কেন শত কোটি টাকা দিয়ে মন্ত্রিত্ব কিনেছিলেন তাজুল
শত কোটি টাকায় মন্ত্রিত্ব বিক্রি! ভাবা যায়? তাও আবার স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর!
একসময় এই বাংলাদেশেই প্রধানমন্ত্রীর পরই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা দায়িত্ব পেতেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রলালয়ের। কিন্তু সেই ট্রাডিশন সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলা হয় বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। টাকার বিনিময়ে বিক্রি করা হয় দপ্তর।
হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসেন তাজুল ইসলাম। রাতারাতি বনে যান স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী। এ ঘটনায় তাজ্জব ও বাকরুদ্ধ হয়ে যান আওয়ামী লীগের বাঘা বাঘা নেতারা।
কিন্তু শত কোটি টাকা দিয়ে কেন মন্ত্রিত্ব কিনেছিলেন তাজুল ইসলাম? কাকে দিয়েছিলেন সেই টাকা? মন্ত্রী হওয়ার পরও নিয়মিত মাসোহারা দেওয়া লাগতো? মাসে মাসে কত টাকাই বা দিতেন এই তাজুল?
আজ বলব শত কোটি টাকায় মন্ত্রিত্ব কেনার সেই কাহিনি। চলুন, তার আগে জেনে নিই তাজুল ইসলামের গ্রামের বাড়ি কী অবস্থায় আছে।
গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন তাজুল ইসলাম। কুমিল্লার লাকসামে শ্মশানের মতো পড়ে আছে তাজুলের গ্রামের বাড়ি। সেখানে কেউ নেই। জনতার ক্ষোভের আঘাত দগদগ করছে তাজুলের বাড়ি ঘিরে। সেখান থেকে লুটে নেওয়া হয়েছে সবকিছু। ভাঙচুরও চলেছে।
তাজুল ইসলাম ছিলেন ২০১৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের অতিগুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী। একসময় তার স্বপ্ন ছিল হুইপ বা প্রতিমন্ত্রী হওয়ার। কিন্ত কপাল এমনই যে, ঘুষের জোরে তাজুল হয়ে যান সবচেয়ে বড় মন্ত্রীদের একজন।
তাজুল ইসলাম ছিলেন কুমিল্লা জেলার লাকসাম উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা। এক সময় চট্টগ্রামে ব্যবসা করতেন। আর সেখানেই তিনি ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর।
চট্টগ্রাম সিটির সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীকে বেশ সমীহ ও সন্মান করতেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। আর মহিউদ্দিন চৌধুরীর সুপারিশেই ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান তাজুল।
অবশ্য সেই সুপারিশও যে একেবারে বিনামূল্যে ছিল তা বলা যাবে না। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মহিউদ্দিন চৌধুরীর জন্য অর্থ ব্যয় করতেন তাজুল ইসলাম, পরে সংসদ নির্বাচনের জন্যও আওয়ামী লীগের তহবিলে মোটা অঙ্কের অর্থ দেন।
১৯৯৬ সালে বিজয়ী হয়ে প্রথমবারের মতো সংসদে যান তাজুল। এরপর ২০০৮ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত আরও চারবার টানা এমপি হন তিনি।
টাকা দিয়ে মনোনয়ন কেনা আর এমপি হওয়া নতুন ঘটনা নয়। অনেকের বেলাতেই এমন কথা শোনা যায়। তবে সেই অনেকের মাঝেই থেমে থাকেননি তাজুল ইসলাম। তার মাথায় ছিল ভিন্ন প্রশ্ন। টাকা দিয়ে সংসদ সদস্য পদ কেনা গেলে প্রতিমন্ত্রী কিংবা হুইপের পদ কেনা যাবে না কেন?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে এক প্রভাবশালীর নামও পেয়ে গেলেন তাজুল ইসলাম, যিনি টাকার বিনিময়ে মন্ত্রিত্ব কিনে দিতে পারবেন। সেই প্রভাবশালী বঙ্গবন্ধু পরিবারেরই এক সদস্য। এই সদস্যের কথা ফেলতেই পারতেন না সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা জানিয়েছেন, মন্ত্রিত্বের জন্য বঙ্গবন্ধু পরিবারের সেই সদস্যকে একশো কোটি টাকা দেন তাজুল ইসলাম। এরপর হয়ে যান স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী। মাসে মাসে দিতেন আরও ৫০ কোটি টাকা।
তাজুলের আমলে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের কাজে চলেছে দেদারসে দুর্নীতি। সব কাজেই কমিশন দিতে হতো তাজুলকে। সেসব কমিশনের টাকা হতো ভাগবাটোয়ারা। তাজুল নিজেও রাখতেন মোটা অঙ্ক। সেসব অর্থের সিংহভাগই গোপন পথে পাচার হয়ে চলে গেছে দেশের বাইরে।
মন্ত্রণালয়ে পরে অবশ্য পরিবর্তন আনা হয়। তার হাতে গুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় রেখে কম গুরুত্বপূর্ণ পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ সরিয়ে দেওয়া হয়।
তবে স্থানীয় সরকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়। দেশের সব ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ ও সিটি করপোরেশনের নিয়ন্ত্রণ করে এই মন্ত্রণালয়। এই মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমেই বাস্তবায়ন করা হয় সারা দেশে জেলা-উপজেলা-পৌরসভা-ইউনিয়ন পর্যায়ের রাস্তাঘাট-সেতু-কালভার্ট নির্মাণসহ মাঠ পর্যায়ের সকল উন্নয়ন কর্মকাণ্ড।
একারণেই একসময় প্রচলন ছিল যে, ক্ষমতাসীন দলের মহাসচিব বা সাধারণ সম্পাদক বা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হবেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী।
এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন বিএনপির মহাসচিব ব্যারিস্টার আব্দুস সালাম তালুকদার কিংবা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমানের মতো নেতা। পরে এটা ভাঙা হলেও দায়িত্ব পেতেন দলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।
কিন্তু টাকার বিনিময়ে মন্ত্রিত্ব বিক্রির বিরল ঘটনাও ঘটে আওয়ামী লীগ আমলে। দলের মধ্যে তেমন কোনো অবস্থানই নেই, সেই তাজুলও হয়েছিলেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী।
(ঢাকাটাইমস/১২জানুয়ারি/আরবি)

মন্তব্য করুন