছর ডিসি সম্মেলনের সময় ডিসি ও বিভাগীয় কমিশনাররা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় রাষ্ট্রপতি মাঠ প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বেশকিছু দিক নির্দেশনা দেন। কিন্তু এবার রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ডিসি-বিভাগীয় কমিশনাররা সাক্ষাতের সুযোগ পাচ্ছেন না। কেননা সম্মেলন শুরুর আগের দিন রাতে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাত ও যুক্তরাজ্যের উদ্দেশে যাত্রা করবেন। তবে রাষ্ট্রপতিকে না পেলেও প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকার ও প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বিশেষ বৈঠক করবেন তারা। সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যায় জাতীয় সংসদ ভবনে স্পিকারের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং মতবিনিময় করবেন। এরপর নৈশ ভোজে অংশ নেবেন। শেষ দিন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। এ সময় বিচার বিভাগ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবেন প্রধান বিচারপতি। এরপর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভা অনুষ্ঠিত হবে। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নৈশ ভোজে অংশ নেওয়ার মাধ্যমে শেষ হবে এবারের ডিসি সম্মেলন।
(ঢাকাটাইমস/০ ৩মার্চ/এসআইএস)

মন্তব্য করুন