গল্প

প্রত্যাবর্তন

বিশ্বজিৎ ঘোষ
| আপডেট : ১৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫:৫১ | প্রকাশিত : ১৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১:০১

চারদিকে হৈ হৈ রৈ রৈ ব্যাপার- খুশির বাধ-ভাঙা জোয়ার দেশ স্বাধীন হয়েছে, ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয়েছে, ইউনিয়ন জ্যাকের জায়গায় উড়ছে চাঁদ-তারা খচিত পাকিস্তানি পতাকা কিন্তু এত আনন্দের মাঝেও স্বস্তি নেই শিবানন্দের মনে হেমন্তের এই অপরাহ্ণের প্রশান্তিও শান্তি কিংবা ভরসা দিচ্ছে না তাকে কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না শিবানন্দ সাতদিন ধরেই ভাবছে কী করা যায় এখন সুবর্ণগাঁয়েই থাকবে পিতৃ-পুরুষের ভিটায়- নাকি চলে যাবে হুগলির চাঁদমারি গ্রামে তিন মাস হলো দেশবিভাগ হয়েছে পাকিস্তান ও ভারত- উভয় সরকারই নাগরিকদের সুযোগ দিয়েছে যে-যার ইচ্ছামতো যেকোনো রাষ্ট্রের নাগরিক হতে পারবে- বিনিময়ে করতে পারবে স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি সুবর্ণগাঁয়ের সাত-আট পরিবার ইতোমধ্যে চলে গেছে নদীয়া, কল্যাণী, মধ্যম গ্রামে- কেউ-বা বিহারের ভাগলপুরে আরও দু-এক পরিবার যাবো-যাবো করছে কী করবে এখন শিবানন্দ?

দুই.

চাঁদমারির রহমান মুন্সির মনেও অভিন্ন ভাবনা থাকবে কি হুগলির চাঁদমারি গ্রামে- না কি চলে যাবে পাকিস্তানে- বরিশালের সুবর্ণগাঁয়ে ইতোমধ্যে কয়েক দফা চিঠি চালাচালি হয়েছে শিবানন্দ বিশ্বাসের সঙ্গে হুগলির চাঁদমারি গ্রামের জনার্দন বসুর মধ্যস্থতায় উভয়েই মোটামুটি একটা সিদ্ধান্তে এসেও গেছে প্রায় চাঁদমারি গ্রামের পাশ দিয়েই বয়ে গেছে গঙ্গা নদী নদীর তীরেই রহমান মুন্সির বাড়ি- ছেলে রকিব আর মেয়ে আলেয়াকে নিয়ে ভালোভাবেই দিন কাটছে রহমানের একতলা বাড়ি- গঙ্গার তীরঘেঁষা কয়েক বিঘা ধানি জমি- পুকুর আছে একটা- পুকুরে আছে অনেক মাছ উত্তরপাড়া পাঠাগারের লাইব্রেরিয়ান রহমান মুন্সি গরম ভাত-মাছ খেয়ে অফিসে যায়- বিকেলে বাড়ি ফিরে গাছপালা নিয়ে থাকে- কখনো রকিব আর আলেয়াকে নিয়ে যায় গঙ্গার তীরে বেড়াতে রহমানের বিবি মমতাজ সংসারের সবকিছু একাই সামাল দেয়- ছেলেমেয়ের পড়ালেখা, বাজার-হাট, স্বামীর সবকিছু দেখভাল করা- সবই নিপুণ হাতে করে চলেছে মমতাজ কিন্তু চারদিকে একি শুনছি! প্রতিবেশী জনার্দন বসু বিষয়টা মমতাজকেও বুঝিয়েছে- পাকিস্তান তোমাদের জন্য সোনার দেশ ও পাড়ার কয়েক ঘর তো মাসখানেক হলো চাঁপাইনবাবগঞ্জ চলে গেছে আরও দু-তিন ঘর যায়-যায় করছে কী করবে এখন মমতাজ?

-কী যে করুম, কিছুই বুঝবার পারছি না দাদা

-কষ্ট যে হয় তা বুঝি মমতাজ স্বামীর ভিটা

-, বুকটা কেমন জানি খালি খালি মনে হয় কথাডা মনে আসলেই

-শোনো মমতাজ, রহমান মোটামুটি রাজি হইছে এখন তুমি রাজি হইলেই হয়

-বুকটা টনটন করে রে দাদা কত কষ্টের সংসার!

-দেখ, তোমার আর রহমানের ব্যাপারটা ভিন্ন কিন্তু আমি ভাবছি ছেলে-মেয়ে দুটোর ভবিষ্যতের কথা বাচ্চা দুটোর কথা একবার ভাবো

-রকিব আর আলেয়ার ভবিষ্যতের জন্য আমিও চিন্তিত দাদা

-চিন্তার কী কারণ? সরকারই তো ব্যবস্থা কইরা দিছে বিনিময় প্রথা তোমরা যাবা- অন্য জায়গা থেকে এক পরিবার এখানে আসবে

-দাদা!

-, তোমাদের ঘর-বাড়ি তারা পাইবে, তাদেরটা পাইবাতোমরা!

জনার্দন-মমতাজের কথার মাঝে নীরবে এসে হাজির হয় রহমান কপালে চিন্তার ভাঁজ অফিসে আজ কী সব শুনেছে রায়ট হতে পারে- হিন্দুস্থানে থাকা মোটেই নিরাপদ নয় পাকিস্তানে চলে যাওয়াই ভালো- কথাটা বলেছে মুরুব্বি আউয়াল মুন্সি জনার্দন দাদার মাধ্যমে শিবানন্দ বাবুর সঙ্গে যোগাযোগটা হয়েছে বলে অনেকটা নির্ভার রহমান যদি পাকিস্তানে চলে যেতেই হয় তাহলে সুবর্ণগাঁয়ে শিবানন্দ বিশ্বাসের বাড়িতেই যাবো দোতলা দালান, বাড়ির পাশেই স্কুল, ইউনিয়ন কাউন্সিল অফিস, পোস্ট অফিস, বাজার বিশাল বাগান বাড়ি দশ বিঘার মতো জমি অদূরে চোখ জুড়ানো সন্ধ্যা নদী অসুবিধা হবে না বোধহয় জনার্দন বসুর ডাকে সম্বিৎ ফিরে এলো রহমানের

কী ব্যাপার রহমান? কথা বলছো না কেনো? কিছু কি ভাবলা?

-না দাদা, মনে হয় তোমার কথামতোই কাজ করতে হবে মাথাটা আমার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে

-চিন্তা করো না দেখবা, দুদিনেই সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে তোমাদের জীবনটা নিরাপদ হবে

-আল্লাহ, তুমি রহমত করো তুমিই মালিক আল্লাহ

-রহমান, আমি তাহলে শিবানন্দকে খবর পাঠাই অঘ্রাণ মাস আসার আগেই কাজটা শেষ করে ফেলো

-দাদা, বুকটা জানি কেমন করে কী বিপদেই না পড়লাম এর চেয়ে আগের জীবনই বোধ হয় ভালো ছিল

-চিন্তা করো না রহমান আমরা তো আছি তোমার যখন মন চাইবে বেড়াতে এসো বাস্

- , দাদা

তিন.

জনার্দন বসুর দূর সম্পর্কের আত্মীয় শিবানন্দ বিশ্বাস ছেলে অভিজিতের সঙ্গে শিবানন্দের মেয়ে কুঞ্জলতার বিয়ের ব্যাপারে খুব আগ্রহ তার তাই পাকিস্তান থেকে শিবানন্দকে হিন্দুস্থানে নিয়ে আসতে তার এত আগ্রহ এসব কথা শিবানন্দকে জানায়নি জনার্দন আগে বিনিময়টা হোক- তারপর দেখা যাবে জনার্দনের একমাত্র সন্তান অভিজিৎ সরকারি চাকুরে- কুঞ্জলতার সাথে ওকে মানাবে ভালো বছরখানেক আগে যখন বরিশালে, নোয়াখালীতে, ঢাকায় রায়ট হলো, তখন কুঞ্জলতাকে নিয়ে চাঁদমারি গ্রামে চলে এসেছিল শিবানন্দ উঠেছিল জনার্দন বসুর বাড়িতেই প্রথম দেখাতেই মেয়েটিকে ভারি ভালো লেগেছিল জনার্দনেরÑ মনে-মনে অভিজিতের সঙ্গে বিয়ের কথাও চিন্তা করেছে সে দেশবিভাগের পর সরকারের বিনিময় প্রথার কথা জেনেই জনার্দন উঠে-পড়ে লেগেছে শিবানন্দ আর রহমানের বাড়ি বদলের ব্যাপারে মনে মনে ভাবেÑ ভারি লক্ষ্মী শিবানন্দের মেয়ে কুঞ্জলতা আমার অভিজিতের সঙ্গে মানাবে বেশ

চার.

সন্ধ্যা নদীর তীরে সুবর্ণগাঁয়ে সন্ধ্যা নেমেছে ঘণ্টা দুয়েক হলো দূর থেকে ভেসে আসছে এশার আজানের ধ্বনি মোল্লা বাড়ি থেকে উৎসবের শোরগোল শোনা যাচ্ছে সাত গ্রামের যেসব মানুষ পাকিস্তান আন্দোলন করেছে তাদের সবাইকে দাওয়াত খাওয়াবেন গনি মোল্লা কত আয়োজন- হ্যাজাক লাইট জ্বলছে- মাইকে ভেসে আসছে- ‘পাক সার জমিন সাদ-বাদ...’ এদিকে বিশ্বাস পাড়ায় সুনসান নীরবতা দিন দশেক আগে ও-পাড়ার মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস পরিবার নিয়ে চলে গেছে হাওড়ায় তার বাড়িতে এসে উঠেছে অচেনা এক পরিবার শিবানন্দ ভাবছে কীভাবে আর থাকা যাবে এখানে তাই বিনিময়ের কথাটা জানিয়ে দিয়েছে চাঁদমারির জনার্দন বসুকে সবদিক বিবেচনা করে রহমানও শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছে রাতের খাওয়া আর হলো না শিবানন্দের স্ত্রী মলিনাকে ডাক দিলো শিবানন্দ-

-কুঞ্জুর মা, কোথায় গেলে তুমি?

-এই তো আমি ট্রাঙ্কটা একটু গুছিয়ে নেই

-রাখো ওসব কী হবে ছাইভস্ম নিয়ে সবই তো পড়ে থাকবে

-সংসারের কত জিনিস কতদিন বসে একটু-একটু করে জোগাড় করেছি সব কি ফেলে যাওয়া যায়?

-রাখো ওসব সাত পুরুষের ভিটে-মাটিই যখন চলে গেল, তখন ওসব নিয়ে আর কী হবে কুঞ্জরমা!

-আজ সারাদিন চোখ দিয়ে কেবল জল গড়িয়ে পড়ছে আর তো কাঁদতেও পারছি না

-সবই ভগবানের লীলা কুঞ্জর মা কেঁদো না এ অবস্থা তো কেবল আমাদের একারই নয়

-মৃত্যুঞ্জয় দাদা তো চলে গেলেন, শুনছি রমেশও নাকি চলে যাবে

-আমিও শুনেছি সবাই গোপনে-গোপনে কাজ সারছে কেউ কিছু বলে না কী যে স্বাধীনতা পেলাম!

-দেখ কুঞ্জর বাবা, কুঞ্জকে নিয়ে আমি বড়ো চিন্তায় থাকি তাই তোমার কথায় শেষ পর্যন্ত আমি রাজি হয়েছি শুধু আমার কুঞ্জর কথা ভেবে তা না হলে মাটি কামড়ে এই সুবর্ণগাঁয়েই থাকতাম আমি

শিবানন্দ কোনো কথা বলে না ভোর হবার আগেই চিরচেনা সন্ধ্যার মোহনায় তাদের ধরতে হবে কলকাতার স্টিমার আকাশের দিকে তাকিয়ে দুহাত উপরে তুলে শিবানন্দ বললো- ‘ঠাকুর, রক্ষা করো আমার কুঞ্জলতাকে আশীর্বাদ করো

উঠানের উত্তর পাশে দক্ষিণমুখো দুর্গামন্দির আর এখানে কখনো সন্ধ্যাবাতি জ¦লবে না, জল না পেয়ে একসময় মরে যাবে তুলসি গাছটা- কাঁসর আর ঘণ্টাধ্বনিতে পবিত্র হবে না এই প্রাঙ্গণ, দুর্গা পূজার সময় এখানে এসে মিলবে না সারা গ্রাম দোল-পূর্ণিমার সময় এ বাড়ির উঠানে হবে না কখনো হোলি খেলা ছোটোভাই রামানন্দ তো দেশ ছেড়ে কিছুতেই যাবে না ও পাকিস্তানেই থাকবে- সরকারি চাকরি ছেড়ে কিছুতেই যাবে না রামানন্দ কিন্তু ও-তো থাকে দূরবর্তী শহরে সুবর্ণগাঁয়ের সঙ্গে তার তো কোনো সংযোগ নেই আজ রাতটাই শেষ রাত মা দুর্গা! তুমি কৃপা করো মা আমি চাঁদমারিতে তোমার পূজা দেবো মা আমায় ক্ষমা করো, কৃপা করো মা দুর্গা! শিবানন্দের চোখে জল রাতের অন্ধকারেও মন্দিরের সন্ধ্যাবাতির আলোতে চিকচিক করছে শিবানন্দের অশ্রুধারা মন্দির থেকে বেরিয়ে উঠানে এসে দাঁড়ালো শিবানন্দ লক্ষ করলে এখন দেখা যাবে- ছোটো একটা কাঠি দিয়ে উঠান থেকে একটুখানি মাটি তুলে কপাল ছোঁয়ালো শিবানন্দ- তারপর একটা কাগজের মধ্যে মাটিটুকু নিয়ে ধীর পায়ে চোখ মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকলো শিবানন্দ ঠিক সে সময় কান পাতলে শোনা যেত, দূর থেকে একটা কুকুরের পৌনঃপুনিক আর্তনাদের শব্দ কী আশ্চর্য, পুকুরের ও-ধারে বাঁশবনে ডাহুকগুলোও যেন কোঁ কোঁ করে উঠলো অজানা কোনো বেদনায়

পাঁচ.

রহমান মুন্সির চোখে পানি- চোখে পানি মমতাজের আজই শেষ রাত চিরচেনা এই বাড়িতে গঙ্গা থেকে হিমেল হাওয়া উঠে আসছে কিন্তু সে হিম-শীতলতায় কী-ইবা এসে-যায় রহমানের- মমতাজের দুদিন আগেই শিবানন্দ পরিবার নিয়ে চলে এসেছে চাঁদমারি গ্রামে আগামীকাল সকালে উঠবে আমাদের এই ঘরে- আমাদের ঘর? না, না, তাদের ঘরে আমাদের ঘর তো এখন সন্ধ্যা নদীর তীরে সুবর্ণগাঁয়ে এশার আজানের ধ্বনি শুনেই রহমান চলে গেল পার্শ্ববর্তী মসজিদে এই মসজিদে কতদিন নামাজ আদায় করেছে রহমান- ঈদের সকালে এখানে এই প্রাঙ্গণেই তো অংশগ্রহণ করেছে ঈদের জামাতে আর কোনোদিন এই মসজিদে আমি আসবো না- আল্লাহ, রহমানুর রাহিম তুমি রহম করো আল্লাহ অদূরে বাড়ির উত্তর-পূর্ব কোণে চোখ পড়লো রহমানের এই তো আব্বা-আম্মার কবর কাল থেকে পারিবারিক এ কবরস্থানে আর আসা হবে না আব্বা! আম্মা! তোমাদের কাছ থেকে চিরবিদায় নিচ্ছে এই অধম রহমান ভালো থেকো, শান্তিতে থেকো তোমরা বেহেশত থেকে আমাদের জন্য দোয়া করো তোমরা কী ভেবে কবরের পাশ থেকে এক চিমটি মাটি হাতে নিলো রহমান যেখানেই যাই আব্বা-আম্মার স্মৃতিমাখা জন্মভূমির এই মাটি সঙ্গে থাক আমার

অন্দরে থেমে থেমে কান্নার শব্দ- আঁচল দিয়ে চোখ মুছছে আর বাক্স-পেটরা বেঁধে নিছে মমতাজ শাশুড়ির দেওয়া শাড়ি আর নাকের নথটা ছোটো বাক্সটায় যত্নে ভরলো মমতাজ মনে মনে ভাবে- যেখানেই যাই এই দোয়া আমার সঙ্গেই থাকবে রকিব ও আলেয়া ব্যাপারটা এখনো ঠিক মতো বোঝেনি ভাবছে নতুন জায়গায় যাবো- অনেক মজা হবে ওদের কাছে ব্যাপারটা বারাসাতের কাজিপাড়ায় মামা বাড়ি বেড়াতে যাবার মতো রাত বাড়ে- গঙ্গা থেকে হিমেল হাওয়া আসে রহমানের ঘরে- ওর শরীরে বুলিয়ে দেয় মমতার পরশ তাতে শান্তি আসে না রহমানের মনে ভাবে- এই গঙ্গার এমন মিষ্টি হাওয়া আর কোনোদিন গায়ে লাগবে না তার সব গোছানো হয়েছে- দূরের পথ- বেশি কিছু তো নেওয়া যাবে না ছোটো পিকআপটা ফজরের আজানের পরপরই এসে পড়বে- দক্ষিণেশ^র ব্রিজ পেরিয়ে বিটি রোড ধরে একসময় গিয়ে থামবে বেনাপোলে- সেখান থেকে বাসে বরিশাল হয়ে সন্ধ্যা নদীর তীরে সুবর্ণগাঁয়ে অনেকটা পথ, ছেলে-মেয়ের জন্য কিছু খাবার সঙ্গে নিতে হবে মমতাজকে ডাক দিয়ে কথাটা বললো রহমান মমতাজ শুয়ে শুয়েই বললো- ওসব আমি ঠিক করে রেখেছি পারলে তুমি একটু ঘুমাও এবার

রহমানের চোখে ঘুম নেই- তন্দ্রার ভাব- সময় কাটে- একসময় ঘুমে আচ্ছন্ন রহমান রহমানের চোখে পড়ে দেওয়ালে মস্ত একটা টিকটিকি আশ্চর্য ব্যাপার! টিকটিকিটাকে খেতে চাইছে ছোটো একটা আরশোলা- খেতে পারছে না- তবু টিকটিকিটাকে তার ছোট্টমুখে ঢোকানোর চেষ্টা করছে আরশোলাটা না, ওটা তো আরশোলা নয়- মনে হচ্ছে কোনো এক বিদেশিনীর মুখ- হ্যাঁ, তাই তো, ওতো দেখছি লাডি মাউন্টব্যাটেনের মুখ টিকটিকি নাকি ওই ম্যাম-সাব? দূর থেকে ভেসে আসছে ফজরের আজানের ধ্বনি ধরফর করে উঠে যায় রহমান এখনই তো এসে যাবে পিকআপ- মমতাজ ওঠো, রকিব আর আলেয়াকে ঘুম থেকে ওঠাও শেষবারের মতো আমাদের মসজিদে ফজরের নামাজটা আদায় করে আসি

ছয়.

অনেক কষ্টে মনের দুঃখ চেপে রেখে দেশের কথা ভাবতে ভাবতে দুদিন কাটিয়ে দিলো শিবানন্দ সুবর্ণগাঁও থেকে চাঁদমারিতে এসে উঠেছে জনার্দন বসুর বাড়িতে আজ সকালেই উঠবে গঙ্গা তীরবর্তী রহমানের বাড়িতে- রহমানের- নাকি নিজেদের বাড়িতে! মনে মনে ভাবে, বিপদের মধ্যেও তো একটা অগতির গতি হলো

-কুঞ্জর মা শোনো, দক্ষিণমুখো এই ঘরটাকে তুমি পূজার ঘর করো

হ্যাঁ, ভালোই হবে পূজার ঘরের জন্য আমিও এ ঘরটার কথাই ভেবেছি প্রতিমা তো আনা হয়নি

-চিন্তা করো না ও আমি দক্ষিণেশ^র মন্দির থেকে এনে দেবো

-আমিও তোমার সঙ্গে যাবো জানো কঞ্জুর বাবা, এত কষ্টের মধ্যেও একটা কারণে আমার মনটা ভালো লাগছে

-বলো কী? কী কারণ বলো তো?

-গন্ধ নদী তো ওই দেখা যায় আমি প্রতিদিন পূজায় গঙ্গার জল দিতে পারবো দেবীকে

-ও তাই বলো শোনো, পশ্চিমের ওই ঘরটা কুঞ্জর জন্য হলে ভালো হয় না?

-ঠিক বলেছো, জানালা দিয়ে গঙ্গা দেখা যায় ওর নিশ্চয়ই ভালো লাগবে

-রান্না ঘরটা বেশ ছোটো আমাদেরটা কত বড়ো ছিল

-সবকিছু কি মনের মতো হয় কুঞ্জর মা

মা-বাবার কথার মধ্যে কুঞ্জলতা ঘরে ঢুকলো শিবানন্দের দিকে তাকিয়ে বললো- বাবা, আমার কিছুই ভালো লাগছে না কোথায় পড়বো, কোথায় স্কুল? আমার পড়ালেখার যে কী হবে? মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে শিবানন্দ বললো- চিন্তা করিস না মা সব ঠিক হয়ে যাবে জনার্দন দাদার সঙ্গে কথা বলে তোকে স্কুলে ভর্তি করে দেবো যা, এখন নিজের ঘরটা ঠিক করে গুছিয়ে নে মা

কুঞ্জলতার মনে পড়ে সুবর্ণগাঁয়ে ওর নিজের ঘরের কথা জানালার পাশেই ছিল একটা শিউলি ফুলের গাছ শরতের সকালে মনে হতো শিউলিতলায় কে যেন ফুলের বিছানা সাজিয়ে রেখেছে মনে পড়ে সহপাঠী বকুলের কথা, মিরার কথা, শাহানার কথা- মনে পড়ে আরও কত কী! সবকিছু আবার নতুন করে আরম্ভ করতে হবে- কত ঝামেলা দেশটাকে এভাবে খণ্ড খণ্ড কেন করলো ওরা? কী লাভ হলো সাধারণ মানুষের? কুঞ্জলতার ঘরে ঢুকেই মলিনা বললো- ‘মা, খেতে আয় অনেক বেলা হলো’ মায়ের ডাকে চাঁদমারি গ্রামে নতুন বাড়িতে নিজেকে দেখতে পেলো কুঞ্জলতা খেতে-খেতে মনে পড়লো তার পোষা বিড়াল টুকির কথা আহা! ওটা এখন কোথায় আছে, কে জানে- খেতে না পেয়ে হয়তো মিউমিউ করে ডাকছে- খুঁজছে কুঞ্জলতাকে খাওয়া হলো না কুঞ্জলতার উঠে গেলো ঘরে গিয়ে জানালা দিয়ে তাকাতেই ওর চোখে পড়লো গঙ্গার জলধারা গঙ্গা তো পবিত্র নদী- ভালোই হলো তবু এই নদী কি জন্মভূমির সন্ধ্যা নদীর মতো আমাকে ভালোবাসবে- মনে মনে ভাবে কুঞ্জলতা

উত্তরপাড়া বাজারে অনেক ঘুরেও মনের মতো তাজা মাছ পেল না শিবানন্দ কী মরার দেশ রে বাবা! সব কেমন যেন শুকনো শুকনো সুবর্ণগাঁয়ের মতো টাটকা শাক-সবজি এখানে নেই কেন? আলুগুলো কেমন যেন লাল-লাল, ঢেঁড়শগুলো মরা মরা মাছের দোকান ঘুরতে ঘুরতে শিবানন্দের মন গেল আরও খারাপ হয়ে সুবর্ণগাঁয়ের বাজারে প্রদীপ দাসের কই মাছ আর জাহাঙ্গীরের পদ্মার ইলিশ না কিনলে শিবানন্দের বাজার তো কোনোদিন শেষ হতো না আর এখানে এই চাঁদমারির বাজারে কই মাছ কোথায়? কয়েকটা চাষের রুই মাছ- তাও আবার কেটে কেটে বিক্রি দূর ছাই, এ কোন দেশে এলাম? প্রদীপের কই মাছ কোথায় এখানে? কোথায় জাহাঙ্গীরের পদ্মার ইলিশ? কোথায় টাটকা শাক-সবজি- মধু গোয়ালার পদ্মার খাঁটি দুধ কোথায়? কোথায় নজু মিয়ার মধুর স্বর- ‘দাদা, কেমন আছেন? বাজার শেষ বুঝি?’

সাত.

অপরাহ্ণে ছেলে অভিজিৎ আর ওর মাকে নিয়ে শিবানন্দের বাড়িতে এসেছে জনার্দন বসু বসতে দেবার মতো এখনও কোনো ব্যবস্থা নেই শিবানন্দের ঘরে একটা মাদুর পেতে সবাই বসে পড়লো অভিজিতের মা কয়েকটা আপেল নিয়ে এসেছে- সেগুলোই কেটে আনলো কুঞ্জলতার মা মলিনা আপেল খেতে খেতে শিবানন্দের দিকে তাকিয়ে জনার্দন বললো:

-কেমন নাগছে শিবানন্দ?

-দাদা, কেমন যে লাগছে তা তোমারে কীভাবে বুঝাই?

-কেন, কী হয়েছে?

-না, তেমন কিছু না

-নতুন জায়গা প্রথম-প্রথম একটু অসুবিধা তো হবেই দুদিন গেলেই দেখবা সব ঠিক হয়ে যাবে

জনার্দন ভরসা দিলো বটে কিন্তু কিছুই ভালো লাগছে না শিবানন্দের থেকে থেকে তার কেবলি মনে পড়ছে সুবর্ণগাঁয়ের কথা- কেবলি মনে পড়ছে গ্রামের বাজারের কথা- তাকে যেন ডাকছে নজু মিয়া আর রমেশ ডাক্তার শিবানন্দ আর নজু মিয়া পাইমারি স্কুলের শিক্ষক, আর রমেশ হোমিওপ্যাথি ডাক্তার তিনজনের খুব বন্ধুত্ব বিকাল হলেই প্রাইমারি স্কুলের মাঠে আড্ডায় মেতে উঠতো তিন বন্ধু কোথায় গেল সেসব দিন! খুব মনে পড়ছে নজু মিয়া আর রমেশের কথা নজু মিয়া খুব ধার্মিক মানুষ স্কুলের আগে ও তিনটা প্রাইভেট পড়াতো খালে-বিলে মাছ ধরতে নজু মিয়া বেশ ওস্তাদ রমেশ সারাদিন হোমিওপ্যাথি ওষুধের বাক্স নিয়ে গ্রামের রাস্তায় ঘুরে বেড়াতো আজ এ গ্রামে তো কাল ও গ্রামে অসুস্থ মানুষ তার কাছে আসে- রমেশ ওষুধ দেয় কেউ ভালো হয়, কেউ হয় না সাতগ্রামের মানুষের কাছে রমেশ ডাক্তার পরম বন্ধু রমেশও বুঝি আর সুবর্ণগাঁয়ে নেই- এমনটাই তো শুনে এসেছি

কিছুটা সময় কাটিয়ে একসময় চলে গেল জনার্দন বসু আরও কিছুটা সময় শিবানন্দ তাকে থাকতে বললো কিন্তু আকাশে মেঘ করেছে- ঝড়-বৃষ্টি হতে পারে তাই স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে দ্রুত চলে গেল জনার্দন বসু কুঞ্জলতার সঙ্গে অভিজিতের তেমন কথা হয়নি বটে, তবে দুজনকে দেখে খুব খুশি-খুশি মনে হয়েছে জনার্দনের মনের কথাটা কি জেনেছে ওরা? অভিজিৎ আর কুঞ্জলতার প্রসন্ন মুখ দেখে জনার্দনও মনে মনে খুব খুশি- কিন্তু মুখে কিছু বললো না যাক না আরও কিছুটা দিন, তারপর দেখা যাবে

গঙ্গার ও-পাড়ে ঘন মেঘ করেছে- আকাশ কালো হয়ে গেছে সন্ধ্যা আসার আগেই সন্ধ্যা নেমেছে চাঁদমারিতে গোয়ালের গাভী আর বাছুরটার কথা মনে পড়লো শিবানন্দের ঝড় তো এসে পড়লো- সুবর্ণগাঁয়ে তার গাভীটাকে কি রহমান গোয়ালে এনেছে এতক্ষণে? তা না হলে যে গাভীটা ভিজে যাবে- ঝড়ে দিক্বিদিক ছুটবে মলিনা চিৎকার করে উঠলো:

-তোমার কী হলো? ঝড়ের মধ্যেও বাইরে দাঁড়িয়ে কেন? ঘরে আসো

-কখন যে ঝড় উঠেছে টের পাইনি

-কী যে বলো? পাগল হলে নাকি?

-না কুঞ্জর মা, আমি ভাবছিলাম...

-কী ভাবছিলে?

-ভাবছিলাম, রহমান কি ঝড়ের আগে গাভীটাকে ঘরে তুলতে পেরেছে? ওর বাচ্ছাটা...

-কী যে বলো? আমাদের বাড়িতেও এখন ঝড় উঠেছে, এখবর তোমায় কে দিলো?

-তা বটে কুঞ্জর মা ভুলে গিয়েছিলাম আমি আছি এখন চাঁদমারি নামের মরার দেশে আমার গাভীটাই আমাকে নিয়ে গেছিলো সুবর্ণগাঁয়ে

কোনো কথা ফোটে না মলিনার মুখে স্বামীর কষ্টটা ভালো করেই বুঝতে পারে মলিনা গাভীটাকে সকাল-বিকাল খুব যত্ন করতো শিবানন্দ সকালে স্কুলে যাবার আগে গাভীটাকে খড় আর খৈল-মিশানো জল অবশ্যই দিয়ে যেত শিবানন্দ বিকালে আবার খড় ও ঘাস দিতো বাচ্চাটাও শিবানন্দকে দেখলে আদরে মুখ বাড়িয়ে দিতো রহমান কি গাভীটার তেমন যত্ন নেবে? নিজের অজান্তেই নিশ্বাস পড়লো মলিনার বাইরে ঝড়ের ঝাপটায় সে নিশ্বাস শোনা গেল না বটে, তবে মনে হলো ওই নিশ্বাসই যেন ঝড় হয়ে জোরে জোরে আছড়ে পড়ছে শিবানন্দের নতুন আবাসে ভালো করে লক্ষ করলে দেখা যেত, মলিনার দুচোখ বেয়ে তখন গড়িয়ে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু

মনের কষ্ট আর ক্লান্তিতে ঝিমিয়ে এসেছে শিবানন্দের শরীর তার মনের কান্নাই কি সন্ধ্যা নদী পেরিয়ে গঙ্গার তীরে ঝড় হয়ে আছড়ে পড়ছে? প্রকৃতি কি মানুষের কষ্টে কাঁদে? বিছানায় এ-পাশ ও-পাশ করতে করতে একসময় ঘুমে আচ্ছন্ন হয় শিবানন্দ- গাড়ি এসে পড়েছে... তাড়াতাড়ি উঠতে হবে গাড়িতে... মলিনাকে ডাক দেয় শিবানন্দ... শিবানন্দ শুনতে পায় রমেশ আর নজু মিয়া তাকে ডাকছে... মধু গোয়ালা একঘড়া দুধ নিয়ে তার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে... উঠানের তুলসি গাছের পাতাগুলো আবার সবুজ হয়ে গেছে... গাভীটা লেজ তুলে হাম্বা-ডাকে বরণ করে নিছে শিবানন্দকে... টুকি দৌড়ে এসে লুটিয়ে পড়েছে কুঞ্জলতার কাছে...সুবর্ণগাঁও প্রাইমারি স্কুলের ঘণ্টা বাজছে ঢং ঢং... উঠানের উত্তর পাশের দুর্গা মন্দিরে বাজছে ঢোল, আর কাঁসর... হীরালাল চক্রবর্তী উচ্চৈঃস্বরে উচ্চারণ করছে-যা দেবী সর্বভূতেষু শান্তিরূপেণ সংস্থিতা...’ মোল্লাবাড়ির মসজিদ থেকে ফজরের আজান শোনা যাচ্ছে... শীত-সকালে গফুর গাছি খেজুরের রস নিয়ে হাজির... প্রদীপ দাস মাছের হাড়ি মাথায় নিয়ে চিৎকার করে বলছে- ‘মাস্টার বাবু, কতদিন আপনাকে বিলের কই মাছ খাওয়াতে পারিনি- এই নেন, দেখেন কত বড়ো কই মাছ এনেছি আপনার জন্য- কতদিন পরে বাড়িতে এলেন মাস্টার বাবু...’

আট.

বাইরে তখনও শোনা যাচ্ছে গঙ্গা থেকে উঠে-আসা হাওয়ার ঝাপটা, হঠাৎ-হঠাৎ মেঘের ডাক আর আকাশের অঝোরকান্নার শব্দ

অলংকরণ : রেজাউল হোসেন

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :