কোটা বিষয়ে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি

আলী রেজা
  প্রকাশিত : ১৩ জুলাই ২০২৪, ১১:০৬| আপডেট : ১৩ জুলাই ২০২৪, ১১:২১
অ- অ+

একদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণের নতুন পেনশন স্কিম প্রত্যয়বিরোধী শিক্ষক আন্দোলন অন্যদিকে সাধারণ শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রত্যাশীদের কোটাবিরোধী আন্দোলন মিলে দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অচলাবস্থা চলছে। এই অচলাবস্থার মধ্যেই যুক্ত হয়েছে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) প্রশ্ন ফাঁসের চাঞ্চল্যকর খবর। প্রশ্ন ফাঁসকারী চক্রের হোতা পিএসসির চেয়ারম্যানের গাড়ি চালক আবেদ আলী বিষয়টি স্বীকার করেছে। ইতোমধ্যে ১৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পিএসসির বেশকিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে সামায়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। সবমিলে দেশের শীর্ষ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন নৈতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। এ বিষয়গুলো নিয়ে এখন জনমনে চরম হতাশা। তবে বেকারত্বের এই দেশে চাকরিপ্রার্থীদের হতাশাই সবচেয়ে বেশি। এ হতাশার কোনো সীমা নেই। একজন শিক্ষার্থী শিক্ষাজীবনের প্রতিটি ধাপ সফলতার সঙ্গে শেষ করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের জন্য প্রতিযোগিতায় নামেন। বুকভরা আশা নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির ইন্টারভিউ দেন। মামা-খালু-দুলাভাই কিংবা টাকা ও রাজনীতির প্রভাবে অনেকের চাকরি হয়ে যায়। এর বাইরে থাকা সাধারণ মেধাবীরা অনেকেই বঞ্চিত হন। এ বঞ্চনা নিয়েই দ্বারে দ্বারে ঘুরেন এসব চাকরিপ্রার্থী বেকার যুবক-যুবতী। এ পরোক্ষ বঞ্চনার জন্য তারা কোনো প্রতিবাদ বা কারো কাছে নালিশও জানাতে পারেন না।

প্রত্যক্ষভাবে মেধাবীদের বঞ্চিত করার একটি বিধিবদ্ধ পদ্ধতি হলো কোটাব্যবস্থা। দেশের সব অঞ্চল ও সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে বৈষম্য কমিয়ে আনার জন্য জেলা কোটা, নারী কোটা, উপজাতি কোটা ও প্রতিবন্ধী কোটা প্রবর্তন করা হয়েছিল। কোটাব্যবস্থার মাধ্যমে নিশ্চিতভাবেই বৈষম্য কমেছে। দেশের সব অঞ্চল এখন উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় শামিল হয়েছে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে এখন কোটার শতকরা হারও ক্রমশ কমে যাওয়া যুক্তিসংগত। কিন্তু কোটার শতকরা হার কমেনি। ৩০% মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ ৫৬% কোটা বহাল রাখার আদেশ দিয়েছে আদালত। আদালতের বিষয় বলে সরকারও সিদ্ধান্ত নিতে এগিয়ে আসছে না। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বীরমুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যাও দিন দিন কমে যাচ্ছে। একদিন কোনো মুক্তিযোদ্ধাই জীবিত থাকবেন না। সুতরাং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান জানানো এবং তাঁদের জীবনের আর্থিক নিরাপত্তা বিধান করা রাষ্ট্র ও জনগণের পবিত্র দায়িত্ব। এ দায়িত্ববোধ থেকেই সরকার জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীরমুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা প্রবর্তন করেছে এবং তা পর্যায়ক্রমে বর্ধিত করা হচ্ছে। বীরনিবাস প্রকল্পের আওতায় পর্যায়ক্রমে বীরমুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আবাসন ব্যবস্থা করে দেওয়া হচ্ছে। যানবাহন, হাসপাতাল, অফিস-আদালতে বীরমুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আলাদা আসন ও বিশেষ মর্যাদার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এসব পদক্ষেপের কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা, অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা পরিবারে আর্থিক নিরাপত্তা ও সচ্ছলতা এসেছে। এজন্য সরকারকে সর্বস্তরের মানুষ সাধুবাদ জানাচ্ছে।

কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম নামে বংশপরম্পরায় সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৩০% কোটা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে বিতর্ক। সকল বিবেচনাবোধসম্পন্ন মানুষেরই বক্তব্য হলো- সরকারের এই বিশেষ কোটা সুবিধা প্রথমত জাতির সর্বশ্রেষ্ট সন্তান মুক্তিযোদ্ধারা পেয়েছেন; এরপর তাদের সন্তানরা পেয়েছেন; এটা নিশ্চয়ই ভালো। এ নিয়ে কখনো কারো মনে বিন্দু পরিমাণ কোনো প্রশ্নের উদ্রেক হয়নি। প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে তখন যখন মুক্তিযোদ্ধাদের তৃতীয় প্রজন্ম অর্থাৎ তাদের নাতি-নাতনিদের জন্যও এই কোটা পদ্ধতি বহাল রাখা হচ্ছে। এটা স্পষ্টতই বৈষম্য এবং এই বৈষম্য রাষ্ট্রীয় বৈষম্য হিসেবেই উল্লেখ করা যায়। এই কোটা পদ্ধতিটি যাদের জন্য প্রথম করা হয়েছিল এখন তাদের মনেও নানা ধরনের প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। চলমান এ বিতর্কের প্রেক্ষিতে অনেক বীরমুক্তিযোদ্ধাও এখন বলতে শুরু করেছেন চাকরিতে কোটা পাওয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করিনি। অত্যন্ত যুক্তিসংগত কথা। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীরমুক্তিযোদ্ধাগণ শুধু দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্যই যুদ্ধ করছিলেন। এখন মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য চাই মেধাবী প্রজন্ম। দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য প্রয়োজন মেধাবী ও দক্ষ প্রশাসন। সরকারি চাকরিতে বিভিন্ন কোটায় অর্ধেকের বেশি নিয়োগ করা হলে দেশে মেধাবী ও দক্ষ প্রশাসন গড়ে তোলা সম্ভব নয়। গ্রামীণ অবকাঠামো ও আত্মকর্মসংস্থান বৃদ্ধির ফলে গ্রামীণ জনপদেও এখন দৃশ্যমান উন্নয়ন ঘটেছে। দেশের সকল জেলার সার্বিক উন্নয়ন বিবেচনায় এখন জেলা কোটা কমিয়ে আনা যায়। উপবৃত্তির আওতায় এনে নারীশিক্ষার প্রসার ও উন্নয়ন ঘটানো হয়েছে এবং বিশেষ কোটায় নিয়োগের ফলে নারীরা এখন প্রচলিত সকল পেশায় দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে।

পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল বিবেচনায় নারীরা এখন পুরুষদের চেয়েও এগিয়ে গেছে। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ এখন নারী উন্নয়নের রোল মডেল।

এখন নারীদের জন্য বিশেষ কোটার প্রয়োজন নেই বললেই চলে। বীরমুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা বৃদ্ধির ফলে তাঁদের পরিবারে আর্থিক নিরাপত্তা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বিবেচনায় মুক্তিযোদ্ধা কোটার শতকরা হার যুক্তিসংগতভাবে কমিয়ে আনার বিষয়টি ভাবা যেতে পারে। এভাবে সকল কোটার শতকরা হার কমিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সুযোগ বৃদ্ধির চেষ্টা করা যেতে পারে।

বিভিন্ন সরকারি চাকরিতে পোষ্য কোটার যে ব্যবস্থা আছে সেটি নিয়েও ভাবার সময় এসেছে। কারণ যিনি সরকারি চাকরি করছেন তার সন্তানই যদি আবার সেই চাকরিতে কোটা পেয়ে যায় তাহলে একটি সামাজিক বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। বৈষম্য কমিয়ে আনার জন্য বরং যে পরিবারে সরকারি চাকরিজীবী নেই সেই পরিবারের জন্য বিশেষ কোটার ব্যবস্থা করা যুক্তিসংগত। যার আছে তার বদলে যার নেই তাকে দেওয়াই ন্যায়সংগত। ফলে যেসব পরিবারে এখনো কেউ সরকারি চাকরিতে নেই সেসব পরিবারের জন্য বিশেষ কোটার ব্যবস্থা রাখা উচিত। এতে পরিবারটি সরকারি কর্মকাণ্ড ও সরকারি সেবা প্রদানের সুযোগ পাবে। দেশের সব পরিবারে অন্তত একজন করে সরকারি চাকরিজীবী থাকলে তা সরকারের জন্যও সুবিধাজনক। তবে সব ধরনের কোটাই সাময়িক সময়ের জন্য হওয়া বাঞ্ছনীয়। দীর্ঘকাল ধরে কোটা ব্যবস্থা চলতে থাকলে কোটার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা খুবই স্বাভাবিক। যে আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় কোটা ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের ফলে সে বাস্তবতার পরিবর্তন ঘটেছে। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর বদলে এখন এগিয়ে যাওয়া জনগোষ্ঠীই অধিক হারে কোটা সুবিধা ভোগ করছে। সুতরাং কোটা পদ্ধতি নিয়ে এখন নতুন করে ভাবতে হবে।

কোটা সংস্কারের দাবি নিয়ে কোটাবিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগে। সে আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার নির্বাহী ক্ষমতাবলে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। দাবি ছিল সংস্কারের, কিন্তু সরকার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরির ক্ষেত্রে পুরো ব্যবস্থাটিই বাতিল করে দেয়। এতে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরিপ্রত্যাশীদের মধ্য থেকে আদালতে রিট করা হয়। রিটের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত কোটা ব্যবস্থা বহাল রাখার আদেশ দেন। এই আদেশে বিক্ষুব্ধ হয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা আবার কোটাবিরোধী আন্দোলনে নামে। আন্দোলন চলছে। কিন্তু সরকার বরাবরের মতো এর দায় বিরোধীপক্ষের রাজনৈতিক দলের ওপর চাপাতে চাচ্ছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা এদেশের ছাত্র ও যুবসমাজ। এদের দাবি গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া জরুরি। আগামী দিনের বাংলাদেশ এই ছাত্র ও যুবশক্তির দ্বারাই পরিচালিত হবে। এরাই হবে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের কারিগর। আন্তরিকভাবে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বসে কোটার ব্যাপারে একটি যুক্তিসংগত সিদ্ধান্তে আসা সরকার পক্ষের দায়িত্ব। এ বিষয়টি নিয়ে কেউ যেন অপরাজনীতি করার সুযোগ না পায় সেদিকেও সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক শুরু থেকেই বলে আসছেন কোটা আন্দোলনকারীদের ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখা হচ্ছে। তবে খুব বেশি কালক্ষেপণ করা উচিত হবে না। দ্রুত সমাধানের দিকে এগিয়ে যাওয়াই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। এরই মধ্যে কোটা আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করে আন্দোলন চলমান রেখেছে বিভিন্ন কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এতে জনদুর্ভোগ বাড়ছে। সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ এ আন্দোলন প্রতিহত করার চেষ্টা করছে। এতে ছাত্রলীগের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। কারণ কোটা সংস্কার আন্দোলনে জনসমর্থন ক্রমশ বাড়ছে বলেই মনে হয়।

দলমত নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করা সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। বর্তমান সরকার সে দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন আছে বলে বিশ^াস করি। কোটা কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা হতে পারে না। সময়বাস্তবতা অনুযায়ী এর হার বাড়তে বা কমতে পারে। দেশের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক অবস্থা, নারী উন্নয়ন ও বীরমুক্তিযোদ্ধাদের ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপট বিবেচনায় জেলা কোটা, নারী কোটা ও মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংস্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের মেধাকে গুরুত্ব দিতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে বদ্ধপরিকর। আর জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের জন্য মেধা ও দক্ষতার কোনো বিকল্প নেই। বিশে^র সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে আমাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে আরো অনেক দূর এগিয়ে যেতে হবে। শিক্ষা ও গবেষণায় আরো উৎকর্ষসাধন করতে হবে। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকার জন্য বিশেষ কোটার বদলে বিশেষ মেধার প্রয়োজন। তাই মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে কোটা বিষয়ে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি।

আলী রেজা: কলাম লেখক ও কলেজ শিক্ষক। পিএইচডি গবেষক, ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা: সব আসামির খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতি পেল রাষ্ট্রপক্ষ
সরকার নির্ধারিত হাসিলের বেশি আদায় করলে কঠোর ব্যবস্থা: ডিএমপি কমিশনার
মেসির রেকর্ডে বড় জয় মিয়ামির
ট্রেনে ঈদযাত্রা: প্রথম দিনে টিকিটবিহীন ৩৭ যাত্রীর শাস্তি
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা