আপনিও হতে পারেন গণঅভ্যুত্থান ‘মামলা-বাণিজ্যে’র শিকার! কীভাবে?
দীর্ঘদিন ধরে পাথর ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম। বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে নির্মাণসামগ্রী সরবরাহ করেন তিনি। কোনো ধরনের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না থাকলেও গত তিন মাসে তার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে তিনটি। আমিনুল ইসলামকে আওয়ামী লীগের নেতা বানিয়ে জুলাই ছাত্র আন্দোলনে গুলি চালানোর অভিযোগ আনা হয়।
একইভাবে হত্যাচেষ্টা মামলা হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্নার বিরুদ্ধে। খিলগাঁও থানার ওই মামলায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে তাকেও করা হয় আসামি। ঘটনাটি নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে এই আইনজীবী মামলা থেকে অব্যাহতি পান।
কিন্তু সবাই তো আর আইনজীবী পান্নার মতো প্রভাবশালী নন। তাই এজাহারে নাম উঠে গেলে মামলা-বাণিজ্যের হয়রানির শিকার হতে হয় তাদের। যেমনটা হচ্ছেন আমিনুল ইসলাম।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মামলার জোয়ার ওঠে দেশ জুড়ে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন এমন হাজার হাজার মানুষকে আসামি করা হয় অনেক মামলায়। মূলত হয়রানি আর বাণিজ্য করাই এসব মামলার উদ্দেশ্য।
ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মূলত মামলা-বাণিজ্য হচ্ছে চারভাবে। এজাহারে যাদের নাম এসেছে, টাকার বিনিময়ে তাদের নাম বাদ দিতে ব্যস্ত এক পক্ষ। আরেক পক্ষ ভুক্তভোগী পরিবারকে ভুল বুঝিয়ে মামলা-বাণিজ্য করছে। অন্য একটি পক্ষ ভুয়া মামলার কপি তৈরি করে ভুক্তভোগীদের গিয়ে তদন্তের ভয় দেখায়, দ্রুত টাকা দিয়ে নাম বাদ করানোর পরামর্শ দেয় তারা। পুলিশের বিরুদ্ধেও মামলা-বাণিজ্যের অভিযোগ আছে। আবার পূর্বশত্রুতা কিংবা ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বেও মামলায় জড়ানো হচ্ছে কাউকে কাউকে।
ভুক্তভোগী আমিনুল ইসলামের নামে গত নভেম্বরে উত্তরা পশ্চিম ও কোতোয়ালি থানায় দুটি মামলা হয়। তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘প্রথমে শুনে তো আকাশ থেকে পড়ার অবস্থা। মঙ্গলবার শুনি যাত্রাবাড়ী থানায় আরও একটি মামলা হয়েছে। বিভিন্ন মাধ্যমে খোজ নিয়ে জানতে পারি, আমার সাবেক ব্যবসায়িক পার্টনার মামলাগুলো করান।’ ১৬ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে আমিনুলের করা মামলা বিচারাধীন বলে জানান তিনি।
ব্যবসায়িক ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতেই মিথ্যা মামলায় জড়ানো হচ্ছে অভিযোগ করে আমিনুল বলেন, ‘কোনোদিন রাজনীতি করিনি, কিন্তু একের পর এক জুলাই আন্দোলনের হত্যা মামলা হলো আমার বিরুদ্ধে। আমি অন্তর্বতীকালীন সরকারের কাছে সুষ্ঠু বিচার চাই।’
ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঘিরে দেশে ভুয়া মামলার কথা স্বীকার করেন স্বয়ং আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। এ জন্য সতর্ক ও হুঁশিয়ারিও করেন তিনি। ভুয়া মামলার বাদীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও সরকারের তরফে এখন পর্যন্ত শক্ত কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি- বলছেন ভুক্তভোগীরা।
আর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার সাজ্জাত আলী একটি অনুষ্ঠানে বলেন- জুলাই অভ্যুত্থানে মামলা-বাণিজ্যের অভিযোগ আসছে যাদের নামে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন তারা। এই বাণিজ্যের সঙ্গে পুলিশও জড়িত। ইতিমধ্যে একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে বলে জানান কমিশনার।
পলিশের দাবি, এসব মিথ্যা মামলায় আসামি গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে সতর্ক তারা। মামলায় নাম থাকলেই গণহারে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। যাচাই-বাছাই করে তবেই গ্রেপ্তার করা হয় আসামি।
একই রকম দাবি র্যাবেরও। বাহিনীটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল মুনীম ফেরদৌস ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘ঘটনার সময়ের সিসিটিভি ফুটেজ, গণমাধ্যমে আসা ভিডিওসহ বিভিন্ন বিষয় নিশ্চিত করে গ্রেপ্তারে সিদ্ধান্ত নিই আমরা।‘ এখন পর্যন্ত কাউকে হয়রানিমূলক গ্রেপ্তার করা হয়নি বলে দাবি র্যাবের মুখপাত্রের।
এদিকে খবর আসছে, অনেক মামলায় আসামিকে চেনেন না বাদী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব মামলায় নাম দেওয়ার ক্ষেত্রে বাদী কার দ্বারা প্ররোচিত হয়েছেন সেটি বের করা দরকার। তাহলে মামলা-বাণিজ্যের প্রবণতা কমতে পারে।
নিজের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী খন্দকার হাসান শাহরিয়ার ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘অনেক সময় মামলার বাদী আদালতে এসে বলছেন তিনি আসামিকে চেনেন না। তার মানে মিথ্যা মামলায় নিরীহ মানুষকে ফাঁসানো হচ্ছে। বাদী কার প্ররোচনায় মামলায় নামটি দিয়েছে, সেটি উদঘাটন করতে হবে।’ এই ধরনের মামলা বাণিজ্য দ্রুত বন্ধ করার তাগিদ দেন তিনি।
জাতীয় নাগরিক কমিটি বলছে, জুলাই বিপ্লব পরবর্তী বাংলাদেশে এই ধরনের মামলা দুঃখজনক। তারা চায় কেউ যাতে মামলা-বাণিজ্যের শিকার না হন।
সংগঠনের সহ-মুখপাত্র সালেহ উদ্দিন সিফাত ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আমরা দেখতে পাচ্ছি মামলা-বাণিজ্য চলছে। অভ্যুত্থানে যারা ছাত্র-জনতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে ছাত্রদের ওপর হামলা চালিয়েছে, তাদের বিচার হওয়া জরুরি। একই সঙ্গে এটাও দেখতে হবে নিরপরাধ কেউ যেন মামলা বাণিজ্যের শিকার না হয়।’
টাকার বিনিময়ে এজাহার থেকে আসামির নাম কাটানো হচ্ছে জানিয়ে সালেহ উদ্দিন বলেন, ‘কেউ যদি স্বীকৃত আসামি হয়, সবাই যদি তাকে দেখে থাকে যে তিনি ছাত্র-জনতার ওপর হামলা করেছে কিংবা গুলি চালিয়েছে, কোনোভাবেই এজাহার থেকে তার নাম কাটার সুযোগ নেই। যারা এ ধরনের কার্যক্রম চালাচ্ছে তারা ফ্যাসিবাদের পক্ষের শক্তি বলে আমরা মনে করি না।’
ঢাকাটাইমস/১৮জানুয়ারি/এসএস/মোআ)

মন্তব্য করুন