ঈদ এলেই বগুড়ায় বেড়ে যায় খুনের ঘটনা, পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন

১৭ জুন। ঈদের দিন দিবাগত রাত। রুমন নামে এক যুবকের মোটরসাইকেল বগুড়া জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ সার্জিল আহম্মেদ টিপুর গাড়িতে ধাক্কা লাগে। ওই সময় গাড়িতে তার মেয়ে ছিলেন। এ নিয়ে তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। এরই জের ধরে আসামিরা ওই দিন রাত ১২টায় শরিফ শেখ ও রুমনকে মীমাংসার কথা বলে ডেকে নিয়ে খুন করে। এভাবেই প্রতিবছর ঈদের দিনে খুন হন কেউ না কেউ।
ঈদের দিনগুলোতে বগুড়ার কোথাও না কোথাও হত্যাকাণ্ড ঘটতে হবে, এটাই যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে এমনটিই ঘটে আসছে।
শরিফ শেখ ও রুমন হত্যাকাণ্ডসহ চলতি মাসে বগুড়ায় অন্তত ৮টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটলো।
বগুড়াতে কেন এতো খুন? এসব ঘটনা ঘটলেও আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা কোথায় থাকেন? এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে এখন বগুড়াবাসীর মনে।
বগুড়াতে প্রতিবছর ঈদের দিনগুলোতে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও এ নিয়ে পুলিশের কোনো অবজারভেশন নেই।
অভিযোগ রয়েছে শরিফ শেখ ও রুমন হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হওয়ার সময় বগুড়া জেলা পুলিশ সুপারের বাস ভবনে চলছিল ঈদ উৎসব। সেই উৎসবে যোগ দেন বগুড়া জেলার ১২টি থানার অফিসার ইনচার্জগণ। যোগ দেন সবগুলো ফাঁড়ির ইনচার্জ ও তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জও। রাতের শুরু থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে আয়োজন। পুরো জেলার দায়িত্বশীলরা অনুষ্ঠানে ব্যস্ত। ফলে অনিরাপদ হয়ে ওঠে জেলা। এমন মন্তব্য এখন জেলাজুড়ে চলমান।
এর আগে ২০২৩ সালে বগুড়ায় ঈদের ছুটিতে (ঈদুল ফিতর) পৃথক ঘটনায় তিনজন খুন হয়েছে। বগুড়া জেলা পোস্ট অফিস থেকে অফিস সহায়ক এর লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। জেলার নন্দীগ্রাম উপজেলার ভাটরা ইউনিয়নের মনিনাগ গ্রামে প্রতিপক্ষের মারপিটে রবিউল ইসলাম (২১) ও জেলা সদরে অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক রেজাউল করিম পান্না সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন।
২০২২ সালে ঈদুল ফিতরের রাতে বগুড়ায় আব্দুর রাজ্জাক সরকার (৬৫) নামে এক আমেরিকা প্রবাসীকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। ওই বছরের ৩ মে দিবাগত রাত দেড়টায় সদর উপজেলার বাঘোপাড়া মহিষবাথান এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
২০২০ সালে ঈদ (ঈদুল ফিতর) উপলক্ষে সেমাইয়ের ব্যবসায় লাভের মাত্র ৪০০ টাকা কম দেওয়া নিয়ে বিরোধের জের ধরে বগুড়ার শিবগঞ্জে ভাতিজার ছুরিকাঘাতে চাচা শামীম হোসেন (৩৫) খুন হয়েছেন। ঈদের আগের রাতে (২৪ মে) উপজেলার দেউলী ইউনিয়নের বিহারপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। ২০২০ সালে অপর ঘটনায় বগুড়ায় ঈদের দিন এক তরুণকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। বগুড়া শহরের উপকণ্ঠ দ্বিতীয় বাইপাস সড়কের সাবগ্রাম জিগাতলা এলাকায় এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
নিহত তরুণ মো. বিটল মিয়া (২০) বগুড়া সদর উপজেলার রবিবাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা ও বগুড়া শহরের একটি টেইলার্স দোকানের শ্রমিক ছিলেন।
২০১৯ সালের ১ জুন বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলায় ঈদের (ঈদুল ফিতর) ছুটি কাটাতে নিজ গ্রামে আসা নাঈম হোসেন (১৯) নামে এক যুবককে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। নাঈম ওই গ্রামের ওমর ফারুকের ছেলে। সে ঢাকায় শ্রমিকের কাজ করত।
রাত পোহালেই বীভৎস খুনের দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সোশ্যাল মিডিয়া খুললেই লাশের ছবি। প্রায়ই খুন হচ্ছে বগুড়ায়। কখনো জেলা শহরে, কখনো উপজেলা শহরে। প্রত্যন্ত গ্রামও বাদ নেই খুনের তালিকায়। ধান ক্ষেত, নদী নালা এমনকি শহরের ড্রেনগুলোতেও মিলছে লাশ।
বগুড়া জেলা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী ২০২১ সালে বগুড়ায় খুনের ঘটনা ঘটেছে ৮২টি। ২০২২ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৯-এ। ২০২৩ সালের ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত খুন হয়েছে ৮০ জনের উপরে। চলতি বছরেও ২০টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এসব খুনের বেশিরভাগ হয়েছে চিহ্নিত সন্ত্রাসী এবং কিশোর গ্যাংদের দ্বারা।
প্রায় ঈদেই যখন খুনের ঘটনা ঘটছে ঠিক তখন গভীর রাত পর্যন্ত থানা এবং জেলার পুলিশ কর্মকর্তারা এক সাথে উৎসবে মেতে ওঠেন। এতে পুরো জেলা অনিরাপদ হয়ে ওঠে। এমন মন্তব্য করে সুশাসনের জন্য নাগরিক বগুড়া জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন ইসলাম তুহিন বলেন, মুখ চেনা কিছু ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ দিয়ে পুলিশ সুপারের বাস ভবনে প্রতি ঈদে যে আয়োজন হয় সেটা অনেকটা দৃষ্টিকটু। আর এক সঙ্গে সবগুলো ওসি তাদের স্টেশন কীভাবে ত্যাগ করে ওই আয়োজনে যোগ দেয় সেটা আমার মাথায় আসে না। আমি জানতে চাই ওসিদের সার্ভিস রুলে কী স্টেশন ত্যাগ করা এতোটাই সহজ?
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) আব্দুর রশিদের সঙ্গে দেখা করে খুনের ঘটনা ও সবগুলো থানা, ফাঁড়ি, তদন্তকেন্দ্রের ওসিদের নিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত উৎসবের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি।
ঈদের দিনগুলো খুন হয় কেন? আপনাদের কোন অবজারভেশন আছে কিনা জানতে চাইলে সে বিষয়েও তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি।
তবে ঈদের দিনগুলোতে পুলিশের বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া থাকে বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে কথা বলতে বগুড়ার পুলিশ সুপার (অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) সুদীপ কুমার চক্রবর্তীর সরকারি নাম্বারে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তিনি ফোন রিসিভ না করায় এ বিষয়ে তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
(ঢাকাটাইমস/২১জুন/পিএস)

মন্তব্য করুন