বিএনপিতে ‘রবি’ ডুবছে
গণমাধ্যমকর্মী তামিম হত্যাকাণ্ডে সরাসরি সম্পৃক্ততার অভিযোগ এসেছে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শেখ রবিউল আলমের নামে। এমন অভিযোগে কতটা বিব্রত বিএনপি? দখল, চাঁদাবাজি, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে নেতাদের জড়িত থাকতে মানা করার পরও যাদের নাম নেতিবাচকভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে তাদের নিয়ে কতটা অস্বস্তিতে বিএনপির হাইকমান্ড? শেখ রবি কি দলের প্রভাবশালী নেতা তত্ত্বে রেহাই পেয়ে যাবেন? না-কি জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা তারেক রহমান ছাঁটাই করবেন ধানমন্ডি থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির হয়ে অংশ নেওয়া শেখ রবিউল আলমকে? ঢাকা মহানগর বিএনপির অন্দরে ও বাহিরে এখন আলোচনা শুধুই রবিময়।
৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর দখল, পাল্টা দখল আর অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে যেসব রাজনীতিকের নামে পৃষ্ঠপোষকতা করার অভিযোগ ছিল শেখ রবি তার প্রথম কাতারেই ছিলেন ও আছেন। এমনকি মিডিয়া অফিসে হম্বিতম্বি, মালিকানা নেওয়ার চেষ্টাও শেখ রবির তরফে হয়েছে। এ নিয়ে বিএনপির বিভিন্ন মহলে কানাঘুষা ছিল। কিন্তু শেখ রবি ধরাছোঁয়ার বাইরেই ছিলেন। এখন সরাসরি মিডিয়াকর্মী হত্যায় নাম আসায় বিপাকে পড়লেন রবি। আর কিছুটা হলেও বিপাকে ফেললেন বিএনপিকেও।
রবির বিষয়ে জানতে ঢাকাটাইমস যোগাযোগ করেছিল বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘টেলিভিশনের মাধ্যমে সংবাদটি আমার নজরে এসছে। রবি নাকি মহানগর বিএনপির বড় নেতা, আজকে দেখলাম কোনো একটা প্রতিষ্ঠানের মালিকও। সেটা যাই হোক উনি যদি বিধি ও দলের গঠনতন্ত্র মোতাবেক কাজ না করেন, কোনো হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থেকে থাকেনে তাহলে তার বিহিত ব্যবস্থা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী করবে, দলও অবশ্যই করবে। সে বিষয়টি নিশ্চিত করে আমি বলতে পারি, আমার দল কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে বিশ্বাস করে না। কারণ, দেশে আওয়ামী লীগই সন্ত্রাস করছে, বিএনপি অতীতেও করে নাই, এখনো করার চিন্তা নাই। রবিউলের বিষয়ে দলের হাইকমান্ড নিশ্চয়ই সিদ্ধান্ত নেবে। দলও তদন্ত করবে, তদন্তে যদি সে অপরাধী প্রমাণিত হয় তাহলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবস্থা নেবে, আমার দলও উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে। আমি মনে করি, বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসীর জায়গা হবে না।’
বিএনপির সাবেক এই চিফ হুইপ আরও বলেন, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ১৫ বছর দেশের বাইরে থেকে সব নির্যাতন-নিপীড়ন, মামলা-হামলা সহ্য করে দলকে সুরক্ষিত করে আন্দোলন-সংগ্রামে রেখেছেন, একটা লোকও কোনোদিন দালালি করে নাই, আওয়ামী লীগে যোগদান করে নাই, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে নাই, আওয়ামী লীগ তবুও প্রত্যেককে সন্ত্রাসী মামলা-হামলা দিয়ে জর্জরিত করে রেখেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জিত হওয়ার পর আমাদের নেতা তারেক রহমান স্পষ্ট করে দিয়েছেন— দলের কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারবেন না। এবং কেউ যদি চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত থাকেন তাৎক্ষণিকভাবে দল থেকে বের করে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।’
একই বিষয়ে ঢাকাটাইমস কথা বলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান রিপনের সঙ্গে। অকপটে তিনি বললেন, ‘শুধু রবি কেন যিনি দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করবেন, বিএনপি তার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেবে।’
যদি তা-ই হয়, তাহলে তো কপাল পুড়তে চলেছে রবির। বিএনপির রবি যদি অস্তমিত হয় এটা কি দলের সব পর্যায়ে হাইকমান্ডের বার্তা নয়?
কিন্তু হাইকমান্ডের বার্তায় কতটুকু নড়েচড়ে বসছেন বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা? তারেক রহমানের কঠোর মনোভাব, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও কেন বারবার নানা বিতর্কে নাম আসছে কিছু বিএনপি নেতার? খায়রুল কবীর খোকন, মাহবুবউদ্দীন খোকন শোকজ খেয়েছেন। একজন সাংগঠনিক সম্পাদক ও অঙ্গসংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের পদ স্থগিত হয়েছে। ঢাকা উত্তরসহ কয়েকটি ইউনিটে কমিটি বিলুপ্ত হয়েছে। তবু কেন বাগে আনা যাচ্ছে না সবাইকে। এ কি তবে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যে দীর্ঘকালের পচন, তারই উদাহরণ? আমরা এই সংস্কৃতির বদল চাই। চাই ভালো মানুষের নেতৃত্ব। চাই বৈষম্যহীন এক সমাজ ব্যবস্থা। আশায় দিন গুনছে দেশের মানুষ।
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত বিএনপির দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও নৈতিকতা পরিপন্থী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ রবিউল আলম রবিকে শোকজও করা হয়েছে। শুক্রবার সন্ধ্যায় বিএনপি সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এ শোকজের কথা জানানো হয়।একইসঙ্গে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নয়াপল্টনে চিঠির জবাব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
রবির বাসায় পুলিশের হানা
হত্যাকাণ্ডে রবির নাম সামনে আসার পরই গা ঢাকা দিয়েছেন বিএনপির এ নেতা। তাকে ধরতে শুক্রবার সন্ধ্যায় তার হাতিরপুলের বাসায় অভিযান চালায় পুলিশ। তবে বাসায় কাউকে পাওয়া যায়নি বলে ঢাকাটাইমসকে জানান, তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) রুহুল কবির খান।
এর আগে শুক্রবার সকালে তামিম হত্যাকাণ্ডে শেখ রবিউল আলম রবির সম্পৃক্ততা প্রাথমিকভাবে পাওয়া গেছে বলে জানান, পুলিশ কর্মকর্তা রুহুল কবির খান।
হত্যাকাণ্ডে রবির দায় কতটা? এমন প্রশ্নের উত্তরে ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘জমির মালিকের সঙ্গে ডেভেলপার কোম্পানির দ্বন্দ্ব। সুতরাং তার (কোম্পানির এমডি) তো দায় থাকবেই। বাকিটা তদন্তে উঠে আসবে।’
নিহত তামিমের পারিবারিক সূত্রে পুলিশ জানায়, রাজধানীর রামপুরা মহানগর প্রজেক্টে বাড়ি নির্মাণ ও ফ্ল্যাট ভাগাভাগি নিয়ে জমির মালিক ও ডেভেলপার কোম্পানি প্লেজান্ট প্রপার্টিজ (প্রা.) লিমিটিডের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছিল। দ্বন্দ্বের জেরে গত বৃহস্পতিবার ডেভেলপার কোম্পানি, জমির মালিক ও ভবনের অন্যান্য মালিকের মধ্যে ভাঙচুর এবং হাতাহাতির ঘটনায় গুরুতর আহত হন দীপ্ত টিভির সম্প্রচার বিভাগের কর্মকর্তা তানজিল জাহান তামিম। পরে একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু তার হয়।
এ ঘটনায় নিহতের পরিবার ১৬ জনকে আসামি করে যে মামলা করেছে তাতে তিন নম্বর আসামি বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা শেখ রবিউল আলম রবি। তিনি ডেভেলপার কোম্পানি প্লেজান্ট প্রপার্টিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ওই কোম্পানি নিহত তামিমের বাবার জমিতে চুক্তির ভিত্তিতে একটি ভবন তৈরি করে। যেখানে আরও দুজন জমির মালিক রয়েছে। অন্য মালিকদের প্রাপ্ত ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেওয়া হলেও তামিমদের সম্পূর্ণ পাওনা হস্তান্তর করা হয়নি বলে অভিযোগ তার পরিবারের। ভবনের সেই ফ্ল্যাট ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে ডেভেলপার কোম্পানির লোকেরা বাড়িতে ঢুকে তামিমকে পিটিয়ে হত্যা করেন বলে অভিযোগ পরিবারের সদস্যদের।
(ঢাকাটাইমস/১১অক্টোবর/এলএম/এমআই/এসআইএস)