একপাক্ষিক কোটা কিংবা কোটাহীনতা নয়, প্রত্যাশা সাম্যের বাংলাদেশ

কোটার স্বপক্ষে কিংবা বিপক্ষে আলোচনা উত্থাপিত হলেই মুক্তিযুদ্ধের মতো স্পর্শকাতর বিষয়টি সামনে দাঁড়ায় বলে স্বাধীনভাবে মতামত দেওয়াটাও একটু কঠিন। কোটা বিরোধিতার কথা উঠলে কেবল মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনীদের জন্য বরাদ্ধকৃত কোটা আলোচনাটাই ফ্রন্টলাইনে চলে আসে। নিরপেক্ষভাবে কোটা সম্পর্কে কথা বলার ক্ষেত্রে এটাও এক বড়ো রকমের বাঁধা। সেজন্য ঢালাওভাবে কোটা বিরোধিতা করা কিংবা চলমান কোটা নীতির সম্পূর্ণ পক্ষে থাকা- দুটোই অযৌক্তিক বলে মনে হয়। যে চেতনায় বাংলাদেশের বীর সন্তানগণ মহান মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, শত্রুসেনার বিপক্ষে লড়তে জীবন বাজি রেখেছিল সেই আদর্শের সঙ্গে কোটা সম্পূরক না কি সাংঘর্ষিক সেটা নিয়েও পক্ষে-বিপক্ষে প্রচুর আলোচনা হতে পারে। আবার প্রতিবন্ধী কিংবা উপজাতিদেরকে কোনো বাড়তি সুযোগ না দেওয়াও ন্যায্য মনে হচ্ছে না। তবে শতের মধ্যে ৫৬% কোটায় আর বাকি ৪৪% মেধায় চাকুরি হবে- এই সমীকরণ রাষ্ট্রের স্বার্থে কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। এখানে বৈষম্যের দুর্গন্ধ যে প্রবল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের চাকরির বয়স আছে এ সংখ্যা একেবারেই সামান্য। মুক্তিযোদ্ধা কোটা যদি বীর যোদ্ধাদের ছেলে-মেয়ে পর্যন্ত বহাল রাখা হতো তবে এটা নিয়ে সেভাবে বিতর্ক তৈরি হতো না। মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনীদেরকেও ছেলেমেয়েদের মতো কোটা দেওয়া হয়- এই নীতি সম্মুখে আসার পরে ২০১৮ সালে দেশব্যাপী তুমুল আন্দোলনের মুখে সরকার কোটা পদ্ধতি বিলুপ্ত করে। সংসদে সেদিন প্রধানমন্ত্রী কিছুটা রাগত স্বরেই বলেছিলেন যে- নারীদের জন্য তিনি কোটা রাখছেন সেই নারীরাই কোটাবিরোধি আন্দোলনে নামছে। কাজেই প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির নিয়োগে কোনো কোটা থাকবে না।
তবে আদালতের মাধ্যমে কোটা পদ্ধতি আবারও বহাল হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা, চাকুরি প্রত্যাশীরা রাজপথে নেমে এসেছে। মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্মের একাংশ এবং দেশের শিক্ষাবিদ, সুশীল সমাজ বৃহদাংশ এবং বুদ্ধিজীবীদের সমর্থনও তাদের পক্ষে। এদের মধ্যে অনেকের মতে সম্পূর্ণ কোটা রাখা কিংবা একেবারেই কোটা বিলুপ্ত করা- কোনোটাই সম্পূর্ণ যৌক্তিক মনে হচ্ছে না বরং সংশোধন করে কোটার হার সহনীয় করা যেতে পারে। কোটা পদ্ধতি বহাল রাখলে একদিকে মেধাবীদের দেশে ধরে রাখা যাবে না অন্যদিকে কোনো কোটা না থাকলে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী, শারীরিকভাবে অক্ষম শিক্ষিতদের সঙ্গে অন্যায্য আচরণ করা হবে।
গতকালও দেখা গেছে শিক্ষার্থীদের কোটাবিরোধী আন্দোলন রাজধানীর শাহবাগ চত্বর থেকে সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই আন্দোলন শুরু করলেও এখন দেশের প্রায় সবগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়- এমনকি সরকারি কলেজগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ছে এই আন্দোলন। ক্রমাগত কোটাবিরোধী এই আন্দোলন দেশব্যাপী বিস্ফোরোন্মুখ হয়ে ওঠতে থাকলেও এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো আলোচনার উদ্যোগ কেন নেওয়া হচ্ছে না তা বোধগম্য নয়। শিক্ষার্থীরা এই কোটাবিরোধী আন্দোলনে নেমে তাদের ক্লাস-পরীক্ষাও বর্জন করে চলেছে। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে শিক্ষার্থীরা রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়সংলগ্ন সড়ক-মহাসড়কগুলোতে এবং রেল চলাচলের স্থানগুলোতে গতকালও অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে। রেল লাইন ও সড়ক-মহাসড়কের ওপর এসব অবরোধ-বিক্ষোভ হওয়ার সময় ট্রেন ও বাস চলাচল বন্ধ থাকছে। এতে যে বিপুল সংখ্যক যাত্রীর যাতায়াতে বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে তা বলাই বাহুল্য। চলমান এই কোটাবিরোধী আন্দোলন ও বিক্ষোভ চরম আকার ধারণ করার আগেই কি কর্তৃপক্ষের এ ব্যাপারে আশু সমাধানে উপনীত হওয়া সংগত নয়? বিগত পাঁচ বছর যে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোনো কোটা পদ্ধতি ছিল নাÑ সেটা সবার জানা। এই পাঁচ বছরে সম্পূর্ণ মেধার ভিত্তিতেই নিয়োগ পেয়েছেন সরকারি চাকরিপ্রার্থীরা। শিক্ষা ও সরকারি কর্মসংস্থানবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন- বিশ্বের কোনো দেশেই এত কোটা পদ্ধতি চালু নেই। বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় চাকরিতে সাধারণত অনগ্রসর ও পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধীদের জন্যই কোটা রাখা হয়। তবে তা বেশি নয়। বাংলাদেশে সর্বমোট ৫৬ শতাংশ কোটা রাখার ব্যাপারটিকে তারা অতিরিক্ত বিবেচনা করছেন। এতে মেধার মূল্যায়ন অনেক কমে যায়।
কোটার যৌক্তিক বিন্যাস করে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান করা যায় বলে আমি মনে করি। ৫৬% কোটা থেকে সংকোচন করে ১৫% কোটা বহাল রাখলে সেটা বিক্ষোভকারীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেতে পারে। জনসংখ্যার অনুপাত অনুসারে উপজাতি ও প্রতিবন্ধী কোটা নির্ধারণ করতে হবে। শর্তসাপেক্ষে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ১০% নিয়ে আসতে হবে। তাতে উভয় দিকের স্বার্থ রক্ষা হবে বলে মনে করি।
মুক্তিযোদ্ধার কোটার ক্ষেত্রে প্রথমত- মুক্তিযোদ্ধার সন্তান যিনি কোটা ব্যবহার করে চাকরি পেয়েছেন তার পরবর্তী প্রজন্মের কেউ আর কোটায় আবেদন করতে পারবে না। চাকুরি থাকার পরেও যারা উত্তরসূরিদের যোগ্য করে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে কিংবা চাকরিজীবী মা-বাবার সন্তান হয়েও যারা নিজেদেরকে যোগ্য করে গড়ে তুলতে পারেনি তাদেরকে আর কোটাধারী হিসেবে বিবেচনা করা উচিত নয় কোনোভাবেই।
দ্বিতীয়ত- মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের মধ্যে একজন কোটায় চাকরি পারে। বাকিরা সেই কোটা আর ব্যবহার করতে পারবে না। তবে পঙ্গু ও শহিদ মুক্তিযোদ্ধা যারা আছেন তাদের উত্তরসূরিদের ক্ষেত্রে শর্ত সামান্য শিথিল করা যেতে পারে। তাদের সব সন্তান যোগ্য হলে চাকুরি পাবে তবে নাতি-নাতনীদের কোটাধারী হিসেবে বিবেচনা করা হবে না।
তৃতীয়ত- মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিদেরকে কোটার সুবিধা দেওয়া যাবে না। এটা কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। কোটাও এক প্রকার সম্পদ। উত্তরসূরি নির্ধারণের নীতিমালা অনুযায়ী বাবার সম্পদ ছেলে-মেয়ে পায়; সরাসরি নাতি-নাতনিরা নয়। কাজেই মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের এমন কোনো অবদান নেই, যে কারণে তাদের সন্তানদেরকেও সেই কোটার রেশ দিতে হবে। এটা বহাল থাকলে বরং খোঁটা বাড়বে। আত্মসম্মানের প্রশ্নও জড়িত। কোটাধারীদের এখন সোজা চোখে দেখা হয় না। কোটা সামাজিক টিটকারিতে পরিণত হয়েছে।
উপজাতি ও প্রতিবন্ধী কোটায় যথাক্রমে ৩% ও ২% চাকুরি দেওয়া যায়। বাকি সব কোটা যেমন জেলা কোটা, নারী কোটা এসবের কোনো প্রাসঙ্গিকতা ও যৌক্তিকতা এখন আর অবশিষ্ট নেই বলেই ধর্তব্য। বর্তমান বাংলাদেশ রাজধানী কিংবা উপজেলা শহর- কেউ আরো কোনো ক্ষেত্রে কারো থেকে পিছিয়ে নেই। আগামী ১০ বছরের জন্য এই ১৫% কোটা বহাল রেখে পরবর্তী অবস্থা বিবেচনায় সংকোচন কিংবা সংশোধন করা যেতে পারে। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, কোনো পদের বিপরীতে কোটাধারী না পাওয়া গেলে অবশ্যই মেধা কোটা থেকে তা পূরণ করতে হবে। কোনোভাবেই কোটাধারীর জন্য কোনো পদ সংরক্ষণ করা কিংবা পরবর্তী সময়ের জন্য পদ শূন্য রাখা যাবে না।
মুক্তিযুদ্ধের ৫৪ বছর অতিবাহিত হয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সব সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা এবং সমান সম্মান দেয়নি। তবে আওয়ামী লীগ সরকার কখনোই মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান করেনি। মুক্তিযোদ্ধা ভাতা থেকে শুরু করে তাদের জন্য চিকিৎসার সুযোগ, আবাসনের ব্যবস্থা, যাতায়াতের ব্যবস্থাসহ নানাবিধ সুযোগ ও সম্মান নিশ্চিত করেছে। প্রয়োজনে তাদের মাসিক ভাতা আরও বৃদ্ধি করা যেতে পারে, নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ এককালীন ডিপোজিট হিসেবে প্রদান করার কথাও ভাবা যায়। কিন্তু মেধাবীদের সঙ্গে প্রহসন করে কোটার বেড়াজালে দেশকে স্থবির করে রাখাও ঠিক হবে না। মেধাবীদের অন্তর থেকে দেশপ্রেম কমে গেলে সার্বিক অকল্যাণ প্রবল হবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং স্বাধীন বিচার বিভাগ নিশ্চয়ই জনকল্যাণ ও বেকারদের অনুভূতি পর্যালোচনা ও প্রত্যক্ষ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। যেই উত্তম আদর্শকে বুকে ধারণ করে মহান মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল তার মূলমন্ত্র ছিল সাম্য, ন্যায় ও বৈষম্যহীন সমাজ নিশ্চিত করা। সেই চেতনার কথা বলে বৈষম্য বজায় রাখলে মেধাবীদের প্রতি অবিচার করা হবে। রাষ্ট্রের বীর সন্তানদের জীবন বাজি রেখে দেশের জন্য লড়ে যাওয়া এবং পাকিস্তানের বর্বর শোষকদের থেকে লাল-সবুজের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনা অকুতোভয় বীর সেনানীদের অনেকেই করুণার কোটাকে অপমানজনক মনে করে। তাদের প্রজন্মও কোটায় চাকরি পাবে- তাদের অনেকেই এই চেতনা লালন করে না।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদেরকে ক্লাসে এবং পড়ার টেবিলে পাঠানোর উদ্যোগ নিতে হবে। এবারেও নিশ্চয়ই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন। স্বাধীন বিচার ব্যবস্থায় কোনো প্রভাব ও প্রলোভনে না জড়িয়ে ফ্যাক্ট বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিবেন- ব্যক্তিগতভাবে সেই আশা ও বিশ্বাস আছে। সংকট যাতে ঘনীভূত না হয়, সংশয় যাতে না বাড়ে তা মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মাননীয় মন্ত্রীর এ ঘোষণাতেই স্পষ্ট হতে পারে। তরুণ প্রজন্মের মাঝে বৈষম্যের ঘৃণা প্রবল ও প্রকট হতে দেওয়া যাবে না। অচিরেই এই বিতর্কের সমাপ্তি হোক।
বৈষম্য যাতে না বাড়ে এবং প্রাপ্যরাও যাতে বঞ্চিত না হয় সে বিষয়ে ব্যালেন্স করতে হবে। এই বাংলাদেশ আমাদের সবার প্রিয় দেশ। এখানেই জন্ম, বেড়ে ওঠা আবার এই মাটিতেই শেষবার শোবার জন্য ফিরতে হবে। মুক্তিযোদ্ধা কোটার সমালোচনা করতে গিয়ে কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান-অসম্মান করছেন এটা কোনভাবেই আকাঙ্ক্ষিত নয়। দেশের মেধাবী শ্রেণি থেকে সবার প্রতি সম্মান প্রদর্শন আশা করে সবাই। মেধাবীরা যুক্তিকে স্বার্থ আদায়ের অস্ত্র বানাবে। স্লোগানে স্লোগানে ন্যায্য দাবির কথা বলবে। কোনো সহিংসতার পথে পা বাড়াবে না। রাষ্ট্রও যেন শিক্ষার্থীদের সম্মান করে। ব্যক্তি স্বার্থের পক্ষ-বিপক্ষ নয় বরং সাম্যের সোনার বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি আমরা।রাজু আহমেদ: কলাম লেখক ও গবেষক

মন্তব্য করুন