যেসব কারণে কোরবানি কবুল হয় না

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস
  প্রকাশিত : ০৫ জুন ২০২৫, ১২:৫৫
অ- অ+

আসন্ন ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে মুসলিম সমাজে কোরবানির প্রস্তুতি শুরু হয়েছে জোরেশোরে। তবে অনেকেই আছেন, যাদের কোরবানি আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না, যদিও বাহ্যিকভাবে তারা তা যথাযথভাবে পালন করেন। ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে কোরবানির মূল উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্য, তাকওয়া আত্মত্যাগ প্রকাশ। কিন্তু কিছু ভুল গাফিলতির কারণে কোরবানির এই মহৎ ইবাদতটি অনেক সময় কবুল হয় না।

কোরবানির মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহ মহান আল্লাহর প্রতি তাদের আনুগত্য, আন্তরিকতা ও ভালোবাসার স্বাক্ষর স্থাপন করে, যেমন করেছিলেন, মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহিম (আ.)। মহান আল্লাহর আদেশ পালনের উদ্দেশে তিনি নিজের কিশোর বয়সী কলিজার টুকরা সন্তান ইসমাঈল (আ.)-কে কোরবানি করতে উদ্যত হয়েছিলেন।

মহান আল্লাহ তাঁর এই আনুগত্যে খুশি হয়ে ইসমাঈল (আ.)-এর স্থলে পশু কোরবানির ব্যবস্থা করেন এবং তাঁর এই পূর্ণ আনুগত্য ও তাকওয়াকে কবুল করেন।

কোরবানিতে মুখ্য বিষয় হওয়া উচিত তাকওয়া ও আন্তরিকার সঙ্গে মহান আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রদর্শন। কেননা পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘আল্লাহর কাছে পৌঁছে না এগুলোর গোশত ও রক্ত, বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।’ (সুরা : হজ, আয়াত : ৩৭)

তাই মুমিনের উচিত কোরবানি করার ক্ষেত্রে আন্তরিকতা ও তাকওয়া বিঘ্নিত হয় এমন কাজ করা থেকে বিরত থাকা। নিম্নে এমন কিছু তথ্য তুলো ধরা হলো, যেগুলো কোরবানির মাহাত্ম্য বিনষ্ট করে।

হারাম উপার্জনের টাকায় কোরবানি করা

কোরবানি একটি পবিত্র ইবাদত, এটি করার সময় এমন কোনো অর্থ ব্যয় করা উচিত নয়, যা উপার্জন করা হয়েছে হারাম উপায়ে। কেননা হাদিস শরিফে এসেছে, ‘আল্লাহ তাআলা পবিত্র, তিনি পবিত্র ও হালাল বস্তু ছাড়া গ্রহণ করেন না।’ (মুসলিম, হাদিস : ২২৩৬)

লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে কোরবানি করা

যেকোনো ইবাদত হতে হবে একমাত্র আল্লাহর জন্য। দুনিয়াবি কোনো স্বার্থ তাতে থাকতে পারবে না।

কোরবানির উদ্দেশ্যও হওয়া উচিত একমাত্র মহান আল্লাহকে সন্তুষ্ট করা, লোক দেখানো ও মানুষের প্রশংসা কুড়ানোর আশায় কোরবানি করলে তা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা লোক দেখানোর জন্য তা করে।’ (সুরা : মাউন, আয়াত : ৬)

হাদিস শরিফে এসেছে, মাহমুদ বিন লাবিদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের ওপর সবচেয়ে ভয়ানক যে বিষয়ের আমি আশঙ্কা করছি তা হলো শিরক আসগার (ছোট শিরক)।’ তারা বললেন, ছোট শিরক কী হে আল্লাহর রাসুল? তিনি বলেন, ‘রিয়া’ (লোক দেখানো ইবাদত)। সম্মানিত আল্লাহ যখন মানুষকে তাদের কর্মফল দান করবেন তখন বলবেন, ‘দুনিয়ায় যাদেরকে দেখানোর উদ্দেশ্যে তোমরা আমল করতে তাদের কাছে যাও।

দেখ, তাদের কাছে কোনো প্রতিদান পাও কি না?’ (সহিহ তারগিব ওয়াত তাহরিব : ৩২)

কোরবানির পশু নিয়ে অহংকার করা

মহান আল্লাহকে খুশি করার জন্য নিজের সামর্থ্যের মধ্যে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা এবং বড় ও একাধিক পশু কেনা দোষণীয় নয়। কিন্তু অন্যের তুলনায় বেশি বাজেটে কোরবানি দেওয়া নিয়ে অহংকার করা নিষিদ্ধ। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘অহংকারের বশবর্তী হয়ে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা কোরো না, আর পৃথিবীতে গর্বভরে চলাফেরা কোরো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না।’ (সুরা : লুকমান, আয়াত : ১৮)

অতএব, কোরবানিতে অহংকারের অনুপ্রবেশ ঘটাতে পারে এমন সব কাজ বর্জন করা আবশ্যক।

কোরবানির জন্য জোরপূর্বক প্রাণী আদায় করা

আমাদের সমাজে বিভিন্ন মৌসুমে যৌতুক আদায়ের কুপ্রথা আছে। কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করেও যৌতুক আদায় করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমন পরিবেশ তৈরি করা হয় যে কন্যার বাবাকে ঋণ করে বা সুদের ওপর টাকা নিয়ে কোরবানির পশু যৌতুক দিয়ে নিজেদের সম্মান বাঁচাতে হয়। এটা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ কাজ। মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা নিজেদের মধ্যে তোমাদের সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১৮৮)

ছেলেপক্ষের উচিত কনেপক্ষ যাতে কোনো অবস্থায়ই চাপে না থাকে, তাই আগে থেকেই তাদের কোরবানির পশু যৌতুক হিসেবে দিতে অনুৎসাহী করা। উল্লেখ্য, কোনো সামর্থ্যবান বাবা যদি কারো চাপে বা লোকলজ্জার ভয়ে না পড়ে তাঁর কন্যার শ্বশুরবাড়িতে কোরবানির পশু উপহার দেয়, তা দোষনীয় নয়। তবে সমাজে এমন দাতার সংখ্যা অনেক কম।

লোক-লজ্জায় কোরবানি করা

লোক-লজ্জায় কিংবা গোশত খাওয়ার আশায় কোরবানি করাও কোরবানির মহিমা ক্ষুণ্ন করে। এখানে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির ওপর পাছে লোকে কিছু বলে কিংবা গোশত লাভের আশা প্রাধান্য পায়, যাতে কোরবানির মূল উদ্দেশ্য অর্জিত হয় না।

কোরবানির পশুর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করা

অনেকে পশু কোরবানির সময় পূর্বাভিজ্ঞতা না থাকা ও আগে থেকে প্রয়োজনীয় ছুরি-কাঁচি প্রস্তুত না রাখার দরুন পশুকে নিষ্ঠুর পদ্ধতিতে শুইয়ে ভোঁতা ছুরি দিয়ে জবেহ করে অহেতুক কষ্ট দেয়। শাদ্দাদ ইবনে আওস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা প্রতিটি জিনিসের প্রতি দয়া-অনুগ্রহ প্রদর্শনের আবশ্যকতা গণ্য করেছেন। অতএব, তোমরা (কিসাসে অথবা জিহাদে) কোনো লোককে হত্যা করলে উত্তম পন্থায় হত্যা করবে এবং কোনো কিছু জবেহ করার সময় উত্তম পন্থায় জবেহ করবে। তোমাদের মধ্যে যে কেউ যেন তার ছুরি ভালোভাবে ধারালো করে নেয় এবং জবেহ করার পশুটিকে আরাম দেয়। (তিরমিজি, হাদিস : ১৪০৯)

পশু জবাইয়ের সময় বিসমিল্লাহ না বলা

পশু জবাইয়ের সময় ইচ্ছাকৃত আল্লাহর নাম না নিলে কোরবানি তো দূরের কথা, ওই পশুর গোশতই হালাল হয় না, তাই কোরবানি করার সময় এ বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে খেয়াল রাখতে হবে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘সুতরাং তোমরা আহার করো তা থেকে, যার ওপর আল্লাহর নাম নেওয়া হয়েছে, যদি তোমরা তাঁর আয়াতসমূহের ব্যাপারে বিশ্বাসী হও।’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ১১৮)

কোরবানির পশুর গোশত বিক্রি বা পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া

কোরবানির পশুর গোশত বা চামড়া বিক্রি করা নিষেধ। এমনকি কসাই কিংবা কর্মচারীদের পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়াও নিষেধ। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, আলী বিন আবু তালিব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে নির্দেশ দেন, আমি যেন তাঁর কোরবানির পশু দেখাশোনা করি, ঝুল ও চামড়া (দরিদ্রের মধ্যে) বণ্টন করি এবং কসাইকে যেন তা থেকে (পারিশ্রমিক বাবদ) কিছু না দিই। তিনি বলেন, তাকে আমি নিজের পক্ষ থেকে দেব। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩০৯৯)

কোরবানি কবুল হওয়ার জন্য কোরবানির পশুর ক্ষেত্রে যেসব শর্ত রয়েছে তাহলো

১. চতুষ্পদ জন্তু হওয়া। যেমন- উট, গরু ও ছাগল। আল্লাহ বলেনপ্রত্যেক উম্মতের জন্য আমি কোরবানির বিধান রেখেছিলাম, যাতে তারা জবাই করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে এজন্য যে, তিনি চতুষ্পদ গবাদিপশু থেকে তাদের জন্য রিজিক নির্ধারণ করেছেন। আর তোমাদের উপাস্য মাত্র একজন। অতএব তার নিকট তোমরা আত্মসমর্পণ কর এবং তুমি বিনয়ীদের সুসংবাদ দাও। (সূরা হজ, আয়াত : ৩৪)।

ইমাম শাফেঈ (রহ.) বলেন, উপরে বর্ণিত পশুগুলো ছাড়া অন্য কোন পশু দিয়ে কোরবানি সহি হবে না।

২. শরীয়ত নির্ধারিত বয়সে উপনীত হওয়া। কোরবানি বিশুদ্ধ হওয়ার জন্য পশুর বয়স পূর্ণ হওয়া জরুরি। মহানবী (সা.) বলেন,তোমরা দুধের দাঁত ভেঙ্গে নতুন দাঁত ওঠা (মুসিন্নাহ) পশু ছাড়া করো না। তবে কষ্টকর হলে এক বছর পূর্ণকারী ভেড়া (দুম্বা বা ছাগল) কোরবানি করতে পারে। (মুসলিম, হাদিস : ১৯৬৩)

মুসিন্নাহপশু ষষ্ঠ বছরে পদার্পণকারী উট এবং তৃতীয় বছরে পদার্পণকারী গরু বা ছাগল-ভেড়া-দুম্বাকে বলা হয়। কারণ, এই বয়সে সাধারণত এই সব পশুর দুধের দাঁত ভেঙ্গে নতুন দাঁত উঠে।

৩. কোরবানির পশু ত্রুটিমুক্ত হতে হবে। কোরবানির পশু এমন দোষ-ত্রুটি মুক্ত হতে হবে, যেগুলোর কারণে কোরবানি আদায় হয় না। কোরবানির পশুর ক্ষেত্রে যেসব জিনিস ত্রুটি হিসেবে গণ্য হবে তাহলো

১. স্পষ্ট অন্ধ : যেমন চোখ একেবারে কোটরের ভেতরে ঢুকে যাওয়া কিংবা বোতামের মত বের হয়ে থাকা কিংবা এমন সাদা হয়ে যাওয়া যে, সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায়, চোখ অন্ধ।

২. সুস্পষ্ট রুগ্ন : যে রোগের প্রতিক্রিয়া পশুর উপরে সুস্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠে। যেমন এমন জ্বর হওয়া যার ফলে পশু চরতে বের হয় না ও খাবার খায় না। এমন চর্মরোগ যা পশুর গোশত নষ্ট করে দেয় কিংবা স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে।

৩. স্পষ্ট খোঁড়া : যার ফলে পশুর স্বাভাবিক হাঁটা-চলা ব্যাহত হয়।

৪. জীর্ণ-শীর্ণ : যা অস্থির মজ্জা নিঃশেষ করে দেয়। নবী করীম (সা.)-কে কোরবানির ক্ষেত্রে কোন ধরনের পশু পরিহার করতে হবে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি হাত দিয়ে ইঙ্গিত করে বলেন

চার ধরনের ত্রুটিযুক্ত পশু কোরবানি করা জায়েয নয়। অন্ধ যার অন্ধত্ব সুস্পষ্ট, রুগ্ন- যার রোগ সুস্পষ্ট, খোঁড়া- যার পঙ্গুত্ব সুস্পষ্ট, বৃদ্ধ ও দুর্বল-যার হাড়ের মজ্জা শুকিয়ে গেছে। (আবু দাউদ, হাদিস : ২৮০২; তিরমিজি, হাদিস : ১৪৯৭)

এ চারটি ত্রুটি থাকলে সে পশু দিয়ে কোরবানি করা জায়েজ হবে না।

(ঢাকাটাইমস/৫ জুন/আরজেড)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
জামালপুরে মোটরসাইকেলের ধাক্কায় বৃদ্ধার মৃত্যু
ঝিনাইদহে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ২
করোনা সংক্রমণ বাড়ছে, জনপরিসরে মাস্ক পরার পরামর্শ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের
মেঘে ঢাকা রাত্রি
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা