বিএনপি আপাতত আলোচনায় থাকতে চায়

বাছির জামাল
 | প্রকাশিত : ২৯ নভেম্বর ২০১৬, ১৩:০৪

বিএনপি নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুনর্গঠনের ব্যাপারে যে প্রস্তাবাবলী দিয়েছিল, তা উত্থাপনের দিনই আওয়ামী লীগ প্রত্যাখ্যান করে দেয়। ক্ষমতাসীন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সেদিনই এক সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, ‘বিএনপির এই প্রস্তাব অন্তঃসারশূন্য। এই প্রস্তাব জাতির সঙ্গে তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়।’ আওয়ামী লীগের মিত্র দলগুলোও একই প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। কেবল সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি খালেদা জিয়ার এই ইসি পুনর্গঠনের প্রস্তাবকে ইতিবাচকভাবে দেখেছে।

বিএনপি তার দেওয়া ইসি পুনর্গঠনের প্রস্তাবের ব্যাপারে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তাতে দমে যায়নি। দলটি এখন তার প্রস্তাব রাষ্ট্রপতির কাছে দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু রাষ্ট্রপতির দপ্তর থেকে এ ব্যাপারে কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না বলে বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়। বিএনপির তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল যাতে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করতে পারে সেজন্য দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব মো. আবদুস সাত্তার রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিবের সাক্ষাৎ চেয়েছিলেন। কিন্তু সামরিক সচিবের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে বিএনপিকে কোনো কিছু জানানো হয়নি। এখন তারা রাষ্ট্রপতির সাক্ষাৎ চেয়ে লিখিতভাবে একটি চিঠি দিচ্ছে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এই লেখা প্রকাশ হওয়ার আগে বা পরে বিএনপি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি পেতেও পারে আবার না পেতে পারে।

আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা বিএনপির ইসি পুনর্গঠনের এই প্রস্তাবাবলীকে ইতিমধ্যেই প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছে। তাদের কৌশল হচ্ছে, বিএনপির উত্থাপিত প্রস্তাবকে কোনো গুরুত্ব না দেওয়া। এড়িয়ে যাওয়া। আওয়ামী লীগ তা করছেও। ক্ষমতাসীন দল ও তার জোটের অঙ্গদলগুলো সাংগঠনিকভাবে এবং এর বুদ্ধিজীবীমহল বিএনপির প্রস্তাবকে একেবারেই পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। তাদের আলাপ-আলোচনায় বিএনপির ইসি পুনর্গঠনের প্রস্তাবের প্রসঙ্গটি তেমনভাবে আনতেই চায় না। অন্যদিকে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের কোনো সাড়া পাচ্ছে না তারা। ধরে নিলাম, বিএনপি রাষ্ট্রপতির সাক্ষাতের সময় পেল। তারা তাদের প্রস্তাবাবলীও রাষ্ট্রপতির কাছে দিল। এখন যদি রাষ্ট্রপতি এই প্রস্তাবের ব্যাপারে কোনো সাড়া না দেয়, তাহলে বিএনপি কি করবে?

এমন একটি বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছে। তিনি জানিয়েছেন, ‘আমরা ইসি গঠন নিয়ে লিখিত আকারে সুস্পষ্ট একটি প্রস্তাব তুলে ধরেছি। এখন আমরা তা রাষ্ট্রপতির কাছে দেব। রাষ্ট্রপতির জন্যই আমরা এসব কিছু করেছি। যদি আমাদের প্রস্তাবকে ভালো মনে হয়, তাহলে এর উপর ভিত্তি করেই সবকিছু এগুতে পারে।’

রাষ্ট্রপতিও যদি এই প্রস্তাবে কোনো সাড়া না দিয়ে আগের মতো করেই ইসি পুনর্গঠন করে তখন বিএনপির ‘লাইন অব অ্যাকশন’ কী হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আসলে আমরা গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আছি। ইসি পুনর্গঠনের প্রস্তাব দেওয়াটাও আন্দোলনের একটি অংশ। নতুন করে আন্দোলন শুরু করার কিছু নেই। তবে তিনি জানান, রাষ্ট্রপতি জাতির অভিভাবক। তিনি দূরদর্শী রাজনীতিক। আশা করি তিনি আমাদের সময় দেবেন এবং এ নিয়ে ইতিবাচক সাড়া দেবেন।’

তবে বিএনপির কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতার সঙ্গে আলাপে বুঝা গেছে যে, আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা সাড়া দেবে নাÑএমন কিছু ধরে নিয়েই তারা ইসি পুনর্গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে। তারা বলতে চায়, এতে আওয়ামী লীগ সাড়া দিলেও বিএনপির লাভ, সাড়া না দিলে তাতেও বিএনপির কোনো ক্ষতি নেই। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, মাঠের রাজনীতিতে পিছিয়ে পড়া বিএনপি নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে আলোচনায় থাকতে চায়। সরকারি দল আওয়ামী লীগের তাৎক্ষণিক জবাব, রাজনৈতিক মহলের নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে এ নিয়ে আলোচনা হওয়ায় দলটির শীর্ষ নেতারা খুশি। নির্বাচন কমিশন গঠনে বিএনপির প্রস্তাব সরকার যে গ্রহণ করবে না, এটা সবাই জানে। কিন্তু সরকারের এই প্রত্যাখ্যানের বিষয়টি মানুষ ভালোভাবে গ্রহণ করবে না, এর মধ্যেই বিএনপি তার রাজনীতির সার্থকতা খুঁজছে।

বিএনপির নেতারা চায় আওয়ামী লীগ এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা অব্যাহত থাকুক। বিশেষ করে নাগরিক সমাজের মধ্যে এটা নিয়ে যুক্তিতর্ক অব্যাহত থাক। এ জন্য বিশিষ্টজনদের সঙ্গে প্রস্তাবটি নিয়ে মতবিনিময়, ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের এই প্রস্তাব দেওয়া, জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে জেলা পর্যায়ে এই বিষয়ে সভা-সেমিনারের আয়োজন এবং বিএনপি সমর্থক পেশাজীবী সংগঠনগুলোর উদ্যোগে সভা-সেমিনারের আয়োজন করার পরিকল্পনা আছে। বিএনপির নেতারা মনে করেন, নির্বাচন কমিশন গঠনের আগ পর্যন্ত বিষয়টি আলোচনায় থাকলে সরকার একধরনের চাপে থাকবে। তারপরও ‘গ্রহণযোগ্য’ কমিশন গঠিত না হলে বিএনপি কথা বলার বা প্রয়োজনে আন্দোলনে যাওয়ার যৌক্তিক ক্ষেত্র থাকবে।

উল্লেখ্য, গত ১৮ নভেম্বর সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য ৭ দফা প্রস্তাব করেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এছাড়া এই কমিশন কীভাবে শক্তিশালী করা যায়, সে সম্পর্কে ১৩টি প্রস্তাবও তুলে ধরেন তিনি। একই সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, নির্বাচন কমিশন যাতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন জাতিকে উপহার দিতে পারে, সেই উদ্দেশ্যেই একটি ‘নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের’ প্রয়োজন। তারা যথাসময়ে নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখাও দেবে বলে জানিয়েছেন।

আসলে বিএনপি মাঠের আন্দোলনে সুবিধা করতে পারছে না। তাই তারা এখন বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের মাধ্যমে আন্দোলনের কাজগুলো করে জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে চাইছেন। একই সঙ্গে দলের নেতা-কর্মীদের হতাশা কাটিয়ে তোলার সুযোগ খুঁজছেন। বিএনপি তার প্রস্তাব তুলে ধরার সঙ্গে সঙ্গে খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলনটি ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সারা বিশ্বেরই ছড়িয়ে দেওয়া হয়। পরের দিন বেগম খালেদা জিয়া একই বিষয়ে তার টুইটার অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে টুইট করেন। নেতারা ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, একটি অনুকূল পরিবেশ না হওয়া পর্যন্ত আপাতত এভাবেই বিএনপি তার কর্মকা- চালিয়ে যেতে চায়। কারণ, বিএনপি মাঠে নামার অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু সরকার তা আমলে নিচ্ছে না। কিছুদিন আগে ৭ নভেম্বর উপলক্ষে সমাবেশের অনুমতি চেয়েও পাওয়া যায়নি। পরে পুলিশ ২৭ দফা শর্তে ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্স (আইইবি) মিলনায়তনে সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে। ওই ২৭ দফার একটি বলা ছিল, সমাবেশে সরকারবিরোধী ও আইনশৃঙ্খলা পরিপন্থি কোনো বক্তব্য রাখা যাবে না। বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা মনে করেন, তৃণমূলে বিএনপির অবস্থা যে খারাপ তা নয়। তবে তৃণমূলের এই শক্তিকে মাঠের আন্দোলনে নিয়ে আসতে বিএনপির সেই সাংগঠনিক শক্তি অন্তত এই সরকারের বিপরীতে তেমন একটা নেই। তাই বিএনপি আপাতত মাঠের আন্দোলনের চেয়ে সাইবার আন্দোলনের দিকেই ঝুঁকছে।

বাছির জামাল : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

[email protected]

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :