নারীর ক্ষমতায়নে কর্মজীবী নারীকে হয়রানি নয়

ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্টি অ্যালকোহল পৃথিবীর ১৩০টি দেশে কার্যক্রম করে থাকে। সংগঠনটির সেন্ট্রাল প্রেসিডেন্ট ড. মো. আনোয়ার হোসেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। তিনি বাংলাদেশি এবং দক্ষিণ এশিয়ার নাগরিক হিসেবে আমরা তাকে নিয়ে গর্ববোধ করি। তিনি ইতিপূর্বে একাধিক আন্তর্জাতিক লিডিং অর্গানাইজেশনে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে মানবাধিকার সংগঠক হিসেবে সুনামের সঙ্গে কাজ করেছিলেন। ড. আনোয়ার ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্টি অ্যালকোহলের সেন্ট্রাল ওয়েবসাইট ২ এ দুটি ভিডিও বার্তা প্রদান করেন। একটি ভিডিও বার্তায় কর্মজীবী নারীকে হয়রানি না করার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করেন। তিনি তৃতীয় বিশ্বের নারীদের নিগৃহীত হওয়ার বিষয়ে ভিডিও বার্তায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে আলোচিত একজন কর্মজীবী নারীর কথা একটি ভিডিও বার্তায় উল্লেখ করেন। ভিডিও দুটি খুবই অল্প সময়ে হওয়ায় বিস্তারিত আলোচনা করতে সক্ষম হননি মর্মে আলাদাভাবে নোট লেখেন। নিম্নে ভিডিও বার্তা দুটি এবং নোট হতে ড. আনোয়ারের দেওয়া ব্যাখ্যা হতে একজন সংকলক হিসেবে এ প্রবন্ধটি তুলে ধরা হলো।
ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্টি অ্যালকোহলের সেন্ট্রাল প্রেসিডেন্ট কর্তৃক ভিডিও বার্তা এবং নোট হতে:
বর্তমান বিশ্বে নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ে জোর আওয়াজ উঠছে বিশ্বব্যাপী। বিশেষ করে আফ্রিকা মহাদেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় এ আওয়াজটি একটু বেশি শোনা যাচ্ছে। বাংলাদেশে এই আওয়াজটি আরো তীব্র। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আফ্রিকা মহাদেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় বিশ্ব পরিসংখ্যানে নারীরা তুলনামূলক বেশি নিগৃহীত। আপাতদৃষ্টিতে বাংলাদেশে কর্মজীবী নারীদের জয়-জয়কার অবস্থা পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন হতে প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিরোধীদলীয় নেত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকার এবং সংসদীয় উপনেতা নারী ছিলেন। জাতীয় সংসদে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সংসদ সদস্যও নারী ছিলেন। রাজপথে যেকোনো আন্দোলন-সংগ্রামে নারীদের সরব উপস্থিতি বাংলাদেশে পরিলক্ষিত হয়। সরকারি চাকরিজীবীদের বর্তমানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী। বিশেষ করে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে লিডিং পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী রয়েছে। নারী উদ্যোক্তার সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য হারে ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে গার্মেন্টস সেক্টরে নারীদের উপস্থিতি পুরুষের তুলনায় এগিয়ে রয়েছে। এত জয়-জয়কারের মধ্যেও যেন বাতির নিচে অন্ধকার। নারী কর্মচারীদের নিগৃহীত হওয়ার পরিসংখ্যানে বাংলাদেশ বিশ্ব পরিসংখ্যানে প্রথমদিকে রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের আদালতে মহিলা নেত্রীর ওপর মব জাস্টিসও পরিলক্ষিত হয়েছে। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, জুলুম, নির্যাতন, অনিয়ম বা কোনো ধরনের ফৌজদারি অপরাধ সংঘটিত করলে নারী হোক বা পুরুষ হোক তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যেতেই পারে।
কিন্তু তুচ্ছ বিষয়ে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে একজন কর্মজীবী নারীর বিরুদ্ধে ৭ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, যা বাংলাদেশে সাধারণত একজন দাগি সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধেও নেওয়া হয় না।
আমি এমনই একজন সরকারি নারী কর্মচারীর ঘটনা উদাহরণ হিসেবে বর্ণনা করছি। যার নাম তাপসী তাবাসসুম ঊর্মি। তার বিরুদ্ধে এক হাজার কোটি টাকার মানহানি মামলা করা হয়েছে। এক আদালতে নয়, একাধিক আদালতে মামলা করা হয়েছে। রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা করারও চেষ্টা করা হয়েছে। তিনি রাষ্ট্রের পক্ষে অবস্থান নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে বলার কারণে এ মামলাগুলো করা হয়েছে। তিনি ফেসবুকে লিখেছেন সাংবিধানিকভাবে অবৈধ প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন রিসেট বাটন পুশ করে নিশ্চিতভাবে সব অতীত মুছে ফেলা হয়েছে। তিনি সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপকভাবে আলোচিত আবু সাঈদকে নিয়েও মন্তব্য করেছেন।
এ লেখার মাধ্যমে আমি দেশবাসীর উদ্দেশে এ বিষয়ে কিছু অতীত স্মরণ করে দিতে ইচ্ছুক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমানসহ ছোট-বড়ো ও মাঝারি মানের মৃত ও জীবিত রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিগণের বিষয়ে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের মানুষ সংসদে, রাজপথে, মসজিদ, মন্দির, হাটবাজার, আদালত এবং সরকারি দপ্তরসমূহে ইতিবাচক ও নেতিবাচক হাজারো মন্তব্য করে থাকেন। বিশেষ করে সরকারি দপ্তরে রাজনৈতিক আলোচনা হর-হামেশা চলতে থাকে। সরকারি কর্মচারীদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষাবলম্বন করে গ্রুপিং, লবিং ও দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে হেন কোনো কার্যক্রম নেই যা সংঘটিত হয় না। বিশেষ করে সরকারি দপ্তরে সরকারি দলের পক্ষাবলম্বন করে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি প্রায় শারীরিক আক্রমণও পরিলক্ষিত হয়। এসব বিষয়ে মামলা হওয়ার উদাহরণ খুব কমই দেখা যায়।
অন্যদিকে কর্মজীবী নারীর বিরুদ্ধে কয়েকটি বাক্য ফেসবুকে পোস্ট করার দায়ে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা কাকে বলে, উহা কত প্রকার ও কি কি, একেবারে উদাহরণ ও ব্যাখ্যাসহ জাতিকে বুঝিয়ে দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে একটা মহল যেন মরিয়া হয়ে উঠছে। তার বিরুদ্ধে ঢাকা মেট্রোপলিটন আদালত এবং খুলনা মেট্রোপলিটন আদালতে মানহানি মামলা করা হয়েছে। রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করা হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞ প্রদান করা হয়েছে। ফেসবুকে পোস্ট দেখা মাত্রই বিদ্যুৎ গতিতে ওএসডি করা হয়েছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে সাময়িক সাসপেন্ড করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা রুজু করা হয়েছে।
আমি যতটুকু জানি এই ধরনের মামলার ক্ষেত্রে সাধারণত প্রথমে তদন্তকারী সংস্থা নিয়োগ করে সরেজমিন তদন্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, মামলাটি চার্জ গঠন করা যাবে কি না অথবা বেকসুর খালাস প্রদান করা হবে কি না। এক্ষেত্রে ঢাকা মেট্রোপলিটন আদালত মামলাটি সরাসরি গ্রহণ করলেও খুলনা মেট্রোপলিটন আদালত তদন্তকারী সংস্থা নিয়োগ প্রদান করে। বাংলাদেশে হাজারো মামলা বছরের পর বছর কচ্ছপ গতিতে এগুলোও এ মামলাটি চিতা বাঘের চেয়েও দ্রুতগতিতে এগুচ্ছে, যা দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি।
এ মামলাটি দ্বিতীয় কার্যদিবসে চার্জ গঠনের কার্যক্রম শুরু হয়। দ্বিতীয় কার্যদিবসের পর সপ্তম দিনে শুনানির তারিখ ঘোষণা করে, ওই দিন মাত্র কয়েক মিনিট আলোচনার মাধ্যমে চার্জ গঠন সম্পন্ন হয়ে যায়। যেহেতু কোনো ধরনের তদন্তকারী সংস্থার প্রতিবেদন গ্রহণ করা হয়নি, সেক্ষেত্রে আমি ভেবেছিলাম কমপক্ষে ছয় কার্যদিবস আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, আদৌ চার্জ গঠন হবে কি না। আরেকটি বিষয় হলো এই মামলাটি প্রায় প্রতি দিবসেই কার্যতালিকায় প্রথম স্থানে রাখা হয়েছে। অথচ মামলাটি একেবারেই সাধারণ একটা মানহানি মামলা, যা ওয়াকিবহাল মহলে সন্দেহের উদ্বেগ করে।
আমাদের আইন উপদেষ্টা সম্প্রতি বলেছেন, হুটহাট করে জামিন না দিয়ে বিবেচনা করে জামিন দিতে। ঊর্মির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সরকার এবং মামলাকারীগণের নিকট আমার প্রশ্ন, এক মুরগি কয়বার এবং কয়ভাবে জবাই করা যায়? একটি ঘটনায় একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে কয় ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যায়। কয়েকটি কথা ফেসবুকে পোস্ট করার জন্য তাকে চাকরি হতে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা যথেষ্ট ছিল না? সে কোন মাপের সন্ত্রাসী বা ষড়যন্ত্রকারী যে তার বিরুদ্ধে এতগুলো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। বিদেশ যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা কেন প্রদান করতে হলো? সে রাষ্ট্রের পক্ষে বললেও কেন তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা করতে চেষ্টা করা হলো? অনেকে হয়তো বলবেন সে সরকারি চাকরিজীবী হয়ে আচরণ বিধি লঙ্ঘন করেছে। এজন্যই তো সরকার তাকে ওএসডি করেছে এবং সাময়িক সাসপেন্ড করেছে। বিষয়টি এখানে শেষ হতে পারতো না?
বাংলাদেশ সরকার তাকে নিয়ে এতটা টানাহেঁচড়া না করে, তার বয়স বিবেচনা, অভিজ্ঞতা বিবেচনা, চাকরিকালীন তার সততা, জবাবদিহিতা, কর্মদক্ষতা, প্রথমবারের মতো এমন ঘটনা হওয়ায় তাকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে পারতো। তা না করে অন্য মামলার তুলনায় এ মামলায় গতি বাড়িয়ে দিয়ে দ্রুত তার শাস্তি নিশ্চিত করতে তৎপর বলে সচেতন মহল মনে করে।
মাদকাসক্তরা তাদের মাদক ক্রয় অর্থ জোগাড় করতে প্রথমে মা, বোন ও গৃহবধূদের ওপর নির্যাতন করে থাকে। একজন নারী কর্মজীবী হলে এক্ষেত্রে সে কিছুটা হলেও নিরাপদ থাকে। অর্থাৎ মাদকমুক্ত বিশ্ব গড়তে নারী ক্ষমতায়ন অতীব জরুরি বলে মনে করি।
এমতাবস্থায় কর্তৃপক্ষের উচিত একজন কর্মজীবী কোমলমতি ও নবীন কর্মকর্তা বিবেচনা করে হলেও নারী ক্ষমতায়নে অন্য মামলার ন্যায় স্বাভাবিক গতিতে এ মামলাটিও যাতে পরিচালিত হয় এ দিকটায় সজাগ থাকা।
লেখক: কর্ডিনেশন অফিসার, আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী সংগঠন ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্টি অ্যালকোহল বাংলাদেশ শাখা

মন্তব্য করুন