নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে হবে

আলী রেজা
  প্রকাশিত : ০৯ মার্চ ২০২৪, ১৬:১৮
অ- অ+

জীবন ধারণের জন্য খাদ্য গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। এ কারণে খাদ্য মানুষের প্রথম মৌলিক চাহিদা। খাদ্যের চাহিদা মিটলেই কেবল অন্যান্য চাহিদা পূরণের প্রশ্ন আসে। ‘সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা’ এই দেশে গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গোরু আর পুকুর ভরা মাছের কথা যতই বলা হোক না কেন- সমাজ-ইতিহাস গবেষণা থেকে জানা যায়, এ ধরনের সচ্ছলতা সমাজের গুটিকয়েক মানুষেরই ছিল। সাধারণ মানুষ বা কৃষক-প্রজার অবস্থা কোনোকালেই খুব ভালো ছিল না। এক সময়ে এই দেশে মঙ্গা-দুর্ভিক্ষ হতো। মাঠের ফসল ঘরে না আসা পর্যন্ত কৃষকের খাদ্য নিরাপত্তা ছিল না। বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিলে পুনরায় খাদ্য উৎপাদন না হওয়া পর্যন্ত অভাব থাকতো বেশিরভাগ মানুষের ঘরে।

বর্তমান বাংলাদেশ সে অবস্থা থেকে অনেকটাই মুক্ত হয়েছে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, কৃষি প্রযুক্তি ও রাসায়নিক সার ব্যবহারের মাধ্যমে এখন অল্প জমিতে অধিক খাদ্য উৎপাদন হচ্ছে। ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশকে কিছু ভোগ্যপণ্য আমদানি করতে হয়। সরকার ও ব্যবসায়ীদের সে আমদানি করার সক্ষমতাও বেড়েছে। ফলে কোনো কারণে খাদ্যঘাটতি দেখা দিলে বর্তমানে সেটা স্বল্প সময়ে মোকাবিলা করা সম্ভব। একথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। তবে এ কথাও মানতে হবে যে, বর্তমান বাংলাদেশে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে অনেকগুণ। সামগ্রিক বিচারে বাংলাদেশ খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। ফলে খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ে বড়ো ধরনের কোনো ঝুঁকি আছে বলে মনে করেন না খাদ্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্য সরবরাহ ঠিক থাকলে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে না বলে বিশ^াস করা যায়। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হলেও ভোক্তাদের জন্য কোনোভাবেই নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে সরকারি সকল পদক্ষেপই ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু জনগণের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার বিষয়টিই সরকারকে ভাবতে হবে সর্বাগ্রে। খাদ্য মানুষের জীবন বাঁচায়, আবার বিষাক্ত বা ভেজাল খাদ্য মানুষকে মৃত্যুর দিকেও ঠেলে দেয়।

খাদ্যে ভেজাল জনস্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে বড়ো হুমকি। অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে বাংলাদেশে প্রায় ৮০% রোগের সংক্রমণ ঘটে ভেজাল খাদ্য থেকে। কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের নির্বিচার ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন পর্যায় থেকেই ফল ও ফসলে বিষের সংক্রমণ ঘটে। উৎপাদন পর্যায় শেষে সংরক্ষণের জন্যও ব্যবহার করা হয় নানা ধরনের প্রিজারভেটিভ। মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর এসব রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত খাদ্যকে কোনোমতেই নিরাপদ খাদ্য বলা চলে না। এসব খাদ্য গ্রহণের ফলে অনেকেই তাৎক্ষণিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। অনেকে ক্রমশ অসুস্থতার দিকে চলে যান। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণের মতে, ভেজাল ও বিষাক্ত খাদ্য গ্রহণের ফলে হার্ট, কিডনি, ফুসফুসসহ মানবদেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে যায়। ভোগ্যপণ্য বা খাদ্যদ্রব্য দুইভাবে অনিরাপদ হতে দেখা যায়। প্রথমত উৎপাদন ও সংরক্ষণের জন্য রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে ভোগ্যপণ্যকে অনিরাপদ করে তোলা হয়। দ্বিতীয়ত বিষাক্ত উপাদান দিয়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুত করে খাদ্যকে অনিরাপদ করে তোলা হয়। ফলে এখন নিরাপদ খাদ্য পাওয়াই দুষ্কর হয়ে পড়েছে।

উন্নতবিশ্বেও খাদ্য উৎপাদনের জন্য কীটনাশক বা রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয়। খাদ্য সংরক্ষণের জন্য ব্যবহার করা হয় নানা ধরনের প্রিজারভেটিভ। তবে সঠিক অনুপাতে ব্যবহারের ফলে তা মানবদেহের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে না। বাংলাদেশে ভোগ্যপণ্যে রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিংবা খাদ্যদ্রব্যে প্রিজারভেটিভ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সঠিক অনুপাত ও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা খুব কমই মানা হয়। এর প্রধান কারণ দুটি।

এক. এসব ব্যবহার বা প্রয়োগের দায়িত্বে যারা নিয়োজিত থাকেন তাদের বেশিরভাগই সঠিক অনুপাত ও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা সম্বন্ধে অজ্ঞ। এ সমস্যা সমাধানের জন্য তৃণমূল পর্যায়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। দুই. বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই) ও বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ কিংবা এ জাতীয় সরকারি কর্তৃপক্ষের পর্যাপ্ত তদারকির অভাব। এ সংকট থেকে উত্তরণের জন্য এসব প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ করে উৎপাদক ও বাজারজাতকারীদেরকে কার্যকর মনিটরিং- এর আওতায় আনা জরুরি। খাদ্যদ্রব্যে সঠিক নিয়মে ও সঠিক অনুপাতে রাসায়নিক বা প্রিজারভেটিভ প্রয়োগ না করলে বিষয়টিকে গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে দায়ী ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। খাদ্য নিরাপত্তা বা খাদ্যে স্বয়ংসম্পন্ন হওয়া যেমন জরুরি নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা তার চেয়ে অধিক জরুরি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে দূষিত খাবার খেয়ে সারাবিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৬০ কোটি মানুষ অসুস্থ হয়। এসব অসুস্থ লোকদের মধ্যে থেকে মারা যায় প্রায় সাড়ে চার লাখ মানুষ। দেশের ছাত্রাবাস কিংবা আবাসিক হোটেলে খাবার খেয়ে গণহারে অসুস্থ হয়ে পড়ার খবর প্রায়ই গণমাধ্যমে প্রচার হতে দেখা যায়। পরীক্ষা করে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, খাদ্যে বিষক্রিয়ার ফলে এ ধরনের অসুস্থতার ঘটনা ঘটে।

মানবদেহে ভিটামিনের চাহিদা পূরণ করার জন্য ফল খাওয়া জরুরি। কিন্তু বর্তমানে আমদানিকৃত ফল ও দেশি ফল- দুটোই অনিরাপদ হয়ে পড়েছে। স্বাস্থ্যসচেতন অনেক মানুষ এখন বাধ্য হয়ে ফল খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। মাছে ব্যাপক মাত্রায় ফরমালিন ব্যবহারের ফলে এদেশের মানুষের আমিষের প্রধান উৎস মাছও আর নিরাপদ নেই। ভ্যাকসিন প্রয়োগ করে ব্রয়লার মুরগিকে অস্বাভাবিকভাবে বড়ো করা হচ্ছে। হরমোন প্রয়োগ করে সবজির আকার ও ওজন বৃদ্ধি করা হচ্ছে। কৃষি খামারিদের এ ধরনের অনৈতিক তৎপরতার মূলে আছে তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থ। অল্প জমিতে অল্প সময়ে অধিক খাদ্য উৎপাদনের যুক্তি দেখিয়ে খাদ্যকেই বিষাক্ত করে তোলা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। নিরাপদ খাদ্য পাওয়া ভোক্তার একটি মৌলিক অধিকার। বাণিজ্যিক স্বার্থে কোনো উৎপাদনকারী কিংবা ব্যবসায়ী ভোক্তাকে সে অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারেন না। এ ব্যাপারে সরকারের ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। পাশাপাশি ভোক্তাদেরও সচেতন হওয়া জরুরি।

জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনায় নিয়ে সরকার ২০১৩ সালে ‘নিরাপদ খাদ্য আইন’ পাশ করেছে। ২০১৫ সালে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে গঠিত হয়েছে ‘বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ’ নামে আরও একটি প্রতিষ্ঠান। গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, সরকারের এই সংস্থাটি নাকি কাজ শুরু করতে পেরেছে ২০২০ সালে। জনগণের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গঠিত একটি প্রতিষ্ঠানের কাজ শুরু করতে পাঁচ বছর সময় লেগে যাওয়া কোনো স্বাভাবিক বিষয় নয়। নিরাপদ খাদ্য আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারি প্রত্যাশা করে সাধারণ মানুষ। অনিরাপদ খাদ্য খেয়ে দেশের কোটি কোটি মানুষের ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপসহ নানা ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা বেড়ে যাচ্ছে। হৃদরোগ ও ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা এখন এতটাই বেড়ে গেছে যে, এগুলো আজকাল খুব সহজ রোগ বলেই মনে হয়। সরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগীদের উপচেপড়া ভিড়। সরকারি হাসপাতালে ঠাঁই না পেয়ে সাধারণ মানুষ চলে যাচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালে এবং অর্জিত টাকা নিঃশেষ করে অনেকে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতি থেকে বাঁচার প্রধান উপায় হলো নিরাপদ খাদ্য গ্রহণ করা। কিন্তু কোথায় পাওয়া যাবে নিরাপদ খাদ্য?

নগরায়ণের ফলে মানুষের কাজের চাপ বেড়েছে। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও ব্যাপকভাবে বিভিন্ন কল-কারখানা ও অফিস-আদালতের কাজে যুক্ত হয়েছে। এখন বাজার করে ঘরে রান্নার সময়টুকু অনেকের হাতে নেই। সহজ পথ হিসেবে হোটেল-রেস্তোরায় কিংবা রাস্তার পাশে গড়ে ওঠা টোঙ দোকানে অনেকেই খেয়ে নিচ্ছেন প্রয়োজনীয় খাবার। এসব খাবার কতোটা নিরাপদ ও মানসম্মত সে বিচার কেউ করছে না। সাধারণ মানুষের বিচার করার সময় ও সক্ষমতাও কম। বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় অনেকে এসব খাবার খেতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেকে আবার শখের বশেও খাচ্ছেন। এ চাহিদা থেকেই সারা দেশে প্রতিদিন গড়ে উঠছে অসংখ্য হোটেল-রেস্তোরা বা খাবারের দোকান। রাস্তার পাশে গড়ে ওঠা এসব হোটেল-রেস্তোরার বেশিরভাগই রেজিস্ট্রেশনবিহীন। স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় গড়ে উঠেছে এগুলো। খোলা জায়গায়, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে প্রস্তুত করে রাস্তার পাশেই খোলা অবস্থায় সাজিয়ে রাখা হচ্ছে এসব খাবার। রাস্তার ধূলা-ময়লা উড়ে এসে মিশে যাচ্ছে খাবারের সঙ্গে। কেউ কিছু বলছে না। সবাই যেন বিষয়টি মেনে নিয়েছে। প্রশাসনকেও এ ব্যাপারে নির্বিকার থাকতেই দেখা যায়। মাঝে মাঝে লোক দেখানো অভিযান চলে। কিন্তু কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা যায় না।

অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এসব খাবারের দোকানের কর্মচারীরা সুযোগ বুঝে পঁচা-বাসি, পরিত্যাক্ত ও উচ্ছিষ্ট খাবারও চালিয়ে দেয়। ব্যস্ত কাস্টমার নিরুপায় হয়ে খেয়ে নেয়। ফলে এসিডিটিসহ নানা স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়। দেশে এখন খাবারের দোকানের চেয়ে ঔষধের দোকানের সংখ্যা কম নয়। এ থেকেই অনুমান করা চলে দেশের জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি কতোটা নাজুক হয়ে পড়েছে। অনেকেই আছেন, যাদের প্রতিদিনের খাদ্য কেনার চেয়ে ঔষধ কেনায় খরচ বেশি হয়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতেই হবে। প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ করে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষকে এমন একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে যাতে তারা তাদের মনিটরিং কার্যক্রম যথাযথভাবে পালন করতে পারে। একই সঙ্গে বিদ্যমান নিরাপদ খাদ্য আইন প্রয়োগের মাধ্যমে খাদ্যে ভেজালকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। শুধু খাদ্য নিরাপত্তা বা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন নয়, সবার জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করাও সরকারের জন্য একটি বড়ো চ্যালেঞ্জ।

আলী রেজা: কলাম লেখক, কলেজ শিক্ষক ও পিএইচডি গবেষক, ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
পল্লীবন্ধু এরশাদ চিরকাল মানুষের হৃদয়ে কণক প্রদীপ হয়ে জ্বলবেন
চাঁদা না দেওয়ায় পল্লবীতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাসী হামলা, গুলিবর্ষণ: গ্রেপ্তার ৩
ছন্দে ফিরলেন লিটন, সমতায় ফিরল টাইগাররা
১২ দিনে রেমিট্যান্স এলো ১০৭ কোটি মার্কিন ডলার
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা